মহারাষ্ট্রের পুণেতে ১ জানুয়ারি ভিমা–কোরেগাঁও যুদ্ধ–জয়ের ২০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন দলিতরা৷ অনুষ্ঠানকে ঘিরে কয়েকদিন আগে থেকেই মারাঠা সম্প্রদায়ের একাংশ ও দলিতদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়ছিল৷ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় অনুষ্ঠানের দিন এক কিশোরের দুঃখজনক মৃত্যু ঘটে৷ তার ফলে ২ জানুয়ারি থেকে বেশ ক’দিন বনধ, অবরোধ, বিক্ষোভ, অগ্নি–সংযোগে সারা মহারাষ্ট্র উত্তাল হয়ে রইল৷
কেন এই যুদ্ধজয়ের পূর্তি অনুষ্ঠান? কেনই বা তা নিয়ে দুই পক্ষের উত্তেজনা?
১৮১৮ সালে ভিমা–কোরেগাঁও যুদ্ধটা হয়েছিল পেশোয়া–রাজের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির৷ যুদ্ধে ব্রিটিশরা জিতেছিল৷ কিন্তু এই যুদ্ধ–জয়কে মহারাষ্ট্রের দলিতরা, বিশেষ করে তথাকথিত অতিশূদ্ররা তাঁদের নিজেদের মুক্তি বলে মনে করেছিলেন৷ কারণ, ব্রিটিশ বাহিনীতে সৈন্য হিসেবে অতিশূদ্র মাহার সম্প্রদায়ের মানুষরাই ছিলেন প্রধান শক্তি৷ তাঁরা পরাজিত করেছিলেন পেশোয়া রাজকে৷ এ রকম ভাবনার কারণ ছিল, তাঁদের প্রতি পেশোয়া রাজের সময়ের ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল অত্যাচার৷ সেই সময় অতিশূদ্রদের নাগরিক সমাজে পুরোপুরি অস্পৃশ্য করে রাখা হয়েছিল৷ হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্যতা আজও আছে৷ কিন্তু সে সময় ব্রাহ্মণ্যবাদের রক্ষক পেশোয়া–রাজের শাসনে অতিশূদ্রদের প্রতি লাঞ্ছনা, অবমাননা, পদদলিত করার এমন নজির বোধ হয় হিন্দুসমাজ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না৷
পেশোয়া–রাজের আমলে অস্পৃশ্যদের বাস করতে হত গ্রামের এক প্রান্তে৷ তাঁদের সকালে ও বিকালে– যখন সূর্যের আলোয় শরীরের ছায়া লম্বা হয়ে থাকে– তখন সাধারণ মানুষের (আসলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের) যাতায়াতের রাস্তায় হাঁটাচলা করায় ছিল নিষেধাজ্ঞা৷ কারণ সেই ছায়া উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শরীর স্পর্শ করে অশুচি করে দিতে পারে৷ যে সময়ে তাঁদের যাতায়াতের অনুমতি ছিল, তখনও তাঁদের গলায় বা কাঁধে একটি ঘটি ঝুলিয়ে রাখতে হত৷ থুথু মাটিতে ফেললে তা দূষিত হতে পারে বলে তা ফেলতে হত সেই ঘটিতে! তাঁদের জন্য জ্ঞানচর্চা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ৷ এমনকী পেশোয়া রাজের ক্ষমতা হারানোর পরও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের মধ্যে এবং তাঁদের সন্তান–সন্ততিদের মধ্যে অস্পৃশ্যতার প্রভাব কী রকম ছিল তার নমুনা পাওয়া যায় মহাত্মা জ্যোতি রাও ফুলের সুহৃদ শিক্ষাব্রতী রেভারেন্ড মুরে মিচেলের একটি লেখা থেকে৷ তিনি তাঁর ‘দি রিকালেকশন অফ মাই আর্লি মিশনারি লাইফ’ বইয়ে লিখেছেন– ‘‘আমার বিশিষ্ট বন্ধু জ্যোতিবা গোবিন্দরাও ফুলে, যিনি অতিশূদ্রদের স্বার্থে কঠিন সংগ্রাম করেছেন, তিনি একদিন– যাঁরা সবচেয়ে নিচুজাতের বা যাঁরা কোনও জাতেই পড়ে না– তেমন এক মাহার বালককে আমাদের কাছে পাঠান৷ বালকটির মাতৃভাষায় জ্ঞান যথেষ্টই ছিল এবং তাকে বুনিয়াদি ইংরেজি ক্লাসে ভর্তি করব মনস্থ করেছি৷ এর কিছুক্ষণের মধ্যে একদল ব্রাহ্মণ বালক এসে ডপস্থিত, তাদের চোখ ঘৃণায় জ্বলছে এবং তারা উত্তেজিত হয়ে বলল– ‘এখানে মাহাররা আছে, তাই আমরা স্কুল ছেড়ে চলে যাচ্ছি৷’
আমি বললাম – ‘মাত্র একজন তো মাহার৷’
– ‘হ্যাঁ একজন, কিন্তু তা দশজনের সমানই খারাপ৷’
– ‘তাহলে কি গরিব ছেলেটিকে স্কুল থেকে বের করে দেব?’
– ‘তা আমরা জানি না, তবে যদি সে থাকে, আমরা থাকব না৷’
– ‘তোমাদের তো তাকে স্পর্শ করতে হবে না, তোমরা ক্লাসের বুদ্ধিমান সেরা ছাত্র, আর সে তো গরিব মাহার বালক, সবচেয়ে নিচে তার অবস্থান৷ সে আলাদা বেঞ্চে একা বসবে৷’
– হ্যাঁ, কিন্তু মেঝের মাদুরে সংযোগ তো থাকবে, আর তা দিয়েই তো অস্পৃশ্যতার কলুষ ছড়াবে৷ আমরা সকলেই এখন কলুষিত, খাদ্য গ্রহণের আগে কলুষতা মুক্ত হতে স্নান করতে হবে৷’ …
যে কোনও মূল্যেই হোক না কেন, মাহার বালকটিকে আমি স্কুলের বাইরে বের করে দিতে পারি না এবং দেব না৷ … আমি ব্রাহ্মণ বালকদেরও স্কুল ছাড়তে পারি না৷ বললাম– ‘কাল অবধি তোমরা অপেক্ষা কর, তোমাদের প্রোমোশন দিয়ে আমি ক্লাসের আলাদা ব্যবস্থা করব৷’ …
কিন্তু, মাহার বালকটি আর স্কুলে ফিরে আসেনি৷ মনে হয়, সে একা সেখানে চরম অস্বস্তি অনুভব করছিল৷ আর ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য জাতের ছাত্ররা এবং অবশ্যই শিক্ষকরাও বালকটির সাথে একই রকম আচরণ করেছিল৷’’ এমনই ছিল তখনকার সমাজ৷
পরবর্তীকালে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা কীভাবে হিন্দু–মুসলিম–শিখ, উচ্চবর্ণ–নিম্নবর্ণ প্রভৃতি বিভেদকে কাজে লাগিয়ে তাদের শাসন ও শোষণকে দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছে, সেটা আলাদা আলোচ্য বিষয় হলেও এটা ঘটনা যে, গান্ধীজি সহ দেশের বেশিরভাগ জাতীয় নেতা স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এবং জাত–পাত মুক্ত গণতান্ত্রিক চেতনার উপর দাঁড় করাতে পারেননি৷ ধর্ম–বর্ণের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে এবং জাত–পাতের ভেদাভেদ মুছে দিতে যে সামাজিক–সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হত তা এড়িয়ে গিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন৷ নেতাজি, ভগৎ সিং সহ কিছু বরেণ্য বামপন্থী নেতা বহু দূর পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন জাত–ধর্মের ভেদাভেদ মুছে দিতে৷ কিন্তু তা সম্পন্ন করতে পারেননি৷ তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশের মানুষ বহু ক্ষেত্রে এক সঙ্গে লড়লেও ‘এক জাতি, এক প্রাণ’ হয়নি৷ তার মূল্য দেশকে আজও দিতে হচ্ছে৷
স্বাধীনতার সাত দশকেও দলিত তথা নিম্নবর্ণের মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন কিছু আসেনি৷ দারিদ্র আজও তাঁদের নিত্যসঙ্গী৷ বিজেপি শাসনে দলিতদের উপর রাজ্যে রাজ্যে উচ্চবর্ণের মানুষের অত্যাচার সমানে চলছে৷ এই অবস্থায় এই শোষণ–নিপীড়নের বিরুদ্ধে পাল্টা দলিত ঐক্য গড়ার কথা উঠে আসছে– যেমন উঠেছে ভিমা–কোরেগাঁওয়ের সভা থেকে৷ দলিতদের দীর্ঘদিনের অবমানিত মানসিকতার প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি জানিয়েই এ কথা বলা দরকার যে, দলিতদের উপর এই আক্রমণ আজ আর শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা উচ্চবর্ণের আক্রমণের আকারে নেই৷ এটি শ্রেণি বিভক্ত পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণির সামগ্রিক শোষণ প্রক্রিয়ার অঙ্গ৷ তাই সামগ্রিক ভাবে পুঁজিবাদী শোষণের অবসান না ঘটিয়ে, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ না করে, শুধুমাত্র দলিত ঐক্যের দ্বারা দলিত অংশের মানুষের এই দুরবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যাবে না৷ তা যদি হত তবে উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর নেতৃত্বে দলিত ঐক্যের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়েছিল, বিহারে লালুপ্রসাদের নেতৃত্বে যে সরকার তৈরি হয়েছিল তার দ্বারা সেখানকার দলিত মানুষের দুরবস্থার অবসান ঘটত৷ সকলেই জানেন, এই সব সরকারগুলি দলিত মানুষের জীবনে দুরবস্থার এতটুকুও পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি৷ সর্বহারা শোষিত মানুষের সার্বিক ঐক্যের বদলে তাঁদের জাত–পাত দিয়ে চিহ্ণিত করে জাতের বা সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার নামে বাস্তবে আজও তাঁদের প্রতারিত করা হচ্ছে৷ মহারাষ্ট্রে দলিত–মারাঠা দ্বন্দ্ব তারই নিকৃষ্ট জ্বলন্ত উদাহরণ৷ এতে দলিত বা মারাঠা জাতিভুক্ত সাধারণ মানুষের কোনও স্বার্থই রক্ষিত হবে না৷ বরং দেখা যাবে, দুই সম্প্রদায়েরই কিছু ভুঁইফোড় নেতা ‘উজির–নাজির’ হবে আর বলি হবে দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ গরিব মানুষ৷
ডঃ মৃদুল দাস
ঢাকুরিয়া, কলকাতা–৩১