পুলওয়ামাঃ সত্য চাপা দেওয়া গেল না

দেশপ্রেমের স্বঘোষিত ঠিকাদারদের কাছে সেনা-জওয়ানদের প্রাণ যে স্রেফ ভোট-দাবার বোড়ে, প্রধানমন্ত্রীর ‘জয় জওয়ান’ স্লোগান যে নেহাত দেশের মানুষের প্রতি ঠগবাজি, তা ফাঁস হয়ে গেল জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে।

বিজেপির এতদিনের বিশ্বস্ত নেতা, চারটি রাজ্যে রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করা সত্যপাল মালিক সম্প্রতি ‘দি ওয়্যার’ পত্রিকার সাংবাদিক করণ থাপারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, পুলওয়ামা বিস্ফোরণের পরেই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে ঘটনার কথা এবং প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা জানাতেই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে চুপ করে থাকতে বলেন এবং বলেন, ‘ইয়ে কুছ অউর চিজ হ্যায়’। অর্থাৎ এর পিছনে অন্য ব্যাপার আছে। সত্যপাল বলেছেন, আমি তখনই বুঝতে পারি, গোটা ঘটনাটিকে এ বার পাকিস্তান বিরোধিতার কাজে লাগানো হবে।

 

বাস্তবেও ঠিক তা-ই ঘটে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলবল সেই ‘অন্য ব্যাপারটি’ আসলে কী, সে কথা দেশের মানুষকে জানালেন না। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তানকে পুলওয়ামা বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করে দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে। ২০১৯-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি সেনাদের একটি অংশকে জম্মু থেকে কাশ্মীরে পাঠানোর পথে জম্মুর পুলওয়ামায় সেনা কনভয়ে বিস্ফোরণ ঘটে ৪০ জন সেনার মৃত্যু হয়। এই বিস্ফোরণের যে ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে সেদিন দেওয়া হচ্ছিল দেশের এক বড় অংশের মানুষেরই তা নিয়ে গভীর সংশয় ছিল। অথচ এই গাফিলতির জন্য কারা দায়ী তার কোনও তদন্ত রিপোর্ট আজও পর্যন্ত দেশের মানুষ জানতে পারল না।

সত্যপাল মালিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সিআরপিএফ সে দিন জওয়ানদের বিমানে করে নিয়ে যেতে চাইলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক অনুমতি দেয়নি। শুধু তাই নয়, এত বড় একটি কনভয়ের জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল তা-ও করা হয়নি। বিস্ফোরণের পরেই এ তথ্য সামনে এসেছিল যে, কনভয় যাওয়ার সময় হাইওয়েতে ওঠার ছোট রাস্তাগুলি, যা বন্ধ করে রাখার কথা, তা করা হয়নি। মালিক বলেছেন, ৩০০ কেজি আরডিএক্স ভর্তি যে গাড়িটি কনভয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পরিণতিতে ৪০ জন জওয়ান নিহত হন, সেটি তার আগে ১০-১২ দিন ধরে কাশ্মীরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেও তা ধরা পড়েনি।

স্বাভাবিক ভাবেই দেশের মানুষের মনে তখনই এ প্রশ্ন উঠেছিল যে, রাষ্ট্রপতি শাসন ও সামরিক শাসনের আওতায় থাকা কাশ্মীরে বিশেষত চরম নিরাপত্তায় মুড়ে রাখা পুলওয়ামায় এমন ঘটনা ঘটতে পারল কী করে? এত বিপুল পরিমাণ আরডিএক্স, যা একমাত্র সেনাবাহিনীই ব্যবহার করে, তা এল কোথা থেকে? আক্রমণের গোয়েন্দা হুঁশিয়ারি থাকা সত্ত্বেও কেন কোনও অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হল না? ৭৮টি গাড়িতে করে ২৫০০ সৈন্যকে একসঙ্গে এক বিরাট কনভয় হিসাবে নিয়ে যাওয়া হল কেন? তার আগে যাত্রাপথের নিরাপত্তা খুঁটিয়ে দেখা হয়নি কেন? কঠোর নিরাপত্তায় মুড়ে থাকার কথা যে রাস্তা সেখানে বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি ঢুকতে পারল কী করে? প্রশ্ন উঠেছিল প্রধানমন্ত্রী যখন এমনকি প্রশাসনিক প্রধানদেরও ধরাছোঁয়া তথা যোগাযোগের বাইরে গিয়ে জিম করবেট পার্কে সুটিং করছিলেন (যেখানে এমনকি টেলিফোন যোগাযোগও রাখা হয়নি) ঠিক সেই সময়েই এই বিস্ফোরণের ঘটনা কি একেবারেই কাকতালীয়?

এমন আরও নানা প্রশ্ন সেদিন উঠেছিল। অথচ এ সব কোনও প্রশ্নের উত্তরই সরকার দেশের মানুষকে দেয়নি। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেই যেমন প্রধানমন্ত্রী নীরব থাকেন, সেদিনও তেমনই নীরব ছিলেন। যদিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হুঙ্কার তিনি প্রথম থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন। সাথে সাথে বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রচারক বাহিনী কাশ্মীরের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করে দেয়। দেশের সর্বত্র সংখ্যালঘু বিশেষত কাশ্মীরী মুসলমানদের উপর আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। পাশাপাশি, যেখানে প্রয়োজন ছিল ভবিষ্যতে যাতে এ ভাবে জওয়ানদের প্রাণ দিতে না হয় তার জন্য দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করা এবং শাস্তি দেওয়া, তার পরিবর্তে প্রশ্নকারীদের উপরেই হামলা শুরু হয়ে যায়। এ থেকে জনমনে সেদিনই প্রশ্ন উঠেছিল, পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এ সব কি ঘটতে পারে? এই পরিকল্পনার কথা জনমনে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছিল যখন বিস্ফোরণের ক’দিন পর ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে দেশের মানুষ বিজেপি নেতাদের থেকে জানতে পারল, আগের রাতে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানের বালাকোটে ঢুকে পড়ে নিখুঁত লক্ষে্য বোমা ফেলে ৩৫০ জন জঙ্গিকে হত্যা করেছে। এই বিমান হানার পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রী নাকি বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বসে নিজেই করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, বিজেপি নেতাদের এই ঘোষণা এবং দেশ জুড়ে তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের এ নিয়ে বিজয়োল্লাসের মধ্যেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়ে দেয়, সেদিন ভারতীয় বিমানহানা নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবির সাথে বাস্তবের কোনও মিল নেই। অথচ এই বিমানহানাকে পুঁজি করেই সরকার অনুগামী সংবাদমাধ্যমগুলি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেশের নিরাপত্তা কতখানি অটুট তার ফিরিস্তি চালাতে থাকল এবং এই ঘটনাকে বিজেপি নেতারা আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে প্রচারের হাতিয়ার করলেন এবং কতগুলি আসনে জয়ী হতে চলেছেন তার নিখুঁত হিসাব দিতে থাকলেন। এটাকে একটা নিখুঁত চিত্রনাট্য বলেই বহু মানুষ সেদিন ধরতে পেরেছিলেন। সত্যপালের বক্তব্যে সেই সত্যই এখন উঠে এল।

বাস্তবে সেনাদের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে বিজেপি নেতারা সেদিন ভোটে জিততে বলি দিয়েছিলেন এতগুলি জওয়ানের প্রাণ। সত্যপাল মালিকের বক্তব্যে প্রমাণ হচ্ছে, বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা সেদিন দেশের মানুষের সাথে অতি নিকৃষ্ট এক প্রতারণা করেছিলেন। মানুষের দেশপ্রেম নিয়ে ভোট রাজনীতি করেছেন। এ সবই তাঁরা করেছেন তাঁদের শাসনের সর্বাত্মক ব্যর্থতাকে ঢাকতে। নির্বাচনের সামনে দেশের মানুষকে সেদিন বলার মতো সত্যিই কিছু তাঁদের ঝুলিতে ছিল না। দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ দেখতে গিয়ে জনস্বার্থ রক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে এই সরকার ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল। সেই ব্যর্থতা আজ আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। বেকারদের জন্য কোনও কর্মসংস্থান এই সরকার করতে পারেনি। নতুন শিল্প, কল-কারখানা খুলতে পারেনি। একই রকম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে কৃষকদের মূল সমস্যা– ফসলের ন্যায্য দামের ব্যবস্থা করতে। এই অবস্থায় দেশপ্রেমের জিগির তুলে ভোটে জিততে সেনা মৃত্যুকে, সেনা অভিযানকে সেদিনও কাজে লাগিয়েছেন বিজেপি নেতারা। আজও সেই মিথ্যাচার সমানে চলেছে। সত্যপাল মালিকের এত বড় উক্তির পরেও আজ প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিজেপির তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা চুপ করে আছেন। হয় প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলুন সত্যপাল মালিক যা বলছেন তা মিথ্যা, না হয় তিনি প্রকাশ্যে দেশবাসীর কাছে তাঁর মিথ্যাচারের জন্য ক্ষমা চান। দেশের মানুষ সত্য জানতে চায়। সেই অধিকার তাদের রয়েছে।

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ১৬ এপ্রিল এক বিবৃতিতে পুলওয়ামার ঘটনা নিয়ে সম্পূর্ণ সত্য জনগণের কাছে পেশ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।