পুজো কমিটিকে অনুদানের পিছনে শুধুই ভোটের হিসাব

এ বছর রাজ্য সরকার দুর্গাপুজো কমিটিগুলোর অনুদান বাড়িয়ে ৮৫ হাজার টাকা করে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে এও ঘোষণা করেছে যে, আগামী বছর এই অনুদান একেবারে এক লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। এখন প্রশ্ন হল, কোনও পুজো বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, সে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, যে ধর্মেরই হোক না কেন, তাতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সরকারি অর্থ অনুদান দেওয়া চলে কি? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূল কথা হল, সকল ধর্মের মানুষেরই নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী ব্যক্তিগত বা সামাজিক স্তরে উৎসব অনুষ্ঠান পালন করার স্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু সরকার কোনও ধর্মের অনুষ্ঠানেই উৎসাহ দেবে না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যায় উদ্বিগ্ন হয়ে গান্ধীবাদীদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতি হইতে বাদ দেওয়া উচিত। ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের বিষয় হওয়া উচিত। ব্যক্তি হিসাবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে তাহা অনুসরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে, কিন্তু ধর্মীয় বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়, ইহা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধির দ্বারা।’’ ভগৎ সিংও স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত থাকার মধ্যেই নাস্তিকতার সপক্ষে ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। অর্থাৎ এঁরা কেউই স্বাধীন ভারতের সরকার ঘটা করে বিভিন্ন ধর্মাচরণে অর্থ ব্যয় করবে এরকম কথা ভাবতেই পারেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্ন ছিল যে, স্বাধীন ভারতের সরকার কোটি কোটি নিরন্ন ভারতবাসীর অন্ন, বস্ত্র শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন যে, স্বাধীন ভারতের সরকারি কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন ধর্মের অনুষ্ঠানে উৎসাহদান এমনকি নিজেরা অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বদলে একটি বহুধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরে, ‘অমৃত মহোৎসবের’ কালে একচেটিয়া পুঁজির নির্মম শোষণের ফলে ভারত ক্ষুধা, দারিদ্রের নিরিখে পৃথিবীতে সর্বাধিক পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর অন্যতম হলেও, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলোর সে বিষয়ে কোনও হেলদোল নেই। তারা প্রবল উৎসাহে নানারকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অর্থহীন হুজুগে দরাজ হাতে টাকা ঢেলে চলেছে যাতে অসচেতন দেশবাসীর দৃষ্টি তাদের জীবনধারণের মূল সমস্যা থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।

কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একচেটিয়া পুঁজির সামগ্রিক স্বার্থে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েমের উদ্দেশ্যে ভারতকে একটি হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য মরিয়া হয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এই উদ্দেশ্যে শুধু রামমন্দির তৈরি নয়, নিত্যনতুন অজুহাতে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানো এবং মুসলমানদের কোণঠাসা করার চক্রান্ত করছে। শুধু তাই নয়, তারা এমনকি স্কুলস্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার গৈরিকীকরণের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধ কুসংস্কার, তমসাচ্ছন্ন মানসিকতা ও উগ্র হিন্দু ধর্মীয় উন্মাদনার ছাঁচে ফেলে গড়ে তুলতে চাইছে। এখন, পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু ঘটনাচক্রে বর্তমানে বিজেপি ভোটের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই, মুখ্যমন্ত্রী অন্যান্য বিষয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের তুমুল বিরোধিতায় গলা ফাটালেও, তাদের হিন্দু ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির বিরুদ্ধে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন না। পক্ষান্তরে, তিনি সুকৌশলে এ রাজ্যে হিন্দু স্বার্থরক্ষার ব্যাটনটি বিজেপির হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিজে ব্যবহার করতে চাইছেন। অর্থাৎ, তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের মধ্যেও যারা হিন্দু ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়ে বিজেপির দিকে ঢলছেন তাঁদের বার্তা দিতে চাইছেন যে, এ রাজ্যে হিন্দুদের স্বার্থও বিজেপির পরিবর্তে তিনিই রক্ষা করবেন। কাজেই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ববাদীরা যেন, তাঁকেই ভোট দেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির পাল্টা হিসেবে দীঘায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিশাল জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করছেন। দুর্গাপুজোয় অনুদানের পরিমাণও বছর বছর বাড়িয়ে যাচ্ছেন। হয়তো শিগগিরই কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজোতেও অনুদান দেবেন। এসব ব্যাপারে তাঁর টাকার অভাব হয় না। অথচ, রাজ্য সরকারি কর্মীদের ন্যায্য পাওনা অর্থ থেকে বঞ্চিত করে রাখবার জন্য তিনি সুপ্রিম কোর্টে লড়ে যাচ্ছেন এবং সে জন্য রাজ্য তহবিলের কোটি কোটি টাকাও খরচ হয়ে যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলগুলোর পরিকাঠামোর করুণ অবস্থার কথা সকলেই জানেন। সরকারি হাসপাতালগুলোরও অবস্থা একই রকম। জনবহুল রাস্তা থেকে হকারদের সরাতে হলে চাই তাঁদের উপযুক্ত পুনর্বাসন। অথচ এইসব বিষয়ে উদাসীন থেকে রাজ্য সরকার হিন্দুত্বের চ্যাম্পিয়ন সাজার সর্বনাশা খেলায় বিজেপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

দুর্গাপুজো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু বাঙালি সমাজের অত্যন্ত আবেগের ও আনন্দের উৎসব ঠিকই। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে এই উৎসব আয়োজন করাই বারোয়ারি পুজোর দীর্ঘদিনের প্রথা। যে সমিতির যেমন চাঁদা ওঠে তাঁরা তেমনই জাঁকজমকের আয়োজন করেন এবং সংশ্লিষ্ট পাড়া প্রতিবেশীরা তাতেই আনন্দ লাভ করেন। এই আয়োজনে অযাচিতভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া, রেড রোডে পুজোর কার্নিভাল অনুষ্ঠান করা রাজ্য সরকারের অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। এই অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, হকারদের পুনর্বাসন, ডেঙ্গু মোকাবিলা সহ অন্যান্য প্রয়োজনে খরচ করতে হবে– জনসাধারণের মধ্য থেকে এই দাবি তুলতে হবে। আশার কথা, আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে বহু পুজো কমিটি ইতিমধ্যেই সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান করার কথা জানিয়েছেন। পুজোর নামে ভোটের টোপ দেওয়ার বিরুদ্ধে উঠছে সচেতন প্রতিবাদ।