প্রধানমন্ত্রী লকডাউন পরিস্থিতিতে ভাষণ দিয়েছেন, অথচ সংকটত্রাণে থালা বাজিয়ে কিংবা প্রদীপ জ্বালিয়ে-বাজি ফাটিয়ে হুল্লোড় করে ভাইরাস তাড়ানোর নিদান দেননি এটা দেশের মানুষের কাছে একটা বড় খবর হতেই পারত। কিন্তু পারল না, কারণ ১২মে তিনি দিয়েছিলেন একটা নতুন চমক। ২০ লক্ষকোটি টাকার প্যাকেজ আনবে সরকার। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ লকডাউনে আর্থিক দিক থেকে প্রায় সর্বস্বান্ত কোটি কোটি মানুষ সেদিন কান পেতেছিল টিভিতে, রেডিওতে এতদিনে তাহলে প্রধানমন্ত্রী লকডাউনে ইতিমধ্যেই কাজ হারানো ১২ কোটি শ্রমিকের জন্য কিছু ভাববার সময় পেয়েছেন। পথের ভিখারিতে পরিণত হওয়া কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য এতদিন কিছু ভেবে ওঠার ফুরসৎ না পেলেও এবার তিনি ঠিক কিছুভেবে ফেলেছেন। এবার নিশ্চয়ই অনাহারে, অর্ধাহারে কাটানো কৃষক, অসংঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, ছোট দোকানদার, অতি ক্ষুদ্র শিল্প, লেদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে রোজগার হারানো মানুষের জন্য কিছু করবেন। রাষ্ট্রসংঘ যে ৪০কোটি ভারতীয় পরিবারের নতুন করে অতল দারিদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে, প্রধানমন্ত্রী তাদের রক্ষা করেই ছাড়বেন।
কিন্তু কী বললেন তিনি? প্রতিশ্রুতি দিলেন, তাঁর প্যাকেজে শ্রমিক, থেকে মালিক কেউ বাদ যাবে না। তারপর নির্দিষ্ট কী শোনালেন? লোকালের জন্য ভোকাল হওয়া, আত্মনির্ভরতা, যুবশক্তির জয়গান, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর প্রশাসন, ভারতের বিশ্বসভায় পরিচিতি, সাহসী সংস্কার, চাহিদা আর তার সাপ্লাই চেন এমন সব ‘স্তম্ভের’ কথাওশোনা গেল। কিন্তু পেটের ভাত, বেকার হয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ হাতে কাজ! প্রধানমন্ত্রীর তাঁর মূল্যবান সময় এসব ‘সামান্য’ সমস্যায় নষ্ট করেননি। তিনি আধঘণ্টা ধরে নানা কথা বললেন, কিন্তু ভুলে গেলেন আজও রাস্তায়হেঁটে চলা, হাঁটতে হাঁটতে প্রাণ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা। ভুলে গেলেন, রাস্তায় সন্তান প্রসব করেই ঘরে ফেরার তাগিদে আবার হাঁটতে বাধ্য হওয়া শ্রমিক মায়েদের কথা। অনাবাসী, অভিবাসী ভারতীয়দের জন্য তিনি চিন্তিত। কিন্তু দেশের শ্রমিকদের নিয়ে কোনও কথা তাঁর মনেও পড়েনি। অর্থনীতির সাহসী সংস্কারের ঢাক তো বিজেপি জমানার শুরু থেকেই বেজে চলেছে। তাতে দেশের মানুষের পাতে একখানা বেশি পোড়া রুটিরও সংস্থান হয়েছে নাকি? প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সবুর করুন, অর্থমন্ত্রী সব বিস্তারিত জানাবেন।
১৩ এবং ১৪ মে, কী বললেন অর্থমন্ত্রী? প্রথম দিন তিনি যে ক’টা ঘোষণা করলেন তার বেশিটাতেই সরকারের কোনও দায় নেই। তিনি ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য যে ঋণের বন্দোবস্ত করার কথা বলেছেন। তা দেবে ব্যাঙ্ক, সরকার নয়। সাধারণ লোকের জমানো আমানত ভেঙেই তা আসবে। কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতাই যদি না থাকে এই সব শিল্প ঋণ নিয়ে কী উৎপাদন করবে? সে ক্ষেত্রে ঋণ তারা নেবেই বাকেন, আর নিলে শুধবেই বা কী করে? ব্যাঙ্কগুলির ইতিমধ্যেই আকাশছোঁয়া অনাদায়ী ঋণ আদায় কী করে হবে? অর্থমন্ত্রী এর কোনও উত্তর দেননি। যেমন উত্তর দেননি, ব্যাঙ্কের থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে তা মেরে দিয়েছে যে মুষ্টিমেয় কিছু ধনকুবের, তাদের সে টাকা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করবে না কেন সরকার। এই দুর্দিনে ওর একটা অংশেই তো কয়েক কোটি লোকের সংসার চলে যেতে পারত।
অর্থমন্ত্রী দ্বিতীয় দিনে যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তাতে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের রেশনে মাসে মাথাপিছু পাঁচ কেজি করে চাল বা গম আর এক কেজি ডাল দেওয়া হবে। কিন্তু ওগুলো কি তারা চিবিয়ে খাবে? তেল, নুন, সবজি বাদ থাক, রান্না করতে গেলে জ্বালানি তো লাগবেই। কাজ না থাকলে তা কেনার পয়সা কে দেবে? গ্যাস, কেরোসিন কোনওটাতেই তো আর ভর্তুকি নেই! উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাস? তা বেশিরভাগ শ্রমিকই পান না। কারণ, দারিদ্রসীমা বলে সরকার যে আয় বেঁধে দিয়েছে তা একজন ভিখারির আয়ের থেকেও কম। অর্থমন্ত্রী পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য পিপিপি মডেলে বড় বড় কন্ট্রাকটরদের দিয়ে সস্তার ভাড়া বাড়ি তৈরির কথা বলেছেন। তা হওয়া পর্যন্ত এই মানুষগুলি কী খেয়ে বেঁচে থাকবে, কী করে আবার কাজ পাবে তা যদি বলে দিতেন! তিনি রাজ্য সরকারগুলিকে বলেছেন ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ১০০ দিনের কাজের বন্দোবস্ত করতে। অবশেষে সেই ১০০ দিনের কাজই হল কোটি কোটি লোককে কিছু কাজ দেওয়ার একমাত্র রাস্তা? এতে দেশে প্রকৃত সম্পদ সৃষ্টিতে এই বিপুল শ্রম ব্যয় না হয়ে হবে মাটি কাটায়। মনে পড়ে নাকি– সংসদে দাঁড়িয়ে ১০০ দিনের কাজকে শ্রমিকের জন্য গর্ত খোঁড়ার কাজ বলেছিলেন একজন বক্তা, নাম তাঁর নরেন্দ্র মোদি!
লকডাউনের জন্য প্রকল্পের শ্রমিক, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক, অর্ধেকেরও কম বেতন পাওয়া শ্রমিক, গৃহ পরিচারিকা ইত্যাদি প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়া বিরাট অংশের মানুষের দরকার ছিল নগদ টাকার সাহায্য। যতদিন না উপযুক্ত কাজ জোটে ততদিন গরিবের পরিবার ভরণপোষণের পূর্ণ দায় নেওয়া দরকার ছিল সরকারের। অর্থমন্ত্রী তা নিয়ে রা কাড়েননি। বলেননি তাঁদের জন্য কোনও ক্ষতিপূরণের কথা। হকার কিংবা ঠেলাচালক, ক্ষুদ্র দোকানদারদের আজ ভাত জোটার সংস্থান নেই। অর্থমন্ত্রী তাঁদের দেবেন ১০ হাজার টাকা ঋণ। এই টাকায় ব্যবসা শুরুর আগেই তো সংসারের অভাবের আগুন তা গিলে নেবে! হকারদের কাছ থেকে যে সমস্ত গরিব মধ্যবিত্তরা কেনাকাটা করেন, তাঁরা আপাতত কিছুই কেনার জায়গায় নেই। আগে তাঁদের হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে কাজের গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে পারলে তবে না হকারদের বিক্রির প্রশ্ন। কিন্তু এই ঋণও দেবে ব্যাঙ্ক, সরকার সরাসরি তার জন্য কোনও তহবিলের কথা বলেনি।
‘এমএসএমই’ বা অতি ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পে ৩ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের কথা অর্থমন্ত্রী বলেছেন। একই সাথে তিনি এমএসএসই-র সংজ্ঞা বদলে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভার যাদের সেই সমস্ত শিল্পকেও এর আওতায় এনেছেন। ফলে ঋণ কে পাবে? সামান্য ২০-৩০ হাজার টাকার পুঁজির সাথে একই গোত্রে পড়ল ১০০ কোটি টাকা? ফলে প্রকৃত ক্ষুদ্র শিল্পের পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আসলে এই ১০০ কোটি টার্নওভারের ‘মাঝারি’ পুঁজিপতিরাই এখন বিজেপির ভরসা। তাই তাদের তুষ্ট করার ব্যবস্থা করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি নগদ যোগান বাড়ানোর জন্য প্যাকেজের নামে করযোগ্য আয়ে তিনমাস টিডিএস কম কাটতে বলেছেন। টিডিএস বা টিসিএস (টাকা হাতে দেওয়ার আগেই যে কর কেটে নেয় নিয়োগকারী বা ব্যাঙ্ক) কমলে কি আয় বাড়ে? না, পরে এই টাকা আয়করে মেটাতেই হবে। কিন্তু তাতেও অপাতত সুরাহা হবে কত জনের? দেশে আয়কর দেওয়ার মতো আয় আছেই তো মুষ্টিমেয় লোকের!
অর্থমন্ত্রী দেশের মানুষের হাতে নগদ জোগানোর যে ব্যবস্থা করেছেন, তারও তুলনা মেলা ভার। প্রভিডেন্ট ফান্ডে মালিকরা যে টাকা দেয়, তা এখন দুমাস ২ শতাংশ কম দিতে হবে। এতেই নাকি নগদের জোগান বেড়ে চাহিদা বাড়বে? বাস্তবে এর ফলে কর্মচারীদের প্রাপ্য দুই শতাংশ কমে যাবে। কারণ অর্থমন্ত্রী এই টাকা কর্মচারীর হাতে দেওয়ার কথা বলেননি। ফলে লাভবান হবে মালিকরাই। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে প্রায় নিঃস্ব শ্রমিক কর্মচারীদের আরও পকেট কাটার আয়োজন করে দিলেন অর্থমন্ত্রী। আরও বড় কথা হল এর জন্য সরকারকে কোনও দায় নিতে হবে না। শ্রমিকের প্রাপ্যই কেটে নিয়ে হল সরকারি প্যাকেজ?
প্রধানমন্ত্রী কথিত আত্মনির্ভর ভারত হবে কী করে? অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা, ২০০ কোটি টাকার কাজে গ্লোবাল টেন্ডার হবে না। ফলে সব ‘লোকাল’ হয়ে যাবে! বিজেপি সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ব্যাপারটা মনে রাখলেই এর স্বরূপ বোঝা যাবে। কী রকম ‘লোকাল’ সেটা? রাফাল বিমান তৈরি করতে সক্ষম বলে সরকারকে জানিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা হ্যাল। সরকার কী করেছে? এই বরাত তারা দিয়েছে একটাও বিমান তৈরি না করা অনিল আম্বানির কোম্পানিকে। তারা কী করবে? ফরাসি কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে দু একটা যন্ত্রাংশ জোড়ার ঠিকা নেবে। হয়ে গেল গ্লোবালের বদলে লোকাল? এবারও এরকম কিছু হবে, দেশি ধনকুবেরদের় মুনাফা বাড়বে। তারা বিদেশেও লগ্নি করে ‘গ্লোবাল’ হবে। আর মোদিজি হবেন তাদের ‘লোকাল’ ম্যানেজার। দেশের লোকের কর্মসংস্থানের কী হবে? কৃষকদের ফসল লাভজনক দামে বিক্রির কী হবে? প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ভারতের অন্যতম ‘স্তম্ভ’ যে ‘সাপ্লাই চেনের’ কথা বলেছেন, তা আসলে কী? ভারতীয় বড় পুঁজির মালিকদের হাতে কৃষি ফসল এবং খুচরো ব্যবসা পুরোপুরি তুলে দেওয়ার খুব পুরনো চক্রান্ত নয় কি! এটাকেও আর্থিক প্যাকেজ বলতে হবে?
এই ত্রাণ প্রকল্প জালিয়াতিতে ভরা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কগুলিকে আনাদায়ী ঋণ এবং বর্তমানের ঋণগ্রহিতার অভাবের সমস্যাথেকে বাঁচাতে যে ব্যবস্থার় কথা বলেছিল, তাও সরকারের ত্রাণ প্রকল্পে দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী!
অর্থমন্ত্রী মেরেকেটে ২০ লক্ষ কোটির মধ্যে যে সাড়ে পাঁচ লক্ষকোটির কথা বলতে পেরেছেন, তাতে সরকারের দায় ৬০ হাজার কোটিও নয়। প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী যদি ভেবে থাকেন লকডাউনের বাজারে একটু তামাশা করে দেশের মানুষের মনোরঞ্জন করবেন, তাহলে আর একবার থালা টালা বাজালেই পারতেন। খালিপেটে অর্থনীতি নিয়ে এমন তামাশা বড় নিষ্ঠুর বলেই মনে হয়।
প্যাকেজ নয়, প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে হাত পা বেঁধে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলার আয়োজনই করেছেন অর্থমন্ত্রী তথা বিজেপি সরকার।