নাগরিকত্ব দিতে পুরনো আইনই যথেষ্ট, নতুন আইনের প্রয়োজন নেই, সে কথাই তথ্য সহ সামনে এল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাইয়ের বক্তব্যে। ২ মার্চ রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে (মোদি শাসনে) প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আগত ১৮, ৯৯৯ জন শরণার্থীকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ১৫,০৩৬ জন বাংলাদেশ থেকে আগত। এর মধ্যে ১৪,৮৬৪ জন ২০১৫ সালে নাগরিকত্ব পেয়েছেন ৫৩টি বাংলাদেশী ছিটমহল ভারতে যুক্ত হওয়ায়। পাকিস্তান থেকে এসে নাগরিকত্ব পেয়েছেন ২,৯৩৫ জন। আফগানিস্তানের পেয়েছেন ৯১৪ জন, শ্রীলঙ্কার পেয়েছেন ১১৩ জন, মায়ানমারের পেয়েছেন ১ জন (সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া ৫।৩।২০)।
শুধু স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীই নন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনও চেন্নাইয়ে এক জনসভায় অনুরূপ তথ্য দেন। তিনি আরও বলেন, ১৯৬৪ থেকে ২০০৮, এই সময়সীমায় শ্রীলঙ্কা থেকে ৪ লক্ষ তামিল শরণার্থী ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছেন।
দুই মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরেই দেশ জুড়ে প্রশ্ন উঠছে, পুরনো আইনেই যদি প্রায় ১৯ হাজার শরণার্থীকে নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে বাকিদেরও এই আইনেই দেওয়া যায়। তা হলে নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা কোথায়?
এই প্রশ্ন আজ সর্বস্তরে উঠলেও, রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একমাত্র এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) সর্বপ্রথম বলেছিল, নাগরিকত্ব দিতে পুরনো আইনই যথেষ্ট, নতুন আইনের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। সিএএ সংসদে পাশ হওয়ার পরেই ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পরিকল্পনা হিন্দু মহাসভা, আরএসএস, মুসলিম লিগ উত্থাপন করেছিল এবং পরে জাতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি তা গ্রহণ করেছিল। তদানীন্তন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা এই পরিকল্পনায় তৎক্ষণাৎ মদত দিয়ে তা কার্যকর করে দেয়। এই কারণে ভারত, পাকিস্তান উভয় দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ফলশ্রুতিতে যে অভূতপূর্ব শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি হয় তার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সেদিন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভারতের জনগণের ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় দায়বদ্ধতা হিসাবেই ঘোষণা করেন যে, সমস্ত শরণার্থীদের কোনও রকম বিধিনিষেধ বা পূর্বশর্ত ছাড়াই ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে বা সম্প্রতি যারা প্রবেশ করেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নটি ভারতের সংবিধান, নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ এবং আন্তর্জাতিক আইন ও প্রচলিত রীতি-পদ্ধতির ভিত্তিতেই দেওয়া যায়। বিজেপি সরকার সে পথে না গিয়ে এবং নাগরিকত্বের প্রশ্নে আগে জাতীয় স্তরে ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নাগরিকত্ব আইনের নূতন একটি সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে এল এবং সেটি সংসদের দুই কক্ষে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপটে পাশ করিয়ে নিল, যার কোনও প্রয়োজনই ছিল না।”
তাহলে মোদি সরকার এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কেন প্রণয়ন করল? ওই বিবৃতিতেই বলা হয়, ‘‘আসলে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী মানসিকতায় উস্কানি দিতে, জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে জনগণের নজর ঘুরিয়ে গণআন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ আটকাতে আরএসএস-বিজেপির এটি এক জঘন্য ষড়যন্ত্র। …. একই ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে বিজেপি গোটা দেশে এনআরসি চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে। …. এই অবস্থায় আমরা গোটা দেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এই দুটি পদক্ষেপই প্রতিরোধ করা দরকার মনে করি।”
আশার কথা, জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। শাসক শিবিরের মধ্য থেকে এই আইনের প্রয়োজনহীনতার কথাও উঠে আসছে। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এই আইন বাতিল করা যখন জরুরি তখন মোদি ও অমিত শাহ বলছেন, সিএএ লাগু হবেই। এই দম্ভ থেকেই সরকার শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার ন্যূনতম সৌজন্যটুকুও দেখাল না। বিপরীতে দলীয় গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে একতরফা গণহত্যা করে আন্দোলন ভাঙার পথ নিল। গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে মূল্য দিয়ে এই অপ্রয়োজনীয় আইন অবিলম্বে বাতিল না করলে জনতার আন্দোলন আরও তীব্র রূপ নিতে বাধ্য।