‘সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা’ (মন্তব্য, ২ জানুয়ারি ২০২২) নিবন্ধে পায়েল সেনগুপ্ত প্রতিযোগিতার যৌক্তিকতা নিয়ে যে-ভাবনার কথা তুলেছেন তা খুবই প্রাসঙ্গিক। বিষয়টিকে তাঁর ‘পিছনের দিকে হাঁটা’ মনে হয়েছে। এই মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলেছে। নিছক শরীরী সৌন্দর্যের এমন প্রতিযোগিতা সামগ্রিকভাবে মেয়েদের সংগ্রামের প্রতি অমর্যাদা প্রকাশ করে। দারিদ্র ও অপুষ্টির কারণে সমাজের এক বিরাট অংশের মেয়েদের বেড়ে ওঠাই পূর্ণাঙ্গ হয় না, সাধারণ সৌন্দর্যেরও অভাব ঘটে। যাদের সে অবস্থা নয়, তাদেরও সুন্দর হওয়ার পিছনে ব্যক্তিগত ভাবে কোনও ভূমিকা থাকে না। এক অংশের পুরুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ছাড়া এই সৌন্দর্যের কী ভূমিকা আছে! এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে পুরুষেরাই, সৌন্দর্যকে বাজারের পণ্য হিসেবে উপস্থিত করার জন্য। তাই এই আয়োজনের পিছনে ঢালা হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। ‘রূপ’ নামক এই পণ্যের বিপণনে যা বহুগুণ হয়ে ফিরে আসে। এই পুরুষেরা নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখে না। সহকর্মী, সহযোদ্ধা হিসেবে দেখে না। দেখে ভোগ্যপণ্য হিসেবে। এর পিছনে কাজ করে আসলে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজির মুনাফার লালসা।
পুরুষের মতোই নারীর মধ্যে ব্যক্তিত্বের যে-প্রকাশ, সেটাই তো তার সৌন্দর্য। সেই ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় তার কর্মদক্ষতায়, সাফল্যে। সেই সৌন্দর্য প্রকাশ পায় তার দায়িত্বশীলতায়, কর্তব্যপরায়ণতায়। নিছক শরীরী সৌন্দর্যের প্রদর্শনে কারওই কোনও মর্যাদা নেই– না নারীর, না পুরুষের। জীবনের কোনও সার্থকতাও তাতে নেই। বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি-রাজনীতি– যে-সব ক্ষেত্রে পুরুষের সার্থকতা, নারীরও তাই। সেই সার্থকতা পুরুষের মতো মেয়েদেরও অর্জন করে নিতে হয়, কোনও পুরুষের কিংবা পুরুষ সমাজের দয়ার দান তা নয়। আপন ভাগ্য জয় করে নেওয়ার অধিকার থেকে মেয়েদেরকেউ বঞ্চিত করতে পারে না। ‘দুর্গমের দুর্গ হতে সাধনার ধন’ সে সংগ্রাম করেই আহরণ করে নেবে।
নিবন্ধকার সঠিকভাবেই নিজেকে সুন্দর দেখানো এবং বহু জনের কাছ থেকে তার স্বীকৃতি পাওয়ার ইচ্ছাকে আদিম আকর্ষণ বলেছেন। মানুষ যত সভ্য হয়েছে তত তো সে এই আদিমতাকেই অতিক্রম করেছে। তার রুচি উন্নত হয়েছে, সংস্কৃতি উন্নত হয়েছে। একজন উন্নত জীবনবোধ সম্পন্ন মেয়ের কাছে শারীরিক সৌন্দর্যের স্বীকৃতি আসলে এক ধরনের অসম্মানও বটে। কোনও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মেয়ে শুধুমাত্র এমন স্বীকৃতি চাইতে পারে না। আমরা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত অজস্র ‘সুন্দর’ মানুষের অসুন্দর আচরণ দেখি যা আমাদের অবাক করে, পীড়িত করে। আবার তথাকথিত অসুন্দর মানুষদের সুন্দর আচরণে মুগ্ধ হই, শ্রদ্ধায় মাথা নত করি।
সৌন্দর্যের এই প্রদর্শনী ভিতরে কোথাও যদি আমাদের আনন্দ দিয়ে থাকে, তবে তার পিছনে কাজ করছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। এই পুরুষতন্ত্রই মেয়েদের যুগ যুগ ধরে শুধুই ‘মেয়ে’ করে রেখেছে, রাখতে চেয়েছে, মানুষ হওয়ার সুযোগ দেয়নি। একদিন এই পুরুষতন্ত্রকে সব দিক থেকে রক্ষা করেছে, মদত দিয়েছে সামন্ততন্ত্র। আজ তার জায়গা নিয়েছে পুঁজিতন্ত্র। সৌন্দর্যের এই প্রদর্শনীও পুরুষতন্তে্ররই এক বেড়াজাল। এই জালকে ছিন্নভিন্ন করার সংগ্রামটাই তো মানুষ হওয়ার সংগ্রাম। অথচ এক অংশের মেয়েরাও এই পুরুষতন্ত্রেরই শিকার হয়ে নিজেদের সুন্দরী হিসাবে তুলে ধরার প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মেয়েদের জন্য শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন নবজাগরণের যে মনীষীরা, তাঁরা তো এই স্বপ্নই দেখেছিলেন যে, মেয়েরা শিক্ষার আলোয় অজ্ঞতা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবে, আত্মসম্ভ্রমের অধিকারী হবে, সমগ্র নারী সমাজের বুকের ব্যথা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে। তারা তো এটাই চেয়েছিলেন যে, শিক্ষায় এমন মেয়ে তৈরি হবে যাদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ আসবে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আসবে। তার পর বৃহত্তর নারীসমাজ, যারা অত্যাচারিত, বঞ্চিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, তাদের জাগাবে। মেয়েরা শুধুমাত্র পাশ করবে, রুজি রোজগার করবে, আরাম-আয়েশে জীবন কাটাবে আর নিজেদের ‘সুন্দরী’ করে তুলবে, স্ত্রী-শিক্ষা প্রবর্তনের এ উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না। তাঁদের নিরলস সংগ্রামের ফল ভোগ করেও যদি তাঁদের বুকের ব্যথাকে আমরা মনের মধ্যে বহন না-করি তবে তা হবে তাঁদের মহৎ সংগ্রামের অপমান, যা আসলে নিজেদেরও অপমান।
সমর মিত্র
কলকাতা-১৩
দেশ পত্রিকার একটি নিবন্ধকে ভিত্তি করে লেখা এই চিঠিটি দেশ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে। (১৭ জানুয়ারি, ২০২২)