পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের প্রতিদিন লাফিয়ে দামবৃদ্ধি দেখলে মনে হয় না দেশে কোনও সরকার আছে। সরকারের ভাব দেখলে মনে হয় কর্পোরেট তেল কোম্পানিগুলি দাম যেমন খুশি বাড়িয়ে জনজীবন স্তব্ধ করে দিলেও তাদের কিছু করার নেই। তাহলে সরকারটা কী জন্য? যে ভাবে চলছে তাতে পরিষ্কার কর্পোরেটরাই দেশ চালাচ্ছে, আর সরকারের কাজ তাদের সেবা করা। কর্মহীন, আশ্রয়হীন গরিব-নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ, ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে। তার সাথে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ায়, পরিবহণ সহ সমস্ত কিছুর দাম আবারও বাড়ায় তারা আগুন দামে পুড়ছে। তাদের পিঠে আরও বোঝা চাপিয়ে পুঁজিমালিকদের আরও লাভের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে সরকার।
পেট্রোপণ্যের দামবৃদ্ধির কারণ কী? সরকারের প্রতি বারের ফাটা রেকর্ড–বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে, ফলে তাদের কিছু নাকি করার নেই। এর সাথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেওয়া চলছে। বলা হচ্ছে এই যুদ্ধের জন্যই তেলের দাম বাড়ছে।
দেখা যাক, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি। কত দাম বেড়েছে বিশ্ববাজারে? ২০১৪ সালে বিজেপি যখন দিল্লির সরকারে বসে, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেল (ব্রেন্ট ত্রুড)-এর দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৯৩.১৭ ডলার। ২০২২-এ দাম ব্যারেল প্রতি ৯৮.২২ ডলার (১১ এপ্রিল), আর এক অশোধিত তেল ডব্লিউটিআই ৯৩.৬৩ ডলার। বেড়েছে কত? ব্রেন্ট ত্রুড বেড়েছে ৫.০৫ ডলার। সেই অনুপাতে পেট্রল-ডিজেলের দাম কত বেড়েছে? ২০১৪ সালে ভারতে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ছিল ৬৬.০৯ টাকা, ২০২২-এ তা দাঁড়িয়েছে ১১৫.১২ টাকা (লেখা পর্যন্ত)। আর ডিজেলের দাম কত বেড়েছে? ২০১৪-তে ডিজেলের দাম ছিল ৫০.৩২ টাকা লিটার। ২০২২-এ দাম ১০০ টাকা (লেখা পর্যন্ত)। কেন ভারতে এত বৃদ্ধি? গত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ৬৮ থেকে ৮৬ ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করা সত্তে্বও পেট্রল-ডিজেলের দাম কমানো হয়নি। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম এতটা নামায় দেশে পেট্রোপণ্যের দাম তো কমার কথা। অথচ আমদানি খরচ বাড়ার অজুহাত দিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে বিপুল হারে। এর দায় অস্বীকার করতে পারে বিজেপি সরকার?
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে মানুষকে বোকা বানানোর এটা একটা কৌশল মাত্র। দেশে পেট্রোপণ্যের বিপুল দাম বৃদ্ধির আসল কারণ এটা নয়, আসল কারণ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিপুল ট্যা’ আর একচেটিয়া তেল কোম্পানিগুলির মুনাফা-লিপ্সা, যা বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখিয়েছি।
এবার আসা যাক সরকারের দ্বিতীয় যুক্তিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নাকি দামবৃদ্ধির কারণ। অথচ খবরে উল্টোটাই প্রকাশিত হয়েছে। রাশিয়ায় অপরিশোধিত তেল (ব্রেন্ট ত্রুড)-এর উৎপাদন বিপুল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমেরিকা ও ইউরোপ নিষেধাজ্ঞা চাপানোয় সেই তেল কিনছে না বহু দেশ। সেজন্য রাশিয়া সে দেশের সর্বোচ্চ মানের অপরিশোধিত তেল ‘ইউরালস’ বিপুল ছাড় দিয়ে ব্যারেল প্রতি মাত্র ৩৫ ডলারে বেচতে চাইছে ভারতকে। এমনকি এর থেকেও কম দামে কেনার প্রস্তাব দিচ্ছে রাশিয়া। তা নিয়ে রুশ তেল সংস্থা রসনেফট পিজেএসসি এবং ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের মধ্যে কথা চলছে। সস্তায় রাশিয়ান গ্যাসও পাওয়া যাচ্ছে। সেই তেল দেশে সস্তায় বিক্রি না করে মোদি সরকার তেলের লাগাতার দামবৃদ্ধিতে রাবারস্ট্যাম্প দিয়ে চলেছে। এতে সরকারের লাভ। পেট্রোপণ্য থেকে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স আদায় করে। পেট্রোপণ্যের দাম যত বাড়বে, ততই বাড়বে সরকারের ট্যাক্স, তত সরকারি কোষাগার ফুলে-ফেঁপে উঠবে। সেজন্য পেট্রলে প্রতি ১০০ টাকায় ৫৬ টাকাই হল কেন্দ্র ও রাজ্যের ট্যাক্স। আর ডিজেলে ১০০ টাকায় ৫১ টাকা হল দুই সরকারের ট্যাক্স। তাহলে কি দামবৃদ্ধির দায় সরকার অস্বীকার করতে পারে? সরকার একদিকে বাজারের হাতে দাম নিয়ন্ত্রণের ভার ছেড়ে দিয়ে বৃহৎ তেল কোম্পানিগুলিকে বিপুল লাভ করতে দিচ্ছে। অন্যদিকে চড়া কর বসিয়ে নিজেরাও জনগণকে লুটছে। ফলে সরকারের সহযোগিতায় রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলি তো বটেই, পেট্রোপণ্য থেকে বিপুল মুনাফা লুটছে এসার, আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠী, আদানি গোষ্ঠী ইত্যাদি।
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল ২০২১-২২ অর্থবর্ষে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ৫, ৮৬১ কোটি টাকা লাভ করেছে, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে ১ হাজার কোটি বেশি। আর যে একচেটিয়া তেল কোম্পানিগুলির দুঃখে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তাঁর দলের মন্ত্রীরা চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না, তাদের লাভের পরিমাণ শুনলে চমকে উঠবেন! রিলায়েন্সের ২০২১-এ দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেই শুধু লাভ বেড়েছে ৪৩ শতাংশ, লাভের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬৮০ কোটি। বিজেপি সরকার-তেল কোম্পানিগুলির দুষ্ট চক্রের শোষণে সাধারণ মানুষ আরও হতদরিদ্র হচ্ছে। এই কাজে সঙ্গত দিচ্ছে জনস্বার্থ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামানো রাজ্য সরকারগুলিও।
আজ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সাধারণ মানুষের। এর থেকে তারা মুক্তি চাইছে। কিন্তু কোন পথে আসবে মুক্তি? সাধারণ মানুষের দুরবস্থা নিয়ে পুঁজিবাদী সরকারগুলির কোনও দুশ্চিন্তা নেই। এই অবস্থায় সরকারের জনগণের প্রতি দায়িত্বহীনতা, প্রতারণার জবাব দিতে প্রয়োজন সাধারণ মানুষেরঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। যে পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থা মানুষকে খাদের কিনারে টেনে এনেছে, তার সমূলে উচ্ছেদের লক্ষ্যেই এই আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের বাঁচার কোনও রাস্তা নেই। এটাই যে একমাত্র রাস্তা তা বুঝিয়ে দিয়েছে দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন।