আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের ঐতিহাসিক সংগ্রামে উত্তাল হয়েছিল ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপ। বুর্জোয়া শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে ১৮ মার্চ বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কমিটি প্যারিসের ক্ষমতা দখল করে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র কমিউন প্রতিষ্ঠা করে। কমিউন গুণগত ভাবে ছিল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। প্রথমেই প্রশাসন থেকে আমলাতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে কমিউন। ভাড়াটে সেনাবাহিনীর পরিবর্তে জনতার হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। কমিউন সদস্য, কর্মচারী, অফিসারদের বেতনের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেয়, যা একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতনের মোটামুটি সমান। আট ঘণ্টা শ্রমসময় নির্দিষ্ট করে দেয়। শ্রমিকদের উপর জরিমানা ধার্য করা, রুটির কারখানায় রাতের শিফটে কাজ নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে শ্রমকমিশন গঠিত হয়। যে সব মালিক এতদিন শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছিল তাদের সম্পত্তিচ্যুত করার আদেশ দেওয়া হয়। বেকার শ্রমিকদের কাজ ও সাহায্যের ঘোষণা করা হয়। অফিসার, সেনা অফিসার, বিচারপতি সকলের নির্বাচিত হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সব ধরনের নির্বাচিত ব্যক্তি অযোগ্য প্রমাণিত হলে নির্বাচকদের হাতে তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা হয়। চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। শিক্ষা হয় অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। কমিউন শাসনে এই প্রথম শ্রমিকরা মুক্তির স্বাদ পায়।
কিন্তু নানা কারণে কমিউনকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ৭২ দিন পর ২৮ মে বুর্জোয়া সরকার অপরিসীম বর্বরতায় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে কমিউনকে ধ্বংস করে। বিচারের নামে প্রহসন ঘটিয়ে হাজার হাজার কমিউনার্ডকে হত্যা করে বুর্জোয়ারা বিপ্লব দমন করে। এই লড়াইকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মানবমুক্তির দিশারী কার্ল মার্কস তাঁর চিন্তাধারাকে আরও ক্ষুরধার করেন, সমৃদ্ধ করেন। শ্রমিক বিপ্লবের প্রচলিত ভ্রান্ত তত্ত্বগুলিকে আদর্শগত সংগ্রামে পরাস্ত করে প্যারি কমিউনের লড়াই মার্কসবাদের অভ্রান্ত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। কমিউনার্ডদের অসীম বীরত্ব ও জঙ্গি লড়াই সত্তে্বও কমিউনের পতন দেখায়, শ্রমিকবিপ্লবের জন্য সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব ও সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব অবশ্য-প্রয়োজন। প্যারি কমিউনের এই মহান সংগ্রামের ইতিহাস জানা সমস্ত মার্কসবাদীর অবশ্য-কর্তব্য। ২০১১ সালে গণদাবীতে এই ইতিহাস সংক্ষিপ্ত আকারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আরও কিছু সংযোজন ও সম্পাদনা করে ধারাবাহিক ভাবে সেটিকে আমরা প্রকাশ করছি।
আগের তিনটি কিস্তিতে নেপোলিয়ন সাম্রাজ্যের পতন, পুনরায় বুরবোঁ রাজতন্তে্রর ক্ষমতা দখল, ১৮৩০-এ জুলাই বিদ্রোহে অর্লিয়ানিস্ট বংশের লুই ফিলিপের ক্ষমতা দখল এবং ১৮৪৮-এ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অস্থায়ী সরকার গঠন ও বুর্জোয়া প্রজাতন্তে্রর প্রতিষ্ঠা, সংবিধান পরিষদ থেকে শ্রমিক প্রতিনিধিদের বিতাড়ন এবং ২২ জুন শ্রমিক শ্রেণির বিদ্রোহকে নৃশংস ভাবে দমনের মধ্যে দিয়ে বুর্জোয়াদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কথা আলোচিত হয়েছে। এ বার চতুর্থ কিস্তি। – সম্পাদক, গণদাবী
৪
অর্লিয় শাসক লুই ফিলিপের আমল থেকেই প্রজাতন্ত্রী বুর্জোয়ারা ‘ন্যাশনাল’ (National) নামে প্যারিসের এক পত্রিকার চারপাশে জড়ো হয়ে তাদের মতবাদিক এবং সাংগঠনিক কাজকর্ম চালাতে থাকে। তাদের গোষ্ঠীটি ন্যাশনাল গোষ্ঠী নামেই পরিচিত হয়। ৪ মে-র নির্বাচনে গঠিত জাতীয় সভা যে কার্যনির্বাহক কমিশন গঠন করে তার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি এই গোষ্ঠীই দখল নিয়েছিল। নেপোলিয়ন রাষ্ট্রপতি পদে বসেই সরকারি সব দপ্তর থেকে ন্যাশনাল অনুগামী সবাইকে সরালেন। মন্ত্রিসভায় ভিড় দেখা গেল লেজিটিমিস্ট ও অর্লিয়ান্সী রাজতন্ত্রীদের। জাতীয় সভার সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হল। প্রজাতন্ত্রী বুর্জোয়াদের শেষ আশ্রয় ছিল এই জাতীয় সভা। এই সংঘর্ষের পরিণাম হিসাবে নেপোলিয়ন ও রাজতন্ত্রীরা মিলিত ভাবে জাতীয় সভাকে অকেজো করে তুলল।
এই পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে এল জাতীয় বিধানসভার নির্বাচন। পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়াল দুটি প্রধান দল– শৃঙ্খলা পার্টি আর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বা লাল পার্টি। রাজতন্ত্রী অর্লিয়ান্সী ও লেজিটিমিস্টরা শৃঙখলা পার্টিতে জোট বাঁধল। প্রথম নেপোলিয়নের পতনের পর শাসনক্ষমতায় বুরবোঁ রাজবংশকে সামনে রেখে যে বৃহৎ ভূস্বামীরা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তারাই লেজিটিমিস্ট। অপর অংশটি অর্থজগতের অভিজাতবর্গ এবং প্রধান শিল্পপতির দল জুলাই প্রজাতন্ত্রের আমলে অর্লিয় রাজবংশের লুই ফিলিপকে সামনে রেখে শাসন চালিয়েছিল, এরা অর্লিয়ান্সী। এই উভয় শক্তিই ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে তাদের ক্ষমতা হারিয়েছিল। লুই নেপোলিয়ন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এই দুই শক্তিই পুনরায় ক্ষমতার অলিন্দে ফিরে আসে এবং জুন বিপ্লবের পরই তারা শৃঙ্খলা পার্টির নামে (Party of the order) পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়। অন্য দিকে শ্রমিক ও পেটি বুর্জোয়া পার্টির মিলনে গঠিত হয় সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি তথা লাল পার্টি। এর মধ্যে ছিল পেটি বুর্জোয়াদের মুখপাত্র মতাঁইনিয়াঁর (Montognard অর্থ্যাৎ Mountain) তথা পর্বত দল। সম্মিলিত বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে পেটি বুর্জোয়া ও কৃষক শ্রেণির যে অংশ ইতিমধ্যেই বিপ্লবীভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল তারও নিজেদের যুক্ত করল বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে। এই দুই শক্তি হল প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
১৩ মে-র সাধারণ নির্বাচনে ৭৫০টি আসনের ৫০০টিতে রাজতন্ত্রীরা নির্বাচিত হলেন। বামপন্থীরা পেল ২০০ আসন। প্যারিসের সব আসন তাদের দখলে থাকল। তাদের নেতা লেদ্রু রলাঁ পাঁচটি প্রদেশ থেকে নির্বাচিত হলেন। এতদিন যে গ্রামাঞ্চল রক্ষণশীলদের ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল সেখানেও লাল পার্টির প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া গেল।
উল্লেখ করা দরকার, বোনাপার্টপন্থী প্রতিনিধিরা একটা স্বতন্ত্র সংসদীয় দল গঠনের পক্ষে সংখ্যায় ছিল অতি অল্প। তাই তারা শৃঙ্খলা পার্টির লেজুড় হয়েই থাকল। শৃঙ্খলা পার্টির হাতেই রইল সরকারি ক্ষমতা, সেনাবাহিনী এবং আইন তৈরির ক্ষমতা। অর্থাৎ গোটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাটাই। সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চরিত্র বিশ্লেষণ করে মার্ক্স দেখালেন, প্রলেতারিয়েতের সামাজিক দাবিগুলির বিপ্লবী মুখটা ভেঙে গণতান্ত্রিক দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া হল, আবার পেটি বুর্জোয়াদের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়ার বিশুদ্ধ রাজনৈতিক রূপটি খসিয়ে এগিয়ে দেওয়া হল তার সমাজতন্ত্রী মুখটা। এই ভাবেই গড়ে উঠল সোস্যাল ডেমোক্রেসি। স্বাভাবিক ভাবেই এই সোস্যাল ডেমোক্রেসি এমন কিছু গণতান্ত্রিক-প্রজাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দাবি তুলল, সেগুলি পুঁজি ও মজুরির মতো দুই চরম বিপরীত দ্বন্দে্বর অবসান ঘটাবে না, বরং এদের মধ্যেকার শত্রুভাব কমিয়ে সামঞ্জস্য আনবে। সোস্যাল ডেমোক্রেটিক দল তার বিপ্লবী চরিত্রের অভাবের জন্য এবং দোদুল্যমান চরিত্রের জন্যই নেপোলিয়নের নেতৃত্বে রাজতন্ত্রীদের প্রবল আক্রমণের মুখে ভেঙে পড়ল।
এই অবস্থায় প্রজাতন্ত্রী, পেটি বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতকে শায়েস্তা করতে জরুরি অবস্থা জারি করল সরকার। নতুন আইন এনে জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হল। নতুন মুদ্রণ আইন এনে বিরোধী পত্রিকাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হল। এবার আঘাত আর শুধু প্যারিসের উপর নয়। জেলাগুলির ওপরও সামরিক নির্যাতন নামিয়ে আনা হল। পেটি বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত কার্যকলাপের ঘাঁটি ‘ক্লাব’গুলো বন্ধ করে দেওয়া হল।
ফলে গুপ্তসমিতিগুলির কার্যকলাপ দ্রুত বাড়তে থাকল। শ্রমিকদের শিল্প সমবায়গুলি রাজনৈতিক ভাবে প্রলেতারিয়েতকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যম হয়ে দাঁড়াল। অন্য দিকে রাজতন্ত্রীরা শ্রমিকদের আবার ক্ষমতা দখলের, সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার গুজব ছড়াতে থাকল।
নেপোলিয়নের মধ্যে প্রথম থেকেই বাসা বেঁধেছিল যে ভাবে হোক পুরনো সাম্রাজ্যটা ফিরিয়ে আনার আকাঙ্খা। শুরু হল জাতীয় পরিষদের সভাপতি লুই নেপোলিয়নের সঙ্গে সাংবিধানিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বুর্জোয়াদের বিরোধ। বুর্জোয়া ব্যক্তিশাসক বনাম বুর্জোয়া শ্রেণির বিশেষ এক অংশের স্বার্থের বিরোধ। রাজতন্ত্রী লেজিটিমিস্ট ও অর্লিয়ানিস্টদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠছিল। এই উভয় গোষ্ঠীই রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছিল।
এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই ১৮৪৯-এর ১ নভেম্বর লুই বোনাপার্ট ওদিলন বারো মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করলেন। গঠন করলেন নতুন মন্ত্রিসভা, যা তাঁর নিজের মন্ত্রিসভা। এর মধ্যে দিয়ে নেপোলিয়ন বুর্জোয়া শ্রেণিকে বুঝিয়ে দিলেন রাষ্ট্রপতিরূপী নেপোলিয়নই রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। এই অবস্থাতেও বুর্জোয়ারা খানিকটা নির্বিকারই থাকল। কারণ তাদের জানা ছিল, ১৮৫২ তেই নেপোলিয়নের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। সংবিধান কোনও ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার অধিকার দেয়নি।
ইতিমধ্যে ১৮৫০-এর ১০ মার্চের উপনির্বাচনে এক অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। তিরিশটি আসনের মধ্যে কুড়িটিতেই নির্বাচিত হল সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা। প্যারির তিনটি আসনেই জয়ী হল বামপন্থীরা– জুন অভ্যুত্থানের নায়ক দ্য ফ্লত, অস্থায়ী সরকারের আমলে শ্রমিক কল্যাণের জন্য গঠিত লুকসেমবুর্গ কমিশনে লুই ব্লাঁ-র সচিব ভিদাল ও অস্থায়ী সরকারের প্রজাতন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রী কার্নো।
নির্বাচনী ফলাফলে হতভম্ব হয়ে গেল শৃঙ্খলা পার্টি। তাদের মধ্যে লাল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। ১০ মার্চের নির্বাচনের ফলাফল যেন ১৯৪৮ এর জুনকে বাতিল করে দিল। নেপোলিয়নের এক মন্ত্রীও পরাজিত হলেন, সেই অর্থে যা নেপোলিয়নের পরাজয়। শৃঙ্খলা পার্টি হুঙ্কার ছাড়ল, ‘১০ মার্চের ভোটের অর্থ যুদ্ধ’। হাঁক দিল, ‘আরও পীড়ন চাই, দশগুণ পীড়ন’। বলল, ‘নিয়মতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র অসম্ভব’। রাজতন্ত্রীরা, শৃঙ্খলারা বলল, যত নষ্টের গোড়া ওই সর্বজনীন ভোটাধিকার। আওয়াজ তুলল, সর্বজনীন ভোটাধিকার ধ্বংস কর। ১৮৫০ এর ৩১ মে নতুন নির্বাচনী আইনে বিলোপ করা হল সর্বজনীন ভোটাধিকার। ৯৫ লক্ষের ভোটার তালিকা থেকে ৩০ লক্ষ শ্রমজীবী ভোটারের নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হল। মার্কস ৩১ মে-র আইনকে বলেছেন, বুর্জোয়া শ্রেণির কু-দেতা। আসলে ১০ মার্চের ফলাফলটা বুর্জোয়া আধিপত্যের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ। তাই শ্রেণি সংগ্রামের জন্য এই আইনটা বুর্জোয়াদের কাছে ছিল একটি জরুরি প্রয়োজন।
সর্বজনীন ভোটাধিকার বাতিল করা মাত্র জাতীয় সভা এবং বোনাপার্টের সংগ্রাম আবার শুরু হল। বুর্জোয়া ব্যক্তিশাসক বনাম বুর্জোয়া শ্রেণির বিশেষ এক অংশের স্বার্থের বিরোধে বাণিজ্য বুর্জোয়ারা ও ছোট পুঁজির মালিকরা লুই নেপোলিয়ানকে সমর্থন করেছিল। কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবসা বাণিজ্যের পক্ষে সুবিধেজনক বলেই তারা নেপোলিয়নকে সমর্থন করেছিল। এছাড়া প্রধানত যে সম্প্রদায়ের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন তা হল ছোট ছোট জমির মালিক গোষ্ঠী। সে সময়ে ফ্রান্সে বিরাট সংখ্যায় কৃষক সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সময় থেকেই বুর্জোয়াদের অবাধ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শহরের কিছু বড় বড় শিল্প গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট জমির মালিকরা একসময় নিজেদের স্বার্থেই বৃহৎ ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সামন্ততন্ত্রকে ভেঙে বুর্জোয়া মালিকানা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ বুর্জোয়া সৃষ্টি হলেও, এই গ্রামীণ বুর্জোয়া সম্প্রদায় ও শহরের সুদখোর মহাজনেরা শোষণ শুরু করলে ছোট জমির মালিকরা বুর্জোয়া বিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এদের একাংশ, নিজেদের রাজনৈতিক চেতনার মান উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হওয়ায় নিজেদের শ্রেণিস্বার্থকে ক্ষুদ্র গণ্ডির ভেতরে টিকিয়ে রাখাতে তৎপর না হয়ে শ্রমিক শ্রেণির পাশে দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া বিরোধী প্রগতিশীল সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং ফ্রান্সে যে সব কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত হয় তাতে তারা নেতৃত্ব দেয়। অপর এক অংশ সমাজ বিবর্তনের ধারাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম না হওয়ায় রক্ষণশীল ভূমিকা নেয় এবং ক্ষুদ্র গণ্ডির ভেতরে নিজেদের সুযোগসুবিধা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই বিরোধী অবস্থান নেয়। এই অংশের রাজনৈতিক চেতনার মান নিম্নস্তরে থাকার ফলে পরিষদে নিজেদের শ্রেণিস্বার্থকে প্রতিফলিত করতে পারেনি। নিজেদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়াও এদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। একমাত্র কোনও কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক শক্তিই পারে এদের নেতৃত্ব দিতে। সে কারণে এরা লুই নেপোলিয়নের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে এবং নিজেদের শ্রেণিস্বার্থেই জাতীয় পরিষদের সভাপতি ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বুর্জোয়ার লড়াইয়ে এরা নেপোলিয়নের পক্ষ সমর্থন করে। এই সময়ে শ্রেণিসংগ্রাম হয়ে পড়ে জটিল। একদিকে ছিল প্রগতিশীল শ্রমিকশ্রেণি, অন্য দিকে বুর্জোয়াদের পরস্পরবিরোধী নানা গোষ্ঠী। নিজ নিজ গোষ্ঠী স্বার্থেই এরা বুর্জোয়াদের অপর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দেয়।
বোনাপার্ট তাঁর নিজের ব্যয়বরাদ্দ হিসাবে বছরে ৩০ লক্ষ ফ্রাঁ দাবি করলেন। সংবিধান সভা তা নাকচ করে দিল। এই সুযোগে নেপোলিয়ন নিজেকে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বলে জাহির করার সুযোগ খুঁজে নিলেন। ১০ অক্টোবর বোনাপার্ট তাঁর মন্ত্রীদের কাছে সর্বজনীন ভোটাধিকার পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। মন্ত্রীরা তাদের পদত্যাগপত্র দাখিল করল। ১৮৫১-র জানুয়ারিতে নেপোলিয়ন সেনাবাহিনীকে নিজ নিয়ন্ত্রণে আনতে তার প্রধান, মন্ত্রীসভার আস্থাভাজন শাঙ্গার্নিয়ারকে বরখাস্ত করে আলজিরিয়া থেকে প্যারিসে ফিরিয়ে আনলেন কলোনিয়াল জেনারেলদের– যাদের গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সমর্থন ছিল না।
সংবিধান সভা নেপোলিয়নকে পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার জন্য সংবিধান সংশোধনে কোনও ভাবেই রাজি না হওয়ায় নেপোলিয়ন সেনাবাহিনী ও পুলিশ বিভাগের বড়কর্তাদের নিয়ে ক্ষমতা দখলের ছক করতে লাগল। ইতিমধ্যে নেপোলিয়ন নিজেকে শৃঙ্খলার রক্ষক এবং শান্তির দূত হিসাবে নিজেকে তুলে ধরলেন। বুর্জোয়াদের একটা অংশের সমর্থনও এ ব্যাপারে নেপোলিয়ন পেয়ে গেলেন। অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব কেটে গিয়ে বাণিজ্যে যখন মন্দা এল, ১৮৫১-র শেষ দিকে, তখন বাণিজ্যিক বুর্জোয়ারা পার্লামেন্টীয় সংগ্রামকেই মন্দার কারণ বলে অভিযোগ করল, তারা এই লড়াই বন্ধ করার দাবি তুলল। লড়াই বন্ধের দুটি রাস্তা ছিল– বোনাপার্টের ক্ষমতা চলতে দেওয়া অথবা সংবিধানসম্মত উপায়ে তার অবসরগ্রহণ। বুর্জোয়াদের একটি অংশ নেপোলিয়নের অবসর চাইলেও অপর একটি গোষ্ঠী চেয়েছিল বোনাপার্ট যেহেতু রাষ্ট্রপতির আসনে ইতিমধ্যেই আসীন, তাই তিনি সেখানেই থাকুন। বুর্জোয়াদের এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে নেপোলিয়ন পুরোপুরি কাজে লাগালেন।
১৮৫১-র ২ ডিসেম্বর। অতর্কিত হানা দিয়ে নেপোলিয়নের অনুগত সেনাবাহিনী আইনসভা, সংবাদপত্র অফিস, ছাপাখানা আর প্যারিস শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দখল করে নিল। ভোরের আলো ফোটার আগেই প্যারির মানুষ দেখল, আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, নতুন সংবিধান তৈরির কাজ চলছে, যা একটি গণভোটে অনুমোদিত হবে। সর্বজনীন ভোটাধিকার নাকি আবার ফিরে এসেছে! জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচারিত এক আবেদনপত্রে রাষ্ট্রপতি আইনসভাকে ষড়যন্ত্রকারীদের আড্ডাস্থল বলে নিন্দা করেছেন। আর একটি ঘোষণায় সৈন্যদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, সৈনিকরা, আপনারা দেশকে বাঁচান।
শুরু হল ধরপাকড়। আইনসভার ষোল জন সদস্য সহ আশিজন বিরোধী নেতাকে গ্রেফতার করা হল। আইনসভার তিনশজন সদস্যকে সভাকক্ষে ঢুকতে দেওয়া হল না। গোটা ফ্রান্সে বিরোধী গোষ্ঠীর ২৬০০ নেতা ও সমর্থককে গ্রেফতার করা হল কোনও আইনের পরোয়া না করেই। সারা প্যারিসের পোস্টারে ছয়লাপ করে দেওয়া হল– দেশকে বাঁচাও! নেপোলিয়নকে সমর্থন করো! নেপালিনয়ই সঙ্কট-কবলিত দেশের একমাত্র ত্রাতা।
২০ ডিসেম্বর গণভোট নেওয়া হল তাঁর কার্যকাল বাড়ানোর জন্য। ৭৫ লক্ষ ভোট পড়ল নেপোলিয়নের পক্ষে। নেপোলিয়ন ঘোষণা করলেন, আমি বিপ্লবের যুগের অবসান ঘটিয়েছি। প্যারিসের শ্রমিকরা অবশ্য এই কু দেতা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল। সৈন্যদের গুলিতে যাঁরা প্রাণ হারালেন তাঁদের অধিকাংশ শ্রমিক। ২৬০০ শ্রমিক ও তার নেতাদের গ্রেফতার ও নির্বাসন দেওয়া হল। দেলেসক্লুজ, লেদ্রু রোলাঁ, লুই ব্লাঁ সহ বহু সমাজতন্ত্রী নেতাদের নির্বাসিত করা হল।
১৮৫২ নভেম্বরে আরও এক গণভোটের আড়ালে বংশানুক্রমিক সম্রাটতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনলেন লুই বোনাপার্ট। আনুষ্ঠানিক ভাবে দ্বিতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। লুই বোনাপার্ট নিজেকে তৃতীয় নেপোলিয়ন হিসাবে ঘোষণা করলেন। এবার ভোট পেলেন ৭৮ লক্ষ। মার্ক্স বললেন, দ্বিতীয় সাম্রাজ্য শৃঙ্খলা পার্টি মার্কা প্রজাতন্ত্রেরই জারজ সন্তান!