পুঁজিবাদী উৎপাদন ও মুনাফা

 

 

 

স্বাভাবিক পণ্য উৎপাদন ও পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদনের মূল পার্থক্য হল— স্বাভাবিক পণ্য উৎপাদনের মূল প্রেরণা ‘ভোগ’ এবং পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদনের মূল প্রেরণা ‘মুনাফা’৷

স্বাভাবিক পণ্য উৎপাদনের যুগে নিজস্ব উৎপাদনের উপাদানের উপর উৎপাদনকারী বা তার নিযুক্ত ব্যক্তি শ্রম করে বিভিন্ন দ্রব্য উৎপন্ন করত৷ নিজের ভোগের পর উৎপন্ন দ্রব্যের উদ্বৃত্ত অংশ পণ্য হিসাবে অন্য উৎপাদনকারীর পণ্যের সঙ্গে বিনিময় করত৷ অন্যভাবে বললে, নিজের উৎপন্ন দ্রব্যের উদ্বৃত্ত অংশ পণ্য হিসাবে বিক্রয় করে মুদ্রা সংগ্রহ করত এবং সেই মুদ্রা দিয়ে অন্য উৎপাদনকারীর পণ্য ক্রয় করত৷ তাই সেই ব্যবস্থায় পণ্য সঞ্চালনের ধারা ছিল– পণ্য ‘ক’  →মুদ্রা পণ্য → ‘খ’৷

কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পন্য সঞ্চালনের ধারাটি হল : মুদ্রা→পণ্য→বাড়তি মুদ্রা৷ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এর অর্থ দাঁড়ায়– পুঁজিপতি মুদ্রা রূপ পুঁজির বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করে৷ সেই পণ্যগুলির সংমিশ্রণে যে পণ্য উৎপন্ন হয়, তা বিক্রয় করে পুঁজিপতি মূল–পুঁজির সমান মুদ্রা–মূল্য তো ফিরে পায়ই, উপরন্তু বাড়তি কিছু মূল্যও পায়৷ এই বাড়তি মুদ্রা–মূল্যকেই আমরা বলব উদ্বৃত্ত মূল্য৷ এই উদ্বৃত্ত মূল্যই পুঁজিপতির মুনাফার উৎস৷ আর এই মুনাফা লাভ করাই হল পুঁজিবাদী উৎপাদনের মূল প্রেরণা৷

উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপত্তিস্থল কোথায়

পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থাটিকে মূলত তিনটি প্রক্রিয়ায় ভাগ করা যায়৷ (১) পুঁজির বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করা বা পণ্য–ক্রয় প্রক্রিয়া, (২) উৎপাদন প্রক্রিয়া, (৩) উৎপন্ন পণ্যের বিনিময়ে মুদ্রা সংগ্রহ করা বা পণ্য–বিক্রয় প্রক্রিয়া৷ স্বভাবতই মনে হতে পারে উপরোক্ত প্রক্রিয়াগুলির যে কোনও একটিতে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপন্ন হয়৷

বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা আমাদের বোঝাতে চান যে, পণ্য ক্রয়–বিক্রয়ের মধ্যে মুনাফার উৎপত্তি হয়৷ তাঁরা আমাদের বিশ্বাস করতে বলেন যে, পুঁজিপতি কম দামে পণ্য ক্রয় করে এবং সেই পণ্য পরে বেশি দামে বিক্রয় করতে পারে বলেই তার মুনাফা হয়৷

কিন্তু এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ অবাস্তব৷ আমরা জানি, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণিই সমস্ত পণ্যের উৎপাদক৷ সুতরাং এখানে পুঁজিপতি শ্রেণিই সমস্ত পণ্যের মালিক৷ এ অবস্থায় গোটা পুঁজিপতি শ্রেণিকে ধরে বিচার করলে কোনও একজন পুঁজিপতির লাভ হওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, অন্য পুঁজিপতির ক্ষতি হওয়া৷ সুতরাং, একের লাভ ও অপরের ক্ষতিতে কাটাকাটি হয়ে কোনও সাধারণ লাভই থাকতে পারে না৷

নিচের উদাহরণ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হবে৷ ধরা যাক, কোনও এক সমাজে তিন জন পুঁজিপতি আছে৷ তাদের নাম রাম, শ্যাম ও রহিম৷ আরও মনে করা যাক যে, তাদের প্রত্যেকেই নিজের পণ্য শতকরা ১০ টাকা লাভে বিক্রয় করে৷

যেহেতু তারা একই সমাজের অধিবাসী, তারা পরস্পরের পণ্য অবশ্যই ক্রয় করবে৷ ধরুন,  রাম তার ১০০ টাকা মূল্যের পণ্য শ্যামকে বিক্রয় করে ১১০ টাকায়৷ সুতরাং বিক্রেতা হিসাবে রামের মুনাফা হয় ১০ টাকা, আর ক্রেতা হিসাবে শ্যামের ক্ষতি হয় ১০ টাকা৷ আবার শ্যাম যখন ১০০ টাকা মূল্যের পণ্য রহিমকে ১১০ টাকায় বিক্রয় করে তখন বিক্রেতা হিসাবে শ্যামের ১০ টাকা লাভ হয়, অথচ ক্রেতা হিসাবে রহিমের ১০ টাকা ক্ষতি হয়৷ আবার আমাদের প্রস্তাব মতো রাম অবশ্যই রহিমের পণ্য ক্রয় করবে৷ আর বাস্তব ক্ষেত্রে তাই ঘটে৷ কারণ যদি কেউ বলে যে, আমি কেবল পণ্য বিক্রয়ই করব, কখনও পণ্য ক্রয় করব না, তবে তা হবে সম্পূর্ণ অবাস্তব৷ তাই রাম ১১০ টাকা দিয়ে রহিমের ১০০ টাকা মূল্যের পণ্য ক্রয় করবে৷ এতে রহিমের মুনাফা হবে ১০ টাকা, আর রামের ক্ষতি হবে ১০ টাকা৷

এইবার তিন জনের বিকিকিনির মোট ফল কী দাঁড়াল? বিক্রেতা হিসাবে প্রত্যেকেরই ১০ টাকা করে মুনাফা হলেও ক্রেতা হিসাবে ১০ টাকা করে ক্ষতি হয়েছে৷ মোটের উপর কোনও সাধারণ লাভ ক্ষতি রইল না৷

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ‘ক্রয়–বিক্রয়ের মধ্যেই মুনাফার উৎপত্তি হয়’–বুর্জোয়া পণ্ডিতদের এই তত্ত্বটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন৷ সুতরাং পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার উপরোক্ত প্রথম ও তৃতীয় প্রক্রিয়ার কোনওটিতেই মুনাফার উৎপত্তি হয় না৷

বাকি থাকে দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি, অর্থাৎ পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া৷ এইবার পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াটি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা যাক৷

পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া

পুঁজিপতি শ্রেণির নির্দেশ মতো উৎপাদন এবং আদিম যুগ থেকে আরম্ভ করে সামন্ত যুগের উৎপাদনের মধ্যে প্রক্রিয়া গত কোনও পার্থক্য নেই৷ উৎপাদন প্রক্রিয়ার মূল উপাদান দু’টি— প্রকৃতি ও মানুষ৷ অবশ্য মানুষও প্রকৃতিরই একটি অংশ৷ তবে তা হল প্রকৃতির সবচেয়ে সচেতন ও সক্রিয় অংশ৷ প্রকৃতির এই সচেতন অংশ মানুষ, প্রকৃতির বাকি অংশের উপর নিজের শ্রম প্রয়োগ করে ৷ শ্রম প্রয়োগ করে মানুষ প্রকৃতির বস্তু ও শক্তিতে ব্যবহার–মূল্য সৃষ্টি করে৷ আর সেই ব্যবহার–মূল্য মানুষের কোনও না কোনও প্রয়োজন মেটায়৷

মানুষ কিন্তু শ্রম শুরু করার আগেই মনে মনে ঠিক করে নেয়, কী সে করবে৷ একেই বলা হয় পরিকল্পনা৷ শ্রম করার সময় মানুষ তার হাত, পা, মাথা খাটায়৷ আর এদের সাহায্যে শ্রম করে পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করে৷ এইখানেই মানুষ ও অন্যান্য পশুপাখির মধ্যে প্রধান পার্থক্য৷

‘‘শ্রম–প্রক্রিয়ার মৌলিক উপাদানগুলি হল– (১) মানুষের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড অর্থাৎ কাজ, (২) যে বিষয়ের উপর কাজ প্রয়োগ করা হয় এবং (৩) কাজের যন্ত্রপাতি’’৷ (মার্কস, ক্যাপিটাল)

প্রকৃতি কখনওই তার অস্তিত্বের জন্য মানুষের উপর নির্ভরশীল নয়৷ বরং প্রকৃতিই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সব কিছু জোগান দেয়৷ এই প্রকৃতিই হল কাজের বিষয়৷ মানুষ এই প্রকৃতির উপরই তার কাজ বা শ্রম প্রয়োগ করে৷ যেমন, চাষের জমি কাজের বিষয়, সেই জমির উপর শ্রম প্রয়োগ করে মানুষ চাষ–বাস করে, তবে ফসল হয়৷

শ্রমের বিষয় ও শ্রমিকের মাঝখানে থাকে শ্রমের যন্ত্রপাতি৷ শ্রমের যন্ত্রের মধ্য দিয়ে শ্রমিকের শ্রম তার শ্রমের  বিষয়ে পরিচালিত হয়৷ শ্রমিক বিভিন্ন জিনিসের যান্ত্রিক, জৈবিক ও রাসায়নিক শক্তি ব্যবহার করে তার শ্রমের বিষয়টিকে নিজের উদ্দেশ্য মতো পরিবর্তন করে৷ প্রথম দিকে মানুষ কেবলমাত্র তার অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ দ্বারাই ফল–মূল সংগ্রহ করত৷ সেই অবস্থার কথা বাদ দিলে, মানুষ প্রথম যা জোগাড় করেছিল তা হল, শ্রমের যন্ত্রপাতি, শ্রমের বিষয় নয়৷ সেই যন্ত্রও সে প্রথম দিকে প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করেছে৷

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উঁচু গাছ থেকে ফল পাড়ার জন্য মানুষ প্রকৃতি থেকে গাছের ডাল ভেঙে নেয়৷ সেই ডাল তখন কাজ করে ফল পাড়ার যন্ত্র হিসাবে৷ আর এমনি করে সে তার নিজের প্রকৃতিতেও পরিবর্তন আনে৷ গাছের উঁচু ডাল থেকে ফল পাড়তে গিয়ে সে দেখতে পেয়েছে তার হাত প্রয়োজনের তুলনায় খাটো৷ তাই ডালের সাহায্য নিয়ে সে তার হাতের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে নিয়েছে৷ সুতরাং প্রকৃতিই হল মানুষের যন্ত্রপাতির আদিম জোগানস্থল৷

আমরা দেখি, একটা লম্বা ডালের এক প্রান্তে আর একটি ছোট ডাল বেঁধে নিয়ে তৈরি হয় আঁকশি৷ আঁকশি, লাঠির চেয়ে উন্নত ধরনের যন্ত্র৷ আর তা তৈরি হল প্রকৃতির উপর বার বার পরিকল্পিত শ্রম প্রয়োগ করে৷ এমনিভাবে বিচার করে দেখলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, সমস্ত যন্ত্রপাতিই প্রকৃতির উপর মানুষের পর্যায়ক্রমিক শ্রমের অর্থাৎ পুঞ্জীভূত বা সঞ্চিত–অতীত শ্রম৷ সুতরাং, যন্ত্র দ্বারা উৎপন্ন–দ্রব্যের মূল্য নির্ণয় করার সময় আমাদের এই কথাটি মনে রাখতে হবে৷

উৎপাদনের কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমরা সোজাসুজি প্রকৃতিকে কাজের বিষয় হিসাবে গ্রহণ করি না৷ প্রকৃতির উপর মানুষ পূর্বে শ্রম করে যে জিনিস তৈরি করেছে, তাকে সঙ্গে সঙ্গে ভোগ্যদ্রব্য হিসাবে ভোগ না করে তাকে কাজের বিষয় হিসাবেও ব্যবহার করা হয়৷ যেমন চাষি প্রকৃতির জমির উপর কাজ করে তুলো, ধান বা আখ উৎপন্ন করেছে৷ এইবার তাঁতি তুলোকে শ্রমের বিষয় করে সুতো তৈরি করতে পারে, কাপড় বুনতে পারে৷ ময়রা ধানকে শ্রমের বিষয় করে খই তৈরি করতে পারে, মুড়কি তৈরি করতে পারে৷ চাষি আখকে তখন–তখনই খেয়ে না ফেলে তা থেকে রস নিঙড়ে তা জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করতে পারে৷ তখন আমরা তুলো, ধান ও আখকে বলি কাঁচা মাল৷ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কাঁচা মাল প্রকৃতির উপর মানুষের অতীত শ্রমের ফল, অর্থাৎ, পুঞ্জীভূত বা সঞ্চিত অতীত শ্রম৷ তবে শ্রমযন্ত্র ও কাঁচা মালের মধ্যে মূল পার্থক্য হল– কাঁচা মাল হচ্ছে শ্রমের বিষয়, আর যন্ত্র হল সেই বিষয়ে শ্রম প্রয়োগ করার হাতিয়ার৷

তাই বলে, এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, এই–এই জিনিস কাঁচা মাল, এই–এই জিনিস ভোগ্যদ্রব্য–এমনি ভাবে ভাগ করা যায়৷ একই জিনিস ব্যবহার ভেদে কখনও ভোগ্যদ্রব্য, কখনও কাঁচা মাল হতে পারে৷ যেমন, আখকে যখন আমরা সোজাসুজি খেয়ে ফেলি, তখন তা হয় ভোগ্য দ্রব্য৷ আবার যখন তা থেকে রস নিয়ে গুড় তৈরি করা হয়, তখন সেই আখই হয়ে পড়ে কাঁচা মাল৷ তা ছাড়া একই জিনিস আবার নানা প্রকার ভোগ্যদ্রব্য তৈরির কাঁচা মাল হিসাবে ব্যবহূত হতে পারে৷ যেমন, ভাত, মুড়ি প্রভৃতির অনেক কিছু ভোগ্যদ্রব্য তৈরির কাঁচা মাল হল চাল৷ 

সব কাঁচা মালই তা হলে পূর্বে কোনও এক বা একাধিক সময়ে মানুষ শ্রম করে তৈরি করেছে৷ সুতরাং কাঁচা মাল মূলত প্রকৃতির উপর মানুষের অতীত শ্রমের ফল, অর্থাৎ পুঞ্জীভূত অতীত শ্রম৷ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক কাঁচা মালকে শ্রমের বিষয় হিসাবে নিয়ে তার উপর শ্রম প্রয়োগ করে৷ কাঁচা মালের ব্যবহার–মূল্যকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান শ্রমিক তার বর্তমান শ্রম দ্বারা তাতে নতুন ব্যবহার–মূল্য সৃষ্টি করে৷ কাঁচা মালে যতটুকু অতীত শ্রম সঞ্চিত আছে সেটাই তার মূল্য৷ আর এই মূল্যের উপর নতুন শ্রম প্রয়োগ করে যে নতুন দ্রব্য তৈরি হয়, তার মূল্য কাঁচা মালের মূল্যের চেয়ে বেশি হয়৷ এমনিভাবে মানুষের শ্রম তার উৎপন্ন দ্রব্যে মূল্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে৷

সুতরাং কাঁচা মাল, যন্ত্রপাতি ও শ্রমিকের বর্তমান শ্রম— এই তিনের মিশ্রণে যে–দ্রব্য উৎপন্ন হয়, তা মূলত সমস্তটাই  মানুষের শ্রমের ফল৷ নতুন দ্রব্যের যে মূল্য তা হল— কাঁচা মালের মূল্য+শ্রম–যন্ত্রের মূল্য+বর্তমান শ্রমিকের শ্রমে সৃষ্ট মূল্য৷ প্রথম দু’টি হল সঞ্চিত অতীত শ্রম, আর তৃতীয়টি হল নতুন প্রাণবন্ত শ্রম৷ সুতরাং সমস্তটাই মানুষের শ্রমের ফসল৷

এইবার আমরা দেখব, নতুন দ্রব্যের মূল্যে এই তিনটি অংশের কোনটির কী পরিমাণ থাকে৷ প্রথমত, যদি দেখা যায় যে, কোনও একটি দ্রব্য তৈরি করতে কাঁচা মালের সবটাই শেষ হয়ে গেছে, তবে কাঁচা মালের গোটা মূল্যই নতুন দ্রব্যটির মূল্যে উপস্থিত থাকবে৷ কিন্তু যদি কাঁচা মালের একটি অংশ মাত্র নতুন দ্রব্যটি তৈরি করতে ব্যয় হয়, তবে নতুন দ্রব্যের মূল্যে কাঁচা মালের মূল্যের হারা হারি অংশই মাত্র থাকবে৷

দ্বিতীয়ত, শ্রমযন্ত্র সাধারণত একটি মাত্র দ্রব্য তৈরি করে শেষ হয়ে যায় না৷ সাধারণত বছরের পর বছর অনেক দ্রব্য তৈরি করে তবে তার আয়ু শেষ হয়৷ সুতরাং শ্রমযন্ত্রের তৈরি প্রতিটি দ্রব্যের মূল্যে শ্রমযন্ত্রের মূল্যের হারা হারি অংশই মাত্র থাকবে৷

তৃতীয়ত, বর্তমান শ্রমিকের ব্যাপারটি দেখা যাক৷ একটি দ্রব্য তৈরি করতে বর্তমান শ্রমিক শ্রমযন্ত্রের সাহায্যে কাঁচামালের উপর যতটুকু শ্রম প্রয়োগ করে, তার সবটাই নতুন দ্রব্যে আত্মপ্রকাশ করে৷ সুতরাং বর্তমান শ্রমিক নতুন দ্রব্যটি যতক্ষণ ধরে তৈরি করে, ততক্ষণে সামাজিক নির্বিশেষ শ্রমের মূল্যের সবটাই নতুন দ্রব্যের মূল্যে উপস্থিত হয়৷ তাই দেখা যাচ্ছে–

নতুন দ্রব্যের মূল্য=কাঁচা মালের হারা হারি মূল্য (সঞ্চিত অতীত শ্রমের হারা হারি অংশ)+শ্রম যন্ত্রের হারা হারি মূল্য (সঞ্চিত অতীত শ্রমের হারা হারি অংশ)+বর্তমান শ্রমে সৃষ্ট নতুন মূল্য৷

ধরা যাক, এক কেজি সুতো থেকে একজন তাঁতি এক জোড়া ধুতি তৈরি করল৷ আরও মনে করা যাক, এক কেজি সুতোতে ৩০ ঘন্টার অতীত শ্রম সঞ্চিত রয়েছে৷ এক জোড়া ধুতি তৈরি করতে তাঁত ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির মধ্যে সঞ্চিত অতীত–শ্রমের ৮ ঘন্টার শ্রম ক্ষয় হয়, এবং এক জোড়া ধুতি বুনতে তাঁতি ১০ ঘন্টার সামাজিক নির্বিশেষ শ্র ব্যয় করে৷ এ অবস্থায়–

১ জোড়া ধুতির মূল্য=৩০ ঘন্টার অতীত শ্রম+৮ ঘন্টার অতীত শ্রম+১০ ঘন্টার নতুন শ্রম=৪৮ ঘন্টার শ্রম৷

এখন, প্রতি ঘন্টা শ্রমের মূল্যকে যদি ৫০ পয়সা দ্বারা প্রকাশ করা যায়, তবে ধুতি জোড়ার মূল্য দাঁড়াবে (৪৮×০.৫০)টাকা=২৪ টাকা৷

পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার এই মৌলিক শর্তগুলি আদিম যুগের উৎপাদন ব্যবস্থায় যেমন সত্য ছিল, বর্তমান উন্নত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার যুগেও তেমনি সত্য৷

আমরা পূর্বেই দেখেছি, বিকিকিনি বা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয় না৷ এইবার আমরা দেখতে পাব পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নতুন মূল্য সৃষ্টি হয় বটে, তবে সেই মূল্য কখনওই উদ্বৃত্ত মূল্য নয়৷

মনে করা যাক, একজন মুচি ১০ টাকা মূল্যের চামড়ার উপর এক রোজ শ্রম করে এক জোড়া জুতো তৈরি করল৷ আরও মনে করা যাক, এক জোড়া জুতো তৈরি করতে ১ টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি ক্ষয় হয়৷ জুতোর মূল্য নিশ্চয়ই চামড়ার মূল্যের চেয়ে বেশি হবে৷ মনে করা যাক, জুতো জোড়ার মূল্য হল ১৬ টাকা, এই নতুন মূল্যের মধ্যে আছে চামড়ার (কাঁচা মাল) মূল্য=১০ টাকা, যন্ত্রপাতির (ক্ষয়–ক্ষতির হারা হারি অংশ) মূল্য=  ১ টাকা, আর মুচিব একরোজের শ্রমের মূল্য৷ সুতরাং মুচির এক রোজের শ্রম যে মূল্য সৃষ্টি করল, তা হল ১৬– (১০+১)টাকা=৫টাকা৷ মুচির শ্রম যে মূল্য সৃষ্টি করল, তা নিশ্চয়ই নতুন, কারণ মুচির এক রোজের শ্রমেই এই মূল্য সৃষ্টি হয়েছে৷ কিন্তু তা কখনওই উদ্বৃত্ত মূল্য নয়৷

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যেমন বিনিময় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হতে পারে না, তেমনি পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয় না৷

উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয় কীভাবে

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পণ্য সঞ্চালনের ধারাটি হল মূদ্রা→পণ্য→বাড়তি মুদ্রা৷ এর অর্থ হল, পুঁজিপতি মুদ্রা রূপ পুঁজি খরচ করে পণ্য ক্রয় করে এবং পরে সেই পণ্য বিক্রয় করে মুদ্রা রূপ পুঁজি ফিরে পায়৷ আবার যেহেতু পুঁজিবাদী পণ্য সঞ্চালনের মূল প্রেরণাই হল মুনাফা, সুতরাং ‘বাড়তি মুদ্রা’ অবশ্যই ‘মুদ্রা’–এর চেয়ে বড় হয় এবং বাড়তি মুদ্রাকেই আমরা বলি উদ্বৃত্ত মূল্য, যা পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার উৎস৷ সুতরাং, উদ্বৃত্ত মূল্য তথা মুনাফা সৃষ্টি করেই মুদ্রা পুঁজিতে পরিণত হতে পারে৷ কিন্তু মুদ্রা হিসাবে মুদ্রার মধ্যে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়৷ কারণ, বিনিময় হয় সব সময় সমান সমান মূল্যের মধ্যে এবং মুদ্রা শুধু সমান সমান মূল্যের  বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে৷

পণ্য সঞ্চালনের ধারায় ‘মুদ্রা→পণ্য’ এই ধাপটিতে পুঁজিপতি যখন মুদ্রার বিনিময়ে পণ্য সংগ্রহ করে তখন মুদ্রা হিসাবে পুঁজিপতি যতটুকু মূল্য দিয়ে দেয় পণ্য হিসাবে ততটুকু মূল্য ফিরে পায়৷ সুতরাং এখানে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই৷ আবার পণ্য সঞ্চালনের ‘পণ্য→বাড়তি মুদ্রা’— এই ধাপটিতে পুঁজিপতি পণ্য হিসাবে যে মূল্য দিয়ে দেয়, মুদ্রা হিসাবে তা ফিরে পায়৷ সুতরাং, এখানেও উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হতে পারে না৷

এই অবস্থায় উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির ঘটনাটিকে একমাত্র তখনই ব্যাখ্যা করা যায়, যখন পণ্য সঞ্চালনের প্রথম ধাপে মুদ্রার বিনিময়ে পুঁজিপতি যে সকল পণ্য ক্রয় করে, দ্বিতীয় ধাপে তা বিক্রয় করার আগেই সেইসব পণ্যের মধ্যে বা তাদের কোনও একটি অংশের মধ্যে মূল্য যুক্ত হয়৷ কারণ, একমাত্র তখনই পণ্য বিক্রয় করে পুঁজিপতি উদ্বৃত্ত মূল্য পেতে পারে৷ সুতরাং পুঁজিপতিকে এমন একটি পণ্য ক্রয় করতে হবে, যার ভোগ বা প্রয়োগের মধ্যেই মূল্যযুক্ত হবে৷ আবার আমরা জানি যে, একমাত্র মানুষের শ্রমই মূল্য সৃষ্টি করে৷ তাই পণ্যটি অবশ্যই এমন হবে, যার ভোগ বা প্রয়োগই হল শ্রম, অর্থাৎ পণ্যটি হবে ‘শ্রম করার ক্ষমতা’ বা ‘শ্রমশক্তি’৷ আর শ্রমিকের রয়েছে ‘শ্রম করার ক্ষমতা’৷ সুতরাং, পণ্যটি হবে ‘শ্রমিকের শ্রমশক্তি’৷ একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে৷ পুঁজিবাদী পণ্য সঞ্চালনের সাধারণ ধারা  ‘মুদ্রা→পণ্য→বাড়তি মুদ্রা’–কে উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে নিম্নরূপে বিস্তৃত করা যায়—মু→ প→ প´→মু´ (মুদ্রা→পণ্য→নতুন পণ্য→বাড়তি মুদ্রা)৷ আবার তাকে নিম্নরূপ তিনটি ধাপে বিভক্ত করা যায়, (১) মু→ প,  (২)প→প´  (৩)প´→মু´

ধাপ তিনটির বাস্তব ব্যাখ্যা এই যে— (১) প্রথম ধাপে (অর্থাৎ মু→প) পুঁজিপতি মুদ্রা রূপ পুঁজির  বিনিময়ে যন্ত্রপাতি, কাঁচা মাল, শ্রমিকের শ্রমশক্তি ইত্যাদি উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপাদান পণ্য হিসাবে সংগ্রহ করে৷ যেহেতু বিনিময় হয় সমান–সমান মূল্যে, তাই যন্ত্রপাতি ও কাঁচা মাল ইত্যাদি পণ্যের জন্য পুঁজিপতি তাদের মূল্যের, অর্থাৎ উৎপাদন–ব্যয়ের সমান মূল্য দিয়ে তাদের সংগ্রহ করে৷ তেমনি শ্রমিকের শ্রমশক্তিরূপ পণ্যের বিনিময়ে শ্রমিককে যে মজুরি দেয়, তা তার শ্রমশক্তিরূপ পণ্যের উৎপাদন–ব্যয় বা মূল্যের সমান হয়।সতরাং মনে রাখতে হবে যে, শ্রমিকের মজুরি তার শ্রমশক্তিরূপ পণ্যের দাম, তার শ্রমের দাম নয়৷

(২) দ্বিতীয় ধাপে (প→প´) পুঁজিপতি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল দিয়ে শ্রমিককে উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত করে৷ যন্ত্রপাতির সাহায্যে শ্রমিক কাঁচা মালের উপর তার শ্রমশক্তি প্রয়োগ করে, ফলে নতুন পণ্য উৎপন্ন হয়৷ নতুন পণ্যে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল ইত্যাদির হারাহারি মূল্য ফিরে এলেও, বর্তমান শ্রমিক তার শ্রমশক্তি খাটিয়ে যে শ্রম করে, তার ফলে পণ্যে নতুন–মূল্য সংযোজিত হয়৷ বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, পুঁজিপতি শ্রমিককে তার শ্রমশক্তির মূল্য হিসাবে যে পরিমাণ মজুরি মূল্য দেয়, শ্রমিক শ্রম করে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে৷ সুতরাং নতুন পণ্য ‘প’–এর মূল্য সবসময়েই ‘প’–এর মূল্যের চেয়ে বেশি হয়৷

(৩) তৃতীয় ধাপে (অর্থাৎ প´→মু´ ) পুঁজিপতি নতুন পণ্য বিক্রয় করে মুদ্রা রূপ পুঁজি ফিরে পায়৷ যেহেতু ‘প´’এর মূল্য ‘প’–এর মূল্যের চেয়ে বেশি, সুতরাং ‘মু´’ অর্থাৎ ‘প´’–এর বিনিময় মূল্য অবশ্যই ‘মু’ অর্থাৎ ‘প’–এর বিনিময় মূল্যের চেয়ে বেশি হবে৷ তাই পুঁজিপতি ‘মু’ হিসাবে যে পুঁজিমূল্য খরচ করে, ‘মু´’ হিসাবে তার চেয়ে বেশি পুঁজিমূল্য ফিরে পায়৷ আবার যেহেতু ‘ম’ থেকে ‘মু’–এর বিয়োগফলরূপ এই বাড়তি মূল্যের জন্য পুঁজিপতি কাউকে কিছু দেয় না, সুতরাং এই মূল্য হল ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’৷

উপরোক্ত উদাহরণ থেকে এ কথা স্পষ্ট হল যে, শ্রমিকের শ্রমশক্তি ক্রয় করা এবং পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে তা ভোগ বা ব্যবহার করার মধ্যেই রয়েছে উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপত্তিস্থল৷ আরও দেখা যাচ্ছে যে, উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টি, অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদন চলতে হলে শ্রমিকের শ্রমশক্তিকে অবশ্যই পণ্য হতে হবে৷ এর অর্থ হল, এমন এক পরিস্থিতি থাকতে হবে, যেন শ্রমিক পুঁজিপতির নিকট তার শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়৷

শ্রমশক্তি কী করে পণ্য হল

আমরা পূর্বেই দেখেছি যে, পুঁজিবাদের অন্যতম শর্ত হল সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির সৃষ্টি৷ এই সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি উৎপাদনের সমস্ত প্রকার উপাদান, এমনকী বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন থেকেও বঞ্চিত৷ তার একটি মাত্র সম্পদ অবশিষ্ট আছে, তা হল তার শ্রমশক্তি৷ ‘‘শ্রমশক্তি বা শ্রম করার ক্ষমতা বলতে মানুষের অন্তর্নিহিত সেই সব মানসিক ও শারীরিক কর্মশক্তির সমষ্টিকে বোঝায়, যা মানুষ যে কোনও প্রকার ব্যবহার–মূল্য সৃষ্টির সময় ব্যবহার করে৷’’ (মার্কস, ক্যাপিটাল)

আমরা পুঁজির আদি–সঞ্চয়ের ইতিহাস দেখেছি৷ সেখানে দেখেছি, কী করে সামন্ত যুগের  ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের একটি বিরাট অংশকে তাদের সমস্ত সম্পদ, অর্থাৎ জমি, বাড়ি, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, এমনকী তাদের জীবনধারণের উপায় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ তাদের পরিণত করা হয়েছে সর্বহারায়৷ আর এদের সেই সম্পদ আত্মসাৎ করে, তা জড়ো করে সৃষ্টি হয়েছে পুঁজিপতি শ্রেণি৷ পুঁজিপতি শ্রেণির দখলে রয়েছে উৎপাদনের সমস্ত প্রকার উপাদান, অর্থাৎ জমি, বাড়ি, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, জীবনধারণের সমস্ত উপায় প্রভৃতি৷

শ্রমিক শ্রেণির অধিকারে রয়েছে একটিমাত্র সম্পদ, তা হল, তার শ্রমশক্তি৷ কিন্তু শ্রমের যন্ত্রপাতি বা শ্রমের বিষয় অর্থাৎ জমি, কাঁচামাল ইত্যাদি কোনও কিছুই তার হাতে না থাকায় সে তার শ্রমশক্তিকেও কাজে লাগাতে পারে না৷ উপরন্তু তার একমাত্র সম্বল শ্রমশক্তিকে বজায় রাখতেও সে অক্ষম হয়ে পড়ে৷ কারণ মানুষের শরীরের অস্তিত্বের সঙ্গে তার শ্রমশক্তির অস্তিত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত৷ আবার শরীরকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাই খাদ্য, আশ্রয় ইত্যাদি জীবনধারণের উপায়৷ সেই জীবনধারণের উপায় থেকেও শ্রমিক শ্রেণিকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ এমনি এক অসহায় অবস্থায় ফেলে শ্রমিককে তার শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য করা হয়৷ কারণ পুঁজিপতি শ্রেণির নিকট তার একমাত্র সম্পদ শ্রমশক্তি বিক্রয় করেই শ্রমিক শ্রেণি বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের নূন্যতম উপায় সংগ্রহ করতে পারে৷ এমনি করে শ্রমশক্তি পণ্যে পরিণত হয়৷

‘‘শ্রমশক্তি সব সময় পণ্য ছিল না৷ আর শ্রমও সব সময় মজুরি–শ্রম, অর্থাৎ স্বাধীন–শ্রম ছিল না৷ কৃষকের কাছে গরু তার সেবাকে যতটুকু বিক্রি করে, ক্রীতদাস তার মালিকের কাছে তার শ্রমশক্তিকে ততটুকুর চেয়ে বেশি বিক্রি করে না৷ তার শ্রমশক্তি সহ ক্রীতদাস একেবারেই তার মালিকের কাছে বিক্রি হয়ে যায়৷ সে এমন একটি পণ্য, যা এক মালিকের হাত থেকে অন্য মালিকের হাতে যেতে পারে৷ সে নিজেই পণ্য, কিন্তু তার শ্রমশক্তি তার পণ্য নয়৷ ভূমিদাস তার শ্রমশক্তির একটি অংশ বিক্রি করে৷ জমির মালিকের কাছ থেকে সে কোনও মজুরি পায় না, উপরন্তু জমির মালিকই ভূমিদাসের কাছ থেকে খাজনা পায়৷’’ (মার্কস, ‘মজুরি–শ্রম ও পুঁজি’)৷ আর মজুরি–শ্রমিক নিজে তো পণ্য নয়ই, বরং সে পণ্যের মালিক৷ তার পণ্য, তার শ্রমশক্তি৷

শ্রমশক্তির মূল্য কীভাবে ঠিক হয়

আমরা দেখলাম, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমশক্তি কী করে পণ্যে পরিণত হয়৷ যে কোনও পণ্য ক্রয় করতে হলেই তার জন্য দাম দিতে হয়৷ সুতরাং শ্রমশক্তি ক্রয় করতে পুঁজিপতিকে দাম দিতে হয়৷ শ্রমশক্তির এই দামকে বলা হয় শ্রমের দাম বা সাধারণভাবে যাকে বলা হয় মজুরি৷

আমরা জানি, কোনও পণ্যের দাম ঠিক হয় তার উৎপাদন ব্যয়ের পরিমাণ দ্বারা৷ অর্থাৎ সেই পণ্যটি তৈরি করতে যতটুকু সামাজিক প্রয়োজনীয় শ্রম ব্যয় হয়েছে তার পরিমাণ দ্বারা৷ আর যেহেতু শ্রমশক্তি একটি পণ্য, তার দাম বা মজুরি ঠিক হবে সেই একই নিয়মে৷ সুতরাং শ্রমিকের শ্রমশক্তির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে যে পরিমাণ সামাজিক প্রয়োজনীয় শ্রম ব্যয় হয়, শ্রমিকের মজুরির মূল্য হবে তার সমান৷

প্রশ্ন হল, শ্রমশক্তির উৎপাদন বলতে কী বোঝায়? আমরা জানি, শ্রমিকের শরীরই হল শ্রমশক্তির আধার৷ তাই শ্রমিকের শরীরের অস্তিত্বের সঙ্গে শ্রমশক্তির অস্তিত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত৷ সুতরাং শ্রমশক্তির উৎপাদন বলতে বোঝায়– শ্রমিককে খাইয়ে–পরিয়ে এমন শারীরিক অবস্থায় রাখতে হবে, যেন সে চুক্তি মতো শ্রম–সময়ে ঠিক মতো শ্রম করতে পারে৷

আবার, আজকের শ্রমশক্তিকেই শুধু বাঁচিয়ে রাখলে চলবে না৷ আজকের সক্ষম শ্রমিক একদিন বৃদ্ধ হয়ে অক্ষম হয়ে পড়বে, নয়তো মরে যাবে৷ এখন থেকেই যদি তার জন্য ব্যবস্থা করে রাখা না যায়, তবে একদিন শ্রমিকের অভাব দেখা দিতে বাধ্য৷ তাই একদিকে বর্তমান শ্রমিককে যেমন সুস্থ সবল অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তেমনি অপর দিকে তাকে এমন সুযোগ দিতে হবে, যেন সে অবসর নেওয়ার সময় তার মালিক পুঁজিপতিকে নিজের জায়গায় একটি সক্ষম ও কর্মঠ শ্রমিক উপহার দিয়ে যেতে পারে৷ সুতরাং শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে তার ছেলেমেয়ে সহ তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷

শ্রমিক ও তার পরিবারের বেঁচে থাকার জন্য চাই খাদ্য, পোশাক, আশ্রয় প্রভৃতি ও জীবনধারণের ন্যূনতম উপায়গুলি৷ আর এইগুলির মূল্যের সমপরিমাণ মূল্য দিয়েই শ্রমিক তা পেতে পারে৷ তাই মজুরি হিসাবে শ্রমিককে অবশ্যই সেই পরিমাণ মূল্য দিতে হবে, যেন সে তার বিনিময়ে এইগুলি সংগ্রহ করতে পারে৷ সুতরাং শ্রমিকের মজুরি নির্ধারিত হয় তার ও তার পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য–সামগ্রীর মূল্যের পরিমাণ দ্বারা, অর্থাৎ মুদ্রার হিসাবে সেইসব দ্রব্যসামগ্রীর দাম দ্বারা৷

বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রমিকের মজুরির পরিমাণ নির্ধারণে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ের প্রভাব পড়ে৷ প্রথমত, শ্রমিক যে কাজ করে তা শিখতে তার যত বেশিদিন সময় লাগে, শ্রমিকের উৎপাদন–ব্যয় ততই বেড়ে যায়৷ ফলে তার মজুরিও বেশি হতে বাধ্য৷ আবার যে কাজের জন্য কোনও শিক্ষানবিশির প্রয়োজন হয় না, অর্থাৎ যে কাজে শ্রমিক তার কর্মক্ষম শরীরটি নিয়ে উপস্থিত থাকলেই যথেষ্ট, সেখানে শ্রমিককে শুধু সক্ষম অবস্থায় বেঁচে থাকার মতো মজুরি দিলেই চলে৷ দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট দেশের জলবায়ু, সামাজিক আচার–আচরণ ও ঐতিহাসিক নিয়মে নির্দিষ্ট জীবনযাত্রার মান প্রভৃতি মজুরির পরিমাণের উপর প্রভাব বিস্তার করে৷ যেমন শীতপ্রধান দেশে গরম পোশাক, বরফ ও তুষারের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো আশ্রয়স্থল প্রভৃতির প্রয়োজন হয়৷ অথচ গ্রীষ্মপ্রধান দেশে এসব না হলেও চলে৷

কিন্তু সাধারণভাবে শ্রমশক্তির উৎপাদন–ব্যয় শ্রমিক ও তার পরিবারের বেঁচে থাকার ব্যয়ের সমান হয়৷ এই মজুরিকে বলা হয় ন্যূনতম মজুরি৷ সব ক্ষেত্রেই যে মজুরি এই পরিমাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়৷ কোনও কোনও ক্ষেত্রে নানা কারণে মজুরি ন্যূনতম মজুরি থেকে উপরে থাকে, আবার কোথাও বা তা ন্যূনতম মজুরির নিচে থাকে৷ কিন্তু গোটা শ্রমিক শ্রেণির মজুরির গড় ন্যূনতম মজুরির আশে–পাশেই ওঠানামা করে৷

উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি

 শ্রমিকের একমাত্র পণ্য শ্রমশক্তির দাম, অর্থাৎ চলতি কথায় মজুরি কী হিসাবে ঠিক হয়, তা আমরা দেখলাম৷ এইবার দেখব কী করে পুঁজিপতি সেই মজুরির বিনিময়ে শ্রমিকের শ্রমশক্তি ক্রয় করে এবং তার ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য আদায় করে৷ আরও দেখব কী করে পুঁজিপতি শ্রমিকের শ্রমে উৎপন্ন মূল্যের একটি অংশ উদ্বৃত্ত মূল্য হিসাবে আত্মসাৎ করে মুনাফা কামায়৷

পুঁজিপতি প্রথমেই উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান, যথা কাঁচা মাল, শ্রমযন্ত্র ইত্যাদি বাজার থেকে ক্রয় করে৷ এদের জন্য সে যে মূল্য দেয়, তা সাধারণত ওইগুলির উৎপাদন মূল্যের সমান৷ কারণ বিনিময় সব সময়ই হয় সমান মূল্যের মধ্যে৷ তারপরই সে বের হয় শ্রমিকের খোঁজে৷ কারণ, শ্রমিকের প্রাণবন্ত শ্রম প্রয়োগ না করে কেবলমাত্র কাঁচা মাল ও শ্রমযন্ত্র দিয়ে উৎপাদন হয় না৷

শ্রমবাজারে শ্রমিক ও পুঁজিপতি উভয়েই স্বাধীন মালিক৷ তারা পৃথক পৃথক পণ্যের মালিক, পুঁজিপতি পুঁজির মালিক, আর শ্রমিক তার শ্রমশক্তির৷ বাজারে সব কিছুই ঘটে সবার সামনে, খোলাখুলিভাবে৷ শ্রমশক্তির বিকিকিনির যে চুক্তি হয়, তাও হয় সবার সামনে৷ শ্রমশক্তির জন্য শ্রমিকের যে মজুরি ঠিক হয়, তা হয় অন্যান্য পণ্যের মতো তার উৎপাদন মূল্যের সমহারে৷ আবার অন্যান্য পণ্য যেমন বাজারের বাইরে লোকচোখের আড়ালে ভোগ করা হয়, তেমনি শ্রমশক্তির ভোগও হয় সর্বসাধারণের চোখের আড়ালে৷ সেখানে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে : ‘বিনা প্রয়োজনে প্রবেশ নিষেধ’৷

পুঁজিপতি বাজার থেকে শ্রমশক্তি ক্রয় করার পরই সগর্বে চলতে শুরু করে কারখানার দিকে, আর শ্রমশক্তির মালিক শ্রমিক চলে তার পিছু পিছু৷ পুঁজিপতি চলে দ্রুত পদে, আর শ্রমিক এক পা এগোয় তো দু’ পা পিছোয়৷ কারণ, যেহেতু সে তার নিজের রক্ত–মাংস বিক্রি করে গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহ করতে যাচ্ছে, তাই সে মনে মনে জানে যে, তার ভাগ্যে লেখা আছে অবধারিত মৃত্যু৷ আমরা দেখেছি কোন অবস্থায় পড়ে শ্রমিক তার শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছে৷ এখন তার এই জীবনীশক্তিটুকুই একমাত্র সম্বল, যার বিনিময়ে সে তার ও তার পরিবারের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে৷ তাই তার এই দ্বিধা, এত ভয়৷

অন্যান্য পণ্যের বেলায় দেখা যায়, আগে দাম দিয়ে তারপর পণ্য ভোগ করতে হয়৷ শ্রমিক কিন্তু সাধারণত পুরো শ্রম–সময় কাজ করার পর মজুরি পায়৷ এ থেকে এই ধারণা হতে পারে যে, শ্রমিক শ্রম করে যা উৎপাদন করে, উৎপাদনের পর তারই একটি অংশ মজুরি হিসাবে পায়৷ কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল৷ বলতে গেলে শ্রমিক পুঁজিপতিকে বাকিতে পণ্য ক্রয় করার বাড়তি সুযোগ দেয়৷ কারণ একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, প্রকৃতপক্ষে পণ্য উৎপন্ন হওয়ার অনেক পরে সেই পণ্য বিক্রয় হয়৷ অথচ তার অনেক আগেই শ্রমিকের মজুরি দেওয়া হয়ে গেছে৷

একবার চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর চুক্তিকালীন সময়ের জন্য নিজের শ্রমশক্তির উপর শ্রমিকের আর কোনও অধিকার থাকে না৷ তখন পুঁজিপতিই ঠিক করে, কীভাবে সে শ্রমিকের শ্রমশক্তি ভোগ করবে৷ এই অবস্থায় নিজের শ্রমে উৎপন্ন পণ্যের উপর শ্রমিকের কোনও মালিকানা থাকে না৷ উৎপন্ন পণ্যের মালিক হয় পুঁজিপতি৷

পুঁজিপতি তার নিজস্ব পরিকল্পনামতো শ্রমিককে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতিতে নিযুক্ত করে৷ শ্রমিকের কাজের উপর সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে৷ সে সব সময়ই চেষ্টা করে, কী করে নির্দিষ্ট শ্রম–সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য তৈরি করিয়ে নেওয়া যায়৷ চুক্তিমতো শ্রম–সময় পার হয়ে গেলে, পুঁজিপতি শ্রমশক্তি হিসাবে যে পণ্য ক্রয় করেছিল, তা ফুরিয়ে যায়৷ শ্রমিককেও আর কাজ করতে হয় না৷ ইতিমধ্যে শ্রমশক্তি ভোগের মধ্য দিয়ে শ্রমিকের বর্তমান শ্রম পণ্যে নতুন–মূল্য হিসাবে জমা হয়৷

এই হল পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি বাস্তব চিত্র৷ আমরা আগেই দেখেছি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে পণ্য উৎপন্ন হয়  তার মূল্য হল, কাঁচা মালের হারাহারি মূল্য + শ্রমযন্ত্রের হারাহারি মূল্য + বর্তমান শ্রমে সৃষ্ট নতুন মূল্য৷ সুতরাং, বর্তমান শ্রমে সৃষ্ট নতুন মূল্যের সবটাই শ্রমিকের প্রাপ্য৷ কিন্তু শ্রমিক যদি মজুরি হিসাবে সেই নতুন মূল্যের সবটাই নিয়ে নেয়, তবে পুঁজিপতির ভাগে কিছুই থাকবে না৷

অবশ্য পুঁজিপতিকে এতটা বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই৷ আট–ঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছে৷ অভিজ্ঞতা থেকে পুঁজিপতি জানে যে, ‘শ্রমশক্তির মূল্যের পরিমাণ এবং শ্রম প্রক্রিয়ায় সেই শ্রমশক্তি যে পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে, তা কখনওই সমান নয়’ (মার্কস –ক্যাপিটাল)৷ শেষেরটি সব সময়ই বড় হয়৷ সুতরাং, শ্রমশক্তির মূল্য হিসাবে পুঁজিপতি যে মজুরি দেয়, শ্রমশক্তিকে খাটিয়ে তার চেয়ে বেশি মূল্যই সে ফিরে পায়৷

বাস্তবে যা ঘটে তা হল, মোট শ্রম–সময়ের একটি অংশ কাজ করেই শ্রমিক তার ও তার পরিবারের জীবনধারণের উপায়ের (আহার, পরিচ্ছদ, বাসস্থান ইত্যাদি) মূল্যের সমপরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে৷ আবার আমরা জানি, শ্রমিক যে মজুরি পায় তা তার ও তার পরিবারের জীবনধারণের উপায়ের মূল্যের সমান হয়৷ সুতরাং, শ্রম–সময়ের এই অংশটি কাজ করেই শ্রমিক তার মজুরির সমান মূল্য সৃষ্টি করে৷ শ্রমিকের নিয়োগকর্তা পুঁজিপতি তাকে যে মজুরি দেয়, তা শ্রমিক উসুল দিয়ে দেয়৷

এরপর শ্রম–সময়ের বাকি অংশ কাজ করে শ্রমিক যে মূল্য সৃষ্টি করে তা বাড়তি মূল্য হিসাবে তার নিয়োগকারী পুঁজিপতির পকেটে যায়৷ শ্রম–সময়ের প্রথম অংশে যে মূল্য সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকেই শ্রমিককে দেওয়া মজুরি–মূল্য উসুল হয়ে গেছে৷ এ অবস্থায় শ্রম–সময়ের বাকি অংশে যে মূল্য সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য পুঁজিপতিকে কোনও প্রকার খরচ বা প্রতিদান দিতে হয়নি৷ সুতরাং, শ্রম–সময়ের এই অংশে সৃষ্ট মূল্যকে বলা হয় উদ্বৃত্ত মূল্য৷ আর এই উদ্বৃত্ত মূল্যই হল পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার উৎস৷

উপরোক্ত বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তি মতো মোট শ্রম–সময়কে দুটি অংশে ভাগ করা যায়– (১) যে অংশ কাজ করে শ্রমিক তার মজুরির মূল্যের সমান মূল্য সৃষ্টি করে, অর্থাৎ আবশ্যিক শ্রম–সময়৷ (২) যে অংশ কাজ করে শ্রমিক তার নিয়োগকারী পুঁজিপতির জন্য উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে, অর্থাৎ উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়৷

সুতরাং মোট শ্রম–সময় = আবশ্যিক শ্রম–সময় + উদ্বৃত্ত শ্রম–সময়

১৷ আবশ্যিক শ্রম–সময় : কোনও একজন শ্রমিক যদি কোনও পুঁজিপতি মালিকের অধীনে কাজ না করে নিজের খুশি মতো কাজ করে, তবে তার ও তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের সমান মূল্য সৃষ্টি করতে তাকে যতক্ষণ শ্রম করতে হয়, তাকে বলা হয় আবশ্যিক শ্রম–সময়৷ অর্থাৎ শ্রমিকের নিজের প্রয়োজনেই তাকে এই সময়টুকু কাজ করতে হচ্ছে৷ এইবার পুঁজিপতির অধীনে নিযুক্ত শ্রমিকের মজুরির মূল্যের সমান মূল্য সৃষ্টি করতে তাকে চুক্তিমতো শ্রম–সময়ের যতটুকু অংশ শ্রম করতে হয়, তাকে বলা যায় আবশ্যিক শ্রম–সময়৷ কারণ আমরা জানি, মজুরির মূল্য নির্ধারিত হয় শ্রমিক ও তার পরিবারের ভরণপোষণের মূল্যের সমপরিমাণের হিসাবে৷

২৷ উদ্বৃত্ত শ্রম–সময় : পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চুক্তিমতো মোট শ্রম–সময় থেকে আবশ্যিক শ্রম–সময়টুকু বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তা হল, উদ্বৃত্ত শ্রম–সময়৷ শ্রমিকের কাছে এই সময়টুকু উদ্বৃত্ত শ্রম–সময় এই জন্য যে, সে নিজের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে শ্রম করে, আনন্দের সঙ্গে করে না৷ আবার এই সময়টুকু শ্রম করে সে যে মূল্য সৃষ্টি করে, তার কোনও অংশই সে ভোগ দখল করতে পারে না৷ তার নিয়োগকারী পুঁজিপতি কোনও প্রকার প্রতিদান না দিয়েই এই সময়টুকুতে সৃষ্ট মূল্যের সবটাই আত্মসাৎ করে৷

 কিন্তু যখন চুক্তি হয় তখন মোট শ্রম–সময় ও উদ্বৃত্ত শ্রম–সময় এমনভাবে দুটি অংশে ভাগ করে দেখানো হয় না৷ তাই মনে হয়, মজুরি যেন মোট শ্রম–সময়ের শ্রমের মূল্য৷ প্রকৃতপক্ষে মজুরি হল, আবশ্যিক শ্রম–সময়ের শ্রমে সৃষ্ট মূল্যের সমান৷ সুতরাং তা মোট শ্রম–সময়ের পুরো মূল্যের চেয়ে কম হতে বাধ্য৷ তাই শ্রমিক মোট শ্রম–সময় কাজ করে যে মূল্য সৃষ্টি করে, মজুরি হিসাবে তার চেয়ে কম মূল্য ফিরে পায়৷

এই সত্যটি শ্রমিকরা বুঝতে পারে না কেন? আর সাধারণ মানুষই বা কেন মনে করেন যে, শ্রমিক শ্রম করে যা উৎপাদন করে তা মজুরি হিসাবে ফিরে পায়? এর কারণ শ্রমিক শ্রম করে সৃষ্টি করে পণ্য মূল্য, অথচ মজুরি পায় মুদ্রায়৷ ফলে পণ্য–মূল্যের ধারণাটি মুদ্রা–মূল্যের আড়ালে চাপা পড়ে যায়৷

পুঁজিপতি ও শ্রমিকের মধ্যে যখন চুক্তি হয়, তখন দুটি জিনিসের উল্লেখ থাকে৷ (১) শ্রমিক কতক্ষণ শ্রম করবে, (২) এই শ্রম করার জন্য সে কত টাকা মজুরি পাবে৷ এইবার চুক্তিমতো সময়ে শ্রম করে শ্রমিক কিছু  পরিমাণ পণ্য–মূল্য সৃষ্টি করে এবং চুক্তিমতো সময়ে শ্রম করার পর শ্রমিক চুক্তিমতো মজুরির টাকা নিয়ে যায়৷ কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে শ্রমিকের শ্রম যে পণ্য–মূল্য সৃষ্টি করে তা সব সময়ই তার মজুরি–মূল্যের চেয়ে বেশি হয়৷ আর এদের  বিয়োগফলই হল উদ্বৃত্ত মূল্য, যা আত্মসাৎ করে পুঁজিপতি শ্রেণি কোনও প্রকার শ্রম না করেও মুনাফা কামায়, বিলাসবহুল জীবনযাপন করে৷

সুতরাং উদ্বৃত্ত মূল্য = মোট শ্রম–সময়ে সৃষ্ট পণ্য–মূল্য −  মোট শ্রম-সময়ের মজুরি–মূল্য৷

আর এই সত্যের উপরেই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে৷ পুঁজিপতির রয়েছে উৎপাদনের সমস্ত বাস্তব উপাদানের মালিকানা৷ আর এই মালিকানার দৌলতে শ্রমিককে নিয়োগ করে সে তার শ্রম থেকে উৎপন্ন পণ্য–মূল্য আত্মসাৎ করে মুনাফা কামায়৷

উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির ব্যাপারটি একটি উদাহরণের সাহায্যে দেখা যাক৷ ধরা যাক, একটি লেদ–কারখানায় বিশেষ এক প্রকারের যন্ত্রাংশ তৈরি হয়৷ প্রতিটি যন্ত্রাংশের জন্য ৩০ টাকা মূল্যের কাঁচা মাল প্রয়োজন হয়৷ প্রতিটি যন্ত্রাংশের জন্য শ্রমযন্ত্র, বিদ্যুৎ, ঘরভাড়া ইত্যাদির হারাহারি অংশ হিসাবে ৮ টাকার সমান মূল্য খরচ হয়৷ আর একজন শ্রমিক দুই শ্রম–দিবস (রোজ) কাজ করে একটি যন্ত্রাংশ তৈরি করতে পারে৷ আরও মনে করা যাক যে, প্রতি শ্রম–দিবসের দৈর্ঘ্য ৮ ঘন্টা এবং একজন শ্রমিকের প্রতি ঘন্টার শ্রম ২ টাকার নতুন মূল্য সৃষ্টি করে৷ আবার, প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় একজন শ্রমিক ও তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য প্রত্যহ ৮ টাকা মূল্যের দ্রব্য সামগ্রী প্রয়োজন হয় এবং সেই হিসাবে একজন শ্রমিকের প্রতিদিনের মজুরি ৮ টাকা৷

লেদ–কারখানার মালিক পুঁজিপতি প্রথমে কারখানা–বাড়ি সংগ্রহ করে, সেখানে কয়েকটি লেদ মেশিন বসায় ও প্রয়োজনীয় কাঁচা মাল ক্রয় করে৷ তারপর দৈনিক ৮ টাকা মজুরিতে কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ করে৷ শ্রমিক কাঁচা মাল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ শুরু করে উৎপাদন করে৷ পুঁজিপতি সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখে, যেন প্রতি দু’দিন অন্তর শ্রমিক পিছু একটি করে যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়৷

এইবার দেখা যাক, যন্ত্রাংশ উৎপাদনের অর্থনৈতিক দিকটি৷ প্রথমে দেখা যাক, প্রতিটি যন্ত্রাংশের জন্য পুঁজিপতির কত টাকা মূল্যের পুঁজি খরচ হয়৷

কাঁচা মাল + যন্ত্র, বিদ্যুৎ, ঘরভাড়া ইত্যাদির হারাহারি অংশ (৩০+৮)টাকা    ৩৮ টাকা
দৈনিক ৮ টাকা হিসাবে একজন শ্রমিকের ২ রোজের মজুরি

(৮ × ২)টাকা

১৬ টাকা
মোট পুঁজি খরচ হয়  ৫৪ টাকা

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি যন্ত্রাংশ তৈরি করতে ৫৪ টাকার পুঁজি খরচ হচ্ছে৷

এখন দেখা যাক, একটি সম্পূর্ণ যন্ত্রাংশে কত মূল্য সৃষ্টি হয়৷

কাঁচা মাল + যন্ত্র, বিদ্যুৎ, ঘরভাড়া ইত্যাদির হারাহারি অংশ (৩০+৮)টাকা ৩৮ টাকা
প্রতি ঘণ্টার শ্রমে ২ টাকার নতুন–মূল্য সৃষ্টি হয়, এই হিসাবে

২ রোজের শ্রমে সৃষ্ট নতুন–মূল্য (১৬ × ২) টাকা

 ৩২ টাকা
মোট সৃষ্ট পণ্য–মূল্য ৭০ টাকা

 

এই উদাহরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিটি যন্ত্রাংশের জন্য পুঁজিপতি মোট ৫৪ টাকা মূল্যের পুঁজি খরচ করে৷ তার বদলে সে পায় একটি সম্পূর্ণ তৈরি যন্ত্রাংশ, যার মোট পণ্য–মূল্য হল ৭০ টাকা৷ ফলে প্রতিটি যন্ত্রাংশ থেকে পুঁজিপতি (৭০–৫৪) টাকা = ১৬ টাকা উদ্বৃত্ত মূল্য পায়৷ পুঁজিপতি হিসাবে লেদ–কারখানার মালিক এইভাবে প্রতিটি যন্ত্রাংশ থেকে ১৬ টাকা হিসাবে মুনাফা অর্জন করে৷

আরও একটি বিষয় দেখা যায়—বর্তমান শ্রমিকের শ্রম ৩২ টাকার নতুন–মূল্য সৃষ্টি করেছে৷ এই ৩২ টাকার একটি অংশ, অর্থাৎ ১৬ টাকা শ্রমিক পেয়েছে মজুরি হিসাবে৷ আর অপর অংশটি অর্থাৎ ১৬ টাকা পুঁজিপতি পেয়েছে উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফা হিসাবে৷ সুতরাং মজুরি ও মুনাফা হল বর্তমান শ্রমিকের প্রাণবন্ত শ্রমে সৃষ্ট নতুন–মূল্য = মজুরি–মূল্য+উদ্বৃত্ত–মূল্য৷ তাই নতুন সৃষ্ট মূল্যের পরিমাণ ঠিক রেখে মজুরি বা উদ্বৃত্ত মূল্যের যে কোনও একটির পরিমাণ বাড়ালে অপরটির পরিমাণ কমে যাবে, অর্থাৎ মুনাফার পরিমাণ বাড়লে, মজুরির পরিমাণ কমবে এবং মজুরির পরিমাণ বাড়লে, মুনাফার পরিমাণ কমবে৷ প্রতিটি যন্ত্রাংশ উৎপাদনের জন্য পুঁজিপতি যে যে পণ্য, অর্থাৎ কাঁচা মাল, শ্রমযন্ত্র, ঘরবাড়ি ইত্যাদি ও শ্রমিকের শ্রমশক্তি ক্রয় করেছে, তাদের প্রত্যেকটির জন্যই সে তাদের মূল্যের সমান মূল্য দিয়েছে৷ আর এ সবই ঘটেছে সবার চোখের সামনে৷ আর এই ঘটনা দেখিয়েই বুর্জোয়া পণ্ডিতেরা বলেন যে, পুঁজিপতি ন্যায্য মূল্যে সমস্ত পণ্য ক্রয় করে এবং চুক্তিমতো শ্রমিকের প্রাপ্য ন্যায্য মজুরিই তাকে দেয়৷ সুতরাং, পুঁজিপতি শ্রমিককে তার শ্রমের ফলের একটি অংশ থেকে বঞ্চিত করে এবং তা উদ্বৃত্ত মূল্য হিসাবে আত্মসাৎ করে—এই কথাটি ঠিক নয়৷

অথচ দেখা যাচ্ছে যে, তার ক্রয় করা সবকটি পণ্য একসঙ্গে মিলিয়ে ভোগ করার ফলে পুঁজিপতি তার দেওয়া মূল্যের পরিমাণের চেয়ে বেশি মূল্য ফিরে পেয়েছে৷ আরও দেখা যাচ্ছে যে, কাঁচা মাল, শ্রমযন্ত্র, ঘরবাড়ি ইত্যাদি অর্থাৎ সঞ্চিত অতীত–শ্রমের বেলায় কেবলমাত্র হারাহারি মূল্যই সে ফিরে পেয়েছে৷ কিন্তু পণ্য হিসাবে বর্তমান শ্রমিকের শ্রমশক্তি ক্রয় করতে পুঁজিপতি মজুরি হিসাবে শ্রমিককে যে মূল্য দিয়েছে, শ্রমিকের শ্রমশক্তি ভোগ করার মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ শ্রমিককে দিয়ে শ্রম করিয়ে সে মজুরির মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য ফিরে পেয়েছে৷ সুতরাং, এখন আমরা নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারছি যে, শ্রমিক শ্রেণির শ্রমে উৎপন্ন মূল্যের একটি অংশ থেকে তাদের বঞ্চিত করে এবং তা আত্মসাৎ করেই পুজিপতি শ্রেণি মুনাফা অর্জন করে৷ আর এমনিভাবেই চলে শ্রমিক শ্রেণির উপর পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ৷

(মধুসূদন চক্রবর্তীর ‘মার্কসবাদ জানব’ পুস্তক থেকে)