পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিবার্য ফল ভয়াবহ বেকারত্ব

রাজ্যে রাজ্যে করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কমার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির পালে বাতাস লাগতে শুরু করেছে বলে দাবি করছেন মন্ত্রী ও আধিকারিকেরা। কিন্তু কর্মসংস্থানের ছবিতে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নতুন কাজ সৃষ্টি হওয়া দূরস্থান, কর্মরতরাও কাজ হারিয়ে চলেছেন। স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি, এমবিএ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি হাসিল করেও চাকরি মিলছে না। পিওন, সুইপারের কাজ, যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশেষ দরকার পড়ে না, তা পাওয়ার জন্যও উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে চলছে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। ভোটের আগে নেতা-মন্ত্রীরা চাকরির ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোট মিটে গেলেই সেসব অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। চাকরির দাবিতে বেকার যুবকরা বিক্ষোভ দেখালে চালানো হচ্ছে পুলিশি নির্যাতন। রোজগারের পথ দেখাতে নেতা-মন্ত্রীরা পকোড়া ভাজা, তেলেভাজার দোকান খোলার পরামর্শ দিচ্ছেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশনেতারা বলেছিলেন– সব হাতে কাজ দেওয়া হবে। এর পর থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ভোটের ঠিক আগে নতুন চাকরির দেদার প্রতিশ্রুতি আমরা শুনে চলেছি। কেন্দ্রে সরকারে বসার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বছরে ২ কোটি বেকারের কাজ হবে বলে গলা ফাটিয়েছিলেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, নতুন চাকরি সৃষ্টি তো দূর, সরকারি দপ্তরগুলিতে কর্মচারীর সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। যেটুকু নিয়োগ হচ্ছে, তার বেশির ভাগটাই ঠিকা হিসাবে যেখানে শ্রমিক-কর্মচারীরা প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারি চাকরির বেহাল দশা নিচের সারণীটি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়ঃ

সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা

সাল   মোট কর্মচারী (লক্ষে)
২০০৯-১০ ১৪.৯০
২০১০-১১ ১৪.৪০
২০১২-১৩ ১৪.০২
২০১৩-১৪ ১৩.৪৯
২০১৪-১৫ ১২.৯১
২০১৫-১৬ ১১.৮৫
২০১৬-১৭ ১১.৩৫
২০১৭-১৮ ১০.৮৮
২০১৮-১৯ ১০.৩৩

 

এ দিকে দেশে স্বাভাবিক নিয়মেই কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৫ সালের মে মাসে সারাদেশে কর্মক্ষম মানুষ ছিল ৯৪.৫৮ কোটি। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে ১১.২২ কোটি বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ১০৫.৮ কোটিতে। অথচ কমছে কর্মরত মানুষের সংখ্যা। ২০১৫ সালে কাজে যুক্ত ছিলেন কর্মক্ষম মানুষের প্রায় ৪৯ শতাংশ। ২০২১-এ দেখা যাচ্ছে কর্মরত মানুষের সংখ্যা মোট কাজ করতে সক্ষম মানুষের মাত্র ৪০ শতাংশের মতো। নরেন্দ্র মোদির গত সাত বছরের শাসনে সরকারি সংস্থায় কাজ চলে গেছে ৬ লক্ষ, ব্যাঙ্কে ৪.৫ লক্ষ মানুষের। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অবস্থা তো না বলাই ভাল! ১২.৫ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। বড় শিল্পে কর্মরত অসংগঠিত শ্রমিকদের ৬৭ শতাংশের কাজ চলে গেছে। এদিকে কেন্দ্রের বিভিন্ন দপ্তরে ৮০ লক্ষ পদ শূন্য পড়ে রয়েছে, সরকার নিয়োগ করছে না। ২০১৫-‘২১ এই ৭ বছরে মনরেগা প্রকল্পে নাম লিখিয়েছেন ২৫ কোটি মানুষ, কিন্তু বছরে কাজ জুটেছে মাত্র ১ কোটি ৫২ লক্ষের। গত সাত বছরে সরকারি চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দেখে ইউপিএসসি-তে আবেদন করেছেন ৮.৫ কোটি যুবক-যুবতী। চাকরি পেয়েছেন মাত্র ২৫৬২৭ জন। স্টাফ সিলেকশন কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাত বছরে চাকরির আবেদন জমা পড়েছে ১২ কোটি বেকারের। কাজ মিলেছে মাত্র ২ লক্ষ ১৪ হাজার ৬০১ জনের। ২০১৪ পর থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মোট ৬ কোটি ৮৯ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম নথিভুক্ত করলেও কাজ পেয়েছেন মাত্র ২৭ লক্ষ।

ফলে, পরিস্থিতি ভয়াবহ। সরকার এর দায় কোভিড পরিস্থিতির ওপর চাপাতে চাইলেও বাস্তবে মহামারি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই বেকার সমস্যা ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছিল। বিক্ষোভের ভয়ে আতঙ্কিত মোদি সরকার এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যানই প্রকাশ করতে দেয়নি।

শুধু ভারতে নয়, দুনিয়া জুড়েই আজ বেকারত্বের হাহাকার ক্রমে জোরালো হচ্ছে। সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে পরিচালিত বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে ভয়াবহ বাজারসঙ্কটে ভুগছে, তা থেকে রেহাই পাওয়ার কোনওরকম উপায়ই খুঁজে বের করতে পারছেন না বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা। লাভের পিছনে ছুটে ক্রমাগত যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা বেছে নিচ্ছে পুঁজিপতিরা। নামমাত্র শ্রমিক দিয়ে উৎপাদনের কাজ চলছে। মুনাফা বাড়াতে চলছে ব্যাপক শ্রমিক ছাঁটাই। ফলে বিপুল হারে উৎপাদন হলেও উৎপাদিত পণ্য কেনার পয়সা থাকছে না কর্মহীন সাধারণ মানুষের হাতে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিজস্ব বৈশিষ্টে্যর কারণেই সমাধান-অযোগ্য এই সমস্যার মুখোমুখি আজ বিশ্বের পুঁজিপতি শ্রেণি। কখনও আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধিয়ে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে, কোথাও নানা জনমুখী প্রকল্প চালু করে জনগণের হাতে কিছু পয়সা জুগিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকারগুলি। ঠিক সেই কারণেই নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম দিকে মনরেগা প্রকল্পটির বাজেট-বরাদ্দে ব্যাপক কাটছাঁট করলেও শেষ পর্যন্ত আবার তাতেই গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষ একশো দিনের কাজের মারফত কিছু রোজগারের মুখ দেখতে পারে।

কিন্তু এই পথে ভয়াবহ বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কাজ না পাওয়া ও কাজ হারানো মানুষের ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে। রাজ্যে রাজ্যে কাজের দাবিতে মাঝেমাঝেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে যুবসমাজ। কয়েক মাস আগে সামাজিক মাধ্যমে ‘মোদি রোজগার দো’ প্রচার দিনের পর দিন ট্রেন্ড করেছে। এই বিষয়ে শুধুমাত্র টুইটারে কুড়ি লক্ষ শেয়ার হয়েছিল। এই বিক্ষোভ ক্রমাগত আরও তীব্র হবে। এই অবস্থায় রোজগারের দাবিতে, ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তার জন্য চাই সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত লাগাতার শক্তিশালী আন্দোলনের ঢেউ। এই আন্দোলনগুলিই ক্রমে সংহত হয়ে পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবে রূপ নেবে, উচ্ছেদ করবে এই শোষণমূলক ব্যবস্থাটিকে। এ না হলে বেকার সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।

পরিসংখ্যান বলছে, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যায় ভারত আগামী তিরিশ বছর বিশ্বে শীর্ষস্থানে থাকবে। ফলে প্রয়োজন পড়বে অসংখ্য কর্মসংস্থানের। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কাজের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এ কাজ একমাত্র সম্ভব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিকল্পিত অর্থনীতি চালু হলে। মানুষ সেখানে সম্পদ হিসাবে গণ্য হয়। ব্যক্তি-পুঁজিপতির মুনাফার লক্ষ্যে নয়, দেশের সমস্ত মানুষের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত সেই উৎপাদন ব্যবস্থায় কাজ পায় প্রতিটি কর্মক্ষম হাত। রোজগেরে নাগরিকরা সৃষ্টি করে বিপুল চাহিদা। গড়ে ওঠে বাজার। প্রয়োজন মেটাতে বাড়তে থাকে উৎপাদন। কর্মসংস্থান হয় আরও বেশি সংখ্যায় মানুষের। এই পথে ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে কখনই মন্দার কবলে পড়তে হয় না। তাই সমাজতান্ত্রিক সভ্যতার মানুষ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত। সেই সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষ্যেই কোমর বাঁধতে হবে এ দেশের যুবসমাজকে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ১৯ নভেম্বর ২০২১