বিশ্বে গণতন্ত্র রক্ষার চ্যাম্পিয়ান আমেরিকায় পুলিশের বুটের তলায় পিষ্ট জর্জ ফ্লয়েডের কথা মনে পড়ে? শ্বাসরুদ্ধ ফ্লয়েড বলেছিলেন, আই কান্ট ব্রিদ। তেমনই শ্বাসরুদ্ধ আজ ভারতের ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক পরিসরও। তামিলনাড়ূর তুতিকোরিনে এক মোবাইল দোকানি ও তাঁর ছেলেকে পিটিয়ে মেরেছে পুলিশ। পুলিশি হেফাজতেই শ্বাস বন্ধ হয়েছে অশীতিপর সমাজকর্মী স্ট্যানস্বামীর। হাথরসে দলিত মেয়ের খুনি-ধর্ষকরা পুলিশের সহায়তাই পেয়েছে, আর নির্যাতিতার দেহ গোপনে পুড়িয়েছে পুলিশ। অবশ্য উত্তরপ্রদেশে বসে মহিলাদের, দলিতদের, সংখ্যালঘুদের শ্বাস নেওয়ার উপায়টাই ক্রমাগত কমিয়ে আনছে শাসকরা। তুতিকোরিনের দোকানদার চেয়েছিলেন লকডাউনের মধ্যেও সামান্য রোজগার করতে। সমাজকর্মী চেয়েছিলেন অত্যাচারিত দলিতরা মাথা উঁচু করে বাঁচুক। হাথরস-কন্যা চেয়েছিল শুধুই মানুষ হিসাবে বাঁচতে। এই চাওয়াগুলিই শাসকের চোখে ‘অপরাধ’। চাই জীবন দিয়ে তার চড়া মাশুল দিতে হল এঁদেরকে।
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে গণতান্ত্রিক ভারতের কী অপার মহিমা! পুলিশি হেফাজতে দেশে দিনে গড়ে ৫টি মৃত্যু ঘটে– ন্যাশনাল ক্যাম্পেন এগেনস্ট টর্চার নামক একটি সংস্থা সমীক্ষা করে দেখিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতে হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এনএইচআরসি-র ২০২০-র মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী, পুলিশি হেফাজত ও জেল হেফাজতে নথিভুক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ১৭ হাজার ১৪৬। শারীরিক হেনস্থা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও থানায় ঘটছে বেশি। পুলিশ তবে কার রক্ষক?
১৯৬১ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি এ এন মুল্লা বলেছিলেন, ‘পুলিশ হল সুসংগঠিত ক্রিমিনাল বাহিনী।’ তিনি বলেন, ‘দেশে এমন কোনও বেআইনি সংগঠন নেই যাদের অপরাধজনিত রেকর্ড সংগঠিত পুলিশ বিভাগের অপরাধের থেকে বেশি।’ স্বাধীনতার ১৫ বছর পার হওয়ার আগেই ভারতের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের স্বরূপটি দেখিয়ে দিয়েছিল এই উক্তি। প্রশাসন গত ৬০ বছরে আরও নির্মম হয়েছে। স্বাধীনতার পর নতুন ভারতের স্বপ্ন যখন জনমানসে টাটকা– সে সময় বিচারবিভাগেও পড়েছে তার কিছু কিছু ছাপ। তাই ভারতের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল এম সি শীতলবাদ সে সময় বলেছিলেন, ‘বিচারপ্রক্রিয়ার বাইরে রাখা উচিত পুলিশকে।’ অথচ দিনে দিনে পুলিশই যেন বিচারকর্তা হয়ে উঠেছে। পুলিশ বিচার হওয়ার আগেই চরম শাস্তি দিচ্ছে, নিরপরাধ নাগরিকের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে পুলিশের মাত্রাছাড়া নির্যাতন। সংবিধানের ২১নং ধারায় ব্যক্তির অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা যাই লেখা থাক, বইয়ের বাইরে তার কোনও অস্তিত্ব আজ ভারতে নেই। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকার এনকাউন্টারে মৃত্যুকেই আইনের কাঠামো দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সরকারি হিসাবে শুধু উত্তরপ্রদেশেই গত সাড়ে চার বছরে বিজেপি শাসনে ৮৪৭২টি এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে ৩৩০২ জন, মারা গিয়েছে ১৪৬ জন। সে রাজ্যে গণআন্দোলন করতে গিয়ে বহু রাজনৈতিক বন্দিকে জেল হেফাজতে নৃশংস শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে যত সরকার এসেছে, পুলিশ-প্রশাসনকে মুঠোয় পুরে সাধারণ মানুষের উপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে। বর্তমানে চরম স্বৈরাচারী বিজেপি সরকার তাদের় জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে যে কোনও প্রতিবাদী স্বরকে কঠোর হাতে দমন করতে নেমে পড়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে বিজেপি মন্ত্রীর বয়ানে। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী গত সপ্তাহে সংসদে বলেছেন, ২০১৭-২০১৯-এর মধ্যে ১১৮৯ জন পুলিশি হেফাজতে অত্যাচারিত হয়েছেন এবং পুলিশের সাথে ভুয়ো সংঘর্ষে ৩৪৮ জন মারা গেছেন। যদিও সরকারি এই হিসেব যে আসল সংখ্যার তুলনায় কিছুই নয় তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। পুলিশি হেফাজতে বহু মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্তও হয় না। লকআপের বাইরে এই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অন্তর্ভুক্ত হয় না। তা সত্ত্বেও এনএইচআরসি-র ২০১৯ এর রিপোর্টের ভয়াবহতায় মানুষ আতঙ্কিত– ১৭২৩ জন জেল এবং পুলিশি হেফাজতে মারা গেছেন। বিচার ব্যবস্থাকে এড়িয়ে গিয়ে পুলিশ প্রশাসনই বিচারের ভার তুলে নিলে তাকে সভ্য দুনিয়া ফ্যাসিস্ট শাসনই বলে।
বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ গণতন্ত্রের বদলে বেশি করে দমনতন্ত্রের দিকেই ঝুঁকে। তাই আমলা-প্রশাসন-পুলিশের পদতলে পিষ্ট বিচারব্যবস্থা প্রশাসনের দাসত্ব করতে বাধ্য হচ্ছে। অবাধ্য হলে, সরকারের ও ক্ষমতাবানদের হুকুম না শুনলে বিচারকও খুন হয়ে যাচ্ছেন। তাই সাধারণ মানুষের আইনি অধিকার সুরক্ষা নিতান্তই কথার কথা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি যত একচেটিয়া রূপ নিচ্ছে, উপরিকাঠামো হিসাবে প্রশাসনিক স্তরে ফ্যাসিবাদী প্রবণতাও মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। সরকার ক্রমশ বেশি করে সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে, পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করছে।
পুঁজিবাদ-ফ্যাসিবাদের এই ভয়াবহ আক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে দরকার সঠিক সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষের উত্তাল আন্দোলন।