পুঁজিবাদী শোষণ উচ্ছেদের ডাক দিয়ে যায়ঃ মহান মে দিবস

একটি বিশেষ দিন কোনও এক মাসের নামে পরিচিতি পেয়েছে, সম্ভবত ‘মে দিবস’ ছাড়া অন্য নজির নেই। এই বিশেষ দিনটির সংগ্রামী তাৎপর্য আন্তর্জাতিকভাবে সর্বত্র শ্রমিক শ্রেণির কাছে আজও একই রকমভাবে উজ্জ্বল। আজ থেকে ১৩৬ বছর আগে ১৮৮৬ সালের ১-৪ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম মালিক শ্রেণির শোষণের ইমারতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। এর গুরুত্ব, এর আন্তর্জাতিক তাৎপর্য উপলব্ধি করে এই সংগ্রামের তিন বছর পর ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় সম্মেলন ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সেই সময় থেকে এই দিনটি গভীর মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।

মে দিবসের সংগ্রামের মূল দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস। এই দাবিতে শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলনের চেতনা একদিনে গড়ে ওঠেনি। শ্রমিকদের মধ্যে মালিকরা এই ধারণা গড়ে দিয়েছিল যে, মালিক কাজ দেয় বলেই শ্রমিক বেঁচে আছে। মালিকরা অন্নদাতা। মালিকদের কল্যাণ হলে তবেই শ্রমিকদের কল্যাণ, ফলে তাকে কোনও ভাবেই বিব্রত করা চলে না। এই ধারণা আজও একাংশ শ্রমিকের মধ্যে আছে। সেদিন তো আরও ব্যাপকভাবেই ছিল। তা সত্তে্বও মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অসন্তোষ, বিক্ষোভ চেপে রাখা যায়নি। তা মাঝে মাঝেই ফেটে পড়ত। এই ভ্রান্ত ধারণায় প্রথম আলো ফেলে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর লেখা ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’, মে দিবসের সংগ্রামের ৩৮ বছর আগে। ১৮৪৮ সালে লেখা এই কমিউনিস্ট ইস্তাহার মালিকের দ্বারা শ্রমিকের শোষণ স্পষ্ট করে দিয়েছিল এবং শ্রমিক শ্রেণির হাতে তুলে দিয়েছিল মুক্তির পথনির্দেশ। ঘোষণা করেছিল পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির ‘শৃঙ্খল ছাড়া’ হারাবার কিছু নেই, ‘জয় করবার জন্য আছে গোটা দুনিয়া’।

কাজের ঘণ্টা কমানোর দাবিতে, যতদূর জানা যায় প্রথম ধর্মঘট হয় ১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিয়ার জুতো কারখানায়। মে দিবসের সংগ্রামের ৮০ বছর আগের ঘটনা। এই সংগ্রাম ধীরে ধীরে গতি সঞ্চার করে। ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ইস্তাহার প্রকাশের পর থেকে দেশে দেশে ইউনিয়ন গঠন ও সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিনোদন, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এই আওয়াজ তোলে শ্রমিকরা।

কার্ল মার্কস ছিলেন শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির দিশারি। তাঁর চিন্তার গতিমুখই ছিল মালিকের শোষণের কবল থেকে শ্রমিকের মুক্তি। মে দিবসের সংগ্রামের ২০ বছর আগে ১৮৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর নেতৃত্বে প্রথম কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের জেনেভা কংগ্রেস প্রস্তাব গ্রহণ করে, বিশ্বের সমস্ত শ্রমিকদের কাজের সময় হবে ৮ ঘণ্টা। এই কংগ্রেস বিশ্বের দেশে দেশে এই দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়।

মে দিবস-এর সংগ্রামের পিছনে ‘প্যারি কমিউনের’ সংগ্রামেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। মে দিবসের সংগ্রামের ১৫ বছর আগে ১৮৭১ সালে ফ্রান্সের শ্রমিকরা বুর্জোয়া সরকারকে উৎখাত করে প্যারিস শহর দখল করে সেখানে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র কায়েম করেছিল, যা ইতিহাসে ‘প্যারি কমিউন’ নামে পরিচিত। সংগঠিত শ্রমিকদের শক্তি কী বিপুল, এই ঘটনা তা দেখিয়েছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও ফরাসি শ্রমিকরা ৭২ দিন সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েম রাখতে সফল হয়েছিল। বুর্জোয়া কায়েমি স্বার্থবাদীদের চক্রান্তে প্যারি কমিউন নামক শিশু রাষ্ট্রের পতন ঘটলেও এই ঘটনা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। নিজেদের শক্তি উপলব্ধি করে এবং এক একটি পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বলীয়ান হয়েছিল তারা। এর প্রভাব পড়েছিল দেশে দেশে। যার ফলে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।

১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে ৮ ঘণ্টাকেই শ্রম দিবস হিসাবে আইনত গণ্য করা হবে, এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, ১৮৮৪ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সংগঠিত ট্রেড ও লেবার ইউনিয়নগুলির ফেডারেশনের চতুর্থ সম্মেলনে, মে দিবসের সংগ্রামের দু’বছর আগে। কিন্তু নেতৃত্ব ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, এ দাবি সহজে আদায় হবে না। লড়াই হবে কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী। কেন এ দাবি সহজে আদায় হবে না? কারণ শ্রম সময় বেশি রাখাটা ছিল মালিকের মুনাফাবৃদ্ধির কৌশল। শ্রম সময় কমলে মুনাফা কমবে, তাই কোনও মালিকই তাতে রাজি হবে না। মালিককে বাধ্য করতে হলে আন্দোলনকে হতে হবে ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত, শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী। এই লক্ষ্যেই পারস্পরিক নানা বিরোধ সরিয়ে রেখে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে গড়ে উঠল সংগ্রামের হাতিয়ার ‘আট ঘণ্টা শ্রম সমিতি’।

১ মে আন্দোলন বহু জায়গাতে হলেও শিকাগোর আন্দোলনই তীব্র রূপ নিয়েছিল। কারণ এটিই ছিল বামপন্থী আন্দোলনের কেন্দ্র। নেতৃত্বের আহ্বানে সর্বস্তরের মানুষ–ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট, ইহুদি, গণতন্ত্রী, প্রজাতন্ত্রী, অ্যানার্কিস্ট, সোসালিস্ট, কমিউনিস্ট সহ বিভিন্ন মতাবলম্বী শ্রমিকরা এতে সামিল হয়েছিলেন। ৮ ঘণ্টা শ্রমসময়ের দাবিতে স্ত্রী-পুরুষ, যুবক-প্রবীণ, নিগ্রো-শ্বেতকায়, স্থানীয়-প্রবাসী, সংগঠিত-অসংগঠিত সকল অংশের শ্রমিকেরাই অংশগ্রহণ করেছিলেন ১ মে-র মিছিলে। বাস্তবে এভাবে গণ অংশগ্রহণ ছাড়া আন্দোলনের সাফল্য খুবই কঠিন।

৩ মে-র সমাবেশে গুলি চালায় মার্কিন সরকারের পুলিশ। ৬ জন শ্রমিক মারা যান। উত্তাল শ্রমিক আন্দোলন রুখতে ষড়যন্ত্রমূলক পথ নেয় মালিক শ্রেণির স্বার্থবাহী পুলিশ। ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিক সমাবেশে পুলিশের উপর বোমা ছুঁড়ে পুলিশেরই এক এজেন্ট এবং তাকে ভিত্তি করে শ্রমিকদের উপর হামলা, মিথ্যা মামলা এবং শেষে বিচারের প্রহসন ঘটিয়ে আন্দোলনকারী নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। আন্দোলনে নেমে আসে এক বিরাট আঘাত।

এই ঘটনায় ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেন আগস্ট স্পাইস। আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে বিচারকের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘মাননীয় মহোদয়, … যদি মনে করেন আমাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে পদদলিত করতে পারবেন … তবে দিন আমাদের ফাঁসি। … কিন্তু মনে রাখবেন, আপনাদের সামনে এখানে সেখানে সর্বত্র জ্বলে উঠবে লকলকে অগ্নিশিখা। এ হল মাটির তলার আগুন। এ আগুন নিভিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আপনাদের নেই। পৃথিবীর গভীরে জ্বলতে থাকা এ আগুন আপনারা নিভিয়ে দিতে পারবেন না।’

আদালতে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বৈজ্ঞানিক বিচার-পদ্ধতি অনুকরণ করে আমরা অবিসংবাদিত রূপে এই সত্য প্রমাণ করেছি যে, বর্তমান সামাজিক অসাম্যের উৎসই হল মজুরি ব্যবস্থা। …আমরা এ কথাও বলেছিলাম যে, সমাজ প্রগতির যৌক্তিক প্রয়োজনে এই মজুরি ব্যবস্থাকে উন্নততর সভ্যতার জন্য পথ ছেড়ে দাঁড়াতে হবে। শুধু তাই নয়, মজুরি ব্যবস্থাই পথ করে দেবে নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপনের জন্য। সমাজ ব্যবস্থা চলবে সহযোগিতার ভিত্তিতে–তার নাম সমাজতন্ত্র।’

মে দিবসের সংগ্রামের চার বছর পর ১৮৯০ সালে মার্ক্সের সহযোদ্ধা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস গভীর প্রত্যয়ের সাথে লিখেছেন, ইতিহাসে এই প্রথম শ্রমিক শ্রেণি একটি সৈন্যবাহিনী হিসাবে, একই পতাকাতলে একটিমাত্র লক্ষ্য পূরণের জন্য সংগ্রাম করছে। সেই লক্ষ্য হল ৮ ঘন্টা কাজের দিনকে আইনের স্বীকৃতির উপর প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এঙ্গেলসের আক্ষেপ, এই আনন্দের মুহূর্তে কার্ল মার্ক্স নেই, যিনি মে দিবসের সংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা। ১৮৮৩ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

আজ বাম-ডান কত শ্রমিক সংগঠনই তো মে দিবস পালন করে। কিন্তু মে দিবসের শহিদের এই আবেদনের মূল্য দেয় ক’জন? এই উপলব্ধি জনিত ঘাটতি এবং শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রাম দুর্বল থাকায় মালিকরা আজ বেপরোয়া। শ্রমিকদের অধিকারগুলি এক এক করে হরণ করছে তারা। বহু সংগ্রামের এবং আত্মদানের মধ্য দিয়ে ‘মে দিবস’-এর যে গৌরবময় অর্জন– মালিকরা তা নস্যাৎ করে দিয়েছে। আজ আবারও ১২ ঘণ্টা/১৪ ঘণ্টা করে শ্রমিকদের খাটানো শুরু হয়েছে। ‘মে দিবসে’র অর্জিত অধিকারগুলি লুট হয়ে গেছে শুধু এ দেশে নয়, সব পুঁজিবাদী দেশেই। লেনিন-স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র শ্রমদিবস ৮ ঘণ্টার থেকে কমিয়ে আনা শুরু করেছিল।

১৯২৬ সালে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় কাজের দৈনিক সময় কমিয়ে করা হয় সাড়ে সাত ঘন্টা। ১৯২৯ সালে ঘোষণা করা হয় সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করতে হবে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ঘোষণা করেছিল সবাইকে সাদ্যানুযায়ী কাজ করতে হবে এবং উপযুক্ত কাজ দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। শ্রমিকদের এখানে এত অধিকার ছিল যে, বেতন কাঠামো কী হবে, কর্তৃপক্ষের সাথে সেই বৈঠকে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক শ্রমিক অংশগ্রহণ করত। এই সমাজতন্ত্র শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করেছিল। নর-নারীর বেতন বৈষম্য দূর করেছিল। এই সমাজতন্ত্রেই মানুষ মুক্তির স্বাদ পাচ্ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্র ও দেশের মধ্যে পরাজিত পুঁজিবাদ এবং মার্ক্সবাদ বিচ্যুত সংশোধনবাদ সমাজতন্ত্রকে ভেঙে দিয়েছে। পুঁজিবাদী রাশিয়া শ্রমিক শ্রেণির পায়ে আবার পরিয়েছে মজুরি দাসত্বের শৃঙ্খল। পুঁজিবাদী রাশিয়া এখন সাম্রাজ্যবাদী রূপ ধারণ করে ইউক্রেনে দু’মাসের বেশি সময় ধরে স্থল ও আকাশ পথে হামলা চালিয়ে দেশটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আজ ইউক্রেন, রাশিয়া সহ গোটা বিশ্বের মানুষ উপলব্ধি করছেন শান্তির জন্য সমাজতন্ত্র কত জরুরি।

‘দুনিয়ার শ্রমিক এক হও’, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের স্লোগান। কেন এক হবে দুনিয়ার শ্রমিক? কারণ, সব দেশের শ্রমিকই মালিকি শোষণের কারাগারে বন্দি। এই শোষণ মুক্তির সংগ্রামে তারা একে অপরের বন্ধু। মে দিবসের সংগ্রামে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি প্রধানত থাকলেও এর মধ্যে নিহিত ছিল পুঁজিবাদ উচ্ছেদের মর্মবস্তু। যা আগস্ট স্পাইসের আদালতে পেশ করা বত্তৃতায় প্রতিফলিত। মে দিবস পালন করব আবার মালিকি ব্যবস্থা রক্ষা করব বা যে সমস্ত দল পুঁজিবাদকে সেবা করে চলেছে তাদের পতাকা বহন করব–এটা দ্বি-চারিতা। শ্রমিক আন্দোলনকে এর প্রভাব থেকে মুক্ত করার মধ্যেই রয়েছে মে দিবস উদযাপনের যথার্থ তাৎপর্য।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৯ এপ্রিল ২০২২