দক্ষিণ আমেরিকার দেশ প্যারাগুয়ে এখন খবরের শিরোনামে। তিন দিকে ব্রাজিল, বলিভিয়া এবং আর্জেন্টিনা পরিবৃত ছোট্ট দেশ প্যারাগুয়ে। করোনা অতিমারিতে সরকারের চূড়ান্ত উদাসীনতা ও ব্যর্থতার প্রতিবাদে নাগরিকদের লাগাতার বিক্ষোভ চলছে। ৫ মার্চ পুলিশ প্রতিবাদকারীদের উপর ব্যাপক আক্রমণ নামিয়ে আনায় এক জনের মৃত্যু হয়েছে, ১৮ জন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতির চাপে পড়ে প্রেসিডেন্ট মারিও আবদো আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কয়েক জন মন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
প্যারাগুয়ে সরকার করোনা মোকাবিলায় লকডাউন ঘোষণা করে বাইরের দেশ থেকে আসা-যাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ করে, আক্রান্তদের বা তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের জন্য কোয়ারেন্টিন নির্দিষ্ট করেছিল। তাতে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে ছিল অতিমারি। পরে পুঁজি মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখতে গিয়ে সমস্ত পদক্ষেপ শিথিল করে দেয় আবদো সরকার। প্রেসিডেন্ট আবদোর কলরাডো পার্টি যে সব শিল্পপতি গোষ্ঠীর টাকায় চলে, তাদের নির্দেশেই এই ব্যবস্থা। দেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি আমদানি-রফতানির ব্যবসা, এ ছাড়া ট্যুরিজম, খনি, নির্মাণ শিল্প– এই সমস্ত ক্ষেত্রে পুঁজি মালিকদের মুনাফা-লালসা মেটাতেই জনস্বার্থকে বলি দেয় প্যারাগুয়ে সরকার। যার ফলে আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়। প্যারাগুয়ের হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসার অভাব দেখা দিতে থাকে। আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকায় হাসপাতালগুলিতে বেডের সংকট দেখা দেয়। নাগরিকরা বেসরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন। সেখানে চিকিৎসা খরচ ও ওষুধের ব্যয় বিপুল। কোনও কোনও পরিবার দিনে ৩০০ ডলার অর্থাৎ ২১ হাজার টাকারও বেশি ওষুধের পিছনে খরচ করতে বাধ্য হয়েছে। হাজার হাজার ডলার চিকিৎসার বিল মেটাতে অনেক রোগীর পরিবার় ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতে অথবা বন্ধক দিতে বাধ্য হয়। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চরম দুর্নীতি আর মুনাফাভিত্তিক ব্যবসায়িক স্বাস্থ্য পরিষেবা বিপর্যয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। ভারতবাসীর দুর্দশার সাথে কতই না মিল!
প্রয়োজনীয় সংখ্যায় আইসিইউ-এর ব্যবস্থা নেই। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির সাথে ভ্যাকসিন মজুত করার প্রতিযোগিতায় প্যারাগুয়ে সরকার অনেকটাই পিছিয়ে। রাশিয়া থেকে আনা ভ্যাকসিন জনসংখ্যার (৭১ লক্ষের কিছু বেশি) তুলনায় অত্যন্ত কম, মাত্র চার হাজার। ফলে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। বহু জন পদত্যাগ করেছেন, যার মধ্যে দেশের বিখ্যাত ন্যাশনাল রেসপিরেটরি ইলনেস ইনস্টিটিউটের প্রধান পর্যন্ত রয়েছেন।
ব্যাপক গণবিক্ষোভে ভীত সরকার
সমস্ত বিক্ষোভের মিলিত ফল এই গণবিক্ষোভ। রাজধানী সানসিয়নে ৫ মার্চ বিশাল প্রতিবাদ মিছিল হয়। বিক্ষোভের চাপে পড়ে প্রেসিডেন্ট আবদো রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। তাতে বিক্ষোভের আগুন কিছুমাত্র কমেনি। ‘আমি প্যারাগুয়েবাসীর জন্য, ২০২১’– সোসাল মিডিয়ার় এই হ্যাশট্যাগের প্রচারে সাড়া দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নামেন হাজার হাজার মানুষ। আবদো সরকার পুলিশ লেলিয়ে দেয় বৃদ্ধ, মহিলা, শিশু নির্বিশেষে প্রতিবাদকারীদের উপর। টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট চালিয়েও আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে পারেনি প্রশাসন। রাস্তার দখল নিয়ে নেয় আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনের মেজাজ এমন ছিল, কোথাও কোথাও পুলিশকে হঠে গিয়ে সাদা পতাকা ওড়াতে দেখা যায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘এটা ভেনেজুয়েলার ষড়যন্ত্র’ বলে আন্দোলনকে দাগিয়ে দিতে চাইছেন। কিছুদিন আগে ইকুয়েডরে শাসক মোরেনো এবং চিলির শাসক পিনেরা সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে এ ধরনের নানা ‘চক্রান্তের’ গল্প ফেঁদেছিল। দেখা গেছে সব দেশের শাসক বুর্জোয়াদের এই জায়গায় একটা অদ্ভূত মিল। ভারতেও তাই। দিল্লির কৃষক আন্দোলনকে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট, খালিস্তানিদের চক্রান্ত ইত্যাদি বলে বদনাম দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতে কোথাওই আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। প্যারাগুয়েতেও আন্দোলনের চাপে প্রেসিডেন্ট আবদো তিনজন মন্ত্রীর পদত্যাগের কথা জানান। রাজধানীর পথে হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে এসে স্লোগান তোলেন– একজন মন্ত্রীকেও আমরা চাই না, এই সরকারকেও আমরা চাই না। ওই দিনও পুলিশ ব্যাপক অত্যাচার চালায় ও গ্রেপ্তার করে।
বিরোধী লিবারাল পার্টির নেতা পূর্বতন প্রেসিডেন্টের শাকরেদরা শাসক কলরাডোদের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত। কিন্তু কলরাডো পার্টির মতোই সাধারণ মানুষের দুর্দশা নিয়ে তাদের কোনও উদ্বেগ নেই। কলরাডো গত ৮০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন (এর মধ্যে টানা ৩৫ বছর একনায়কতন্ত্র চলে)। অল্প কিছুদিনের জন্য বামপন্থী লুগো ক্ষমতায় এলেও ইমপিচমেন্ট করে সেই সরকার ফেলে দেওয়া হয়। পুঁজিপতিদের বিশ্বস্ত দল এই কলরাডো পার্টি। লিবারাল পার্টিও পুঁজিপতিদের আরেকটি বিশ্বস্ত দল, ভারতের ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও বিজেপির মতো। একের বদলে আরেক দল ক্ষমতায় বসলেও শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার কোনও পরিবর্তন হয়নি। প্যারাগুয়েতেও না, ভারতেও নয়।
রাস্তাতে থেকেই লড়াইয়ের শপথ
ক্ষমতায় থাকা নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি এবং অতিমারিতে শত শত মানুষের মৃত্যুতে প্যারাগুয়েবাসীর ক্ষোভ মাত্রাছাড়া হয়। বিক্ষোভ ফেটে পড়ে দেশের নানা স্থানে। প্যারাগুয়ের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য দায়ী এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, আর এই ব্যবস্থাকে রক্ষণাবেক্ষণ করছে ক্ষমতাসীন দলগুলি– এ সত্য আর আড়াল করা যাচ্ছে না। অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের মতো এখানকার পুঁজিপতিরাও চায় অর্থনৈতিক সঙ্কটের অজুহাত দিয়ে শ্রমিক-কৃষকদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করতে। বিপরীতে নিজেদের পুঁজির পাহাড় আরও বাড়িয়ে তুলতে। তাই শ্রমিক-কৃষক সহ জনসাধারণ বিকল্প সরকার গড়ার ডাক দেয়। দেশের ‘অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে’ পুঁজিপতিদের সাথে শ্রমিক-কৃষককে হাত মেলানোর ডাক দিয়েছিলেন সেখানকার বুদ্ধিজীবীরা। এটা পুঁজিপতিদের সাথে আপস করানোর একটা অপচেষ্টা বলে মনে করছেন শ্রমিক-কৃষকরা, তাই সেই ফাঁদে তারা পা দিচ্ছেন না।
বর্তমানে সরকার অপসারণ এই আন্দোলনের ডাক। এর জন্য প্রতি পাড়ায়, কারখানায়, যুবকদের মধ্যে সভা, গণসমাবেশ সংগঠিত হচ্ছে। আন্দোলনকে আরও সুসংহত করতে বামপন্থী সংগঠনগুলিও রয়েছে তাদের যথাযথ শক্তি নিয়েই। কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থে নানা দাবি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চলছে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসানের দাবি উঠছে
২০১৯ সাল থেকে লাতিন আমেরিকায় বারবার ফেটে পড়ছে মানুষের বিক্ষোভ–অক্টোবরে ইকুয়েডরে আন্দোলন, ওই বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরে চিলিতে প্রবল বিক্ষোভ, ২০২০-র সেপ্টেম্বরে কলোম্বিয়ায় ন্যাশনাল স্ট্রাইক, নভেম্বরে পেরুতে গণঅন্দোলনের জেরে দু’বার সরকার পতন, ওই মাসেই গুয়াতেমালায় সংসদ ভবন অগ্নিকাণ্ড, হাইতিতে মৌসে সরকারের অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দু’মাস ধরে লাগাতার গণবিক্ষোভ পথ দেখিয়েছে প্যারাগুয়েকে। সব দেশেই আওয়াজ উঠছে, পুঁজিবাদ নিপাত যাক।
লাতিন আমেরিকার এই দেশগুলি যেন এক একটা বারুদের স্তূপ। বেকারি, দারিদ্রে জর্জরিত দেশগুলিতে অতিমারি সেই বারুদে আগুন নিক্ষেপ করেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল করোনা অতিমারি। কি ভারত, কি প্যারাগুয়ে মানুষের তীব্র সংকটে বিক্ষোভের পারদ চড়ছে। দরকার বিপ্লবী নেতৃত্বের, যারা সমাজের নিষ্পেষিত অবহেলিত মানুষের নেতৃত্বে বসাবে শ্রমিক শ্রেণিকে।