Breaking News

পুঁজিপতিদের টাকায় চলা দলগুলি জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না

বেলদা

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) অভয়ার ন্যায়বিচার এবং জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে ২১ জানুয়ারি কলকাতায় মহামিছিলের ডাক দিয়েছে। এই কর্মসূচির প্রচার যেমন রাজ্য জুড়ে চলছে, তেমনই এই মিছিলের জন্য যে বিরাট খরচ তা-ও দলের কর্মীরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কিংবা রাস্তার মোড়ে, বাজারে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করছেন।

নির্বাচনের সময়েও দলের কর্মীরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে যেমন প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার অনুরোধ করেন তেমনই ভোটের খরচও তাঁরা ভোটারদের থেকেই সংগ্রহ করেন। আচ্ছা, অন্য দলও তো কখনও কখনও কিছু বিষয় নিয়ে আন্দোলনের মহড়া দেয়, কিংবা নির্বাচনে লড়ে। কিন্তু তাদের কাউকেই তো এ ভাবে জনগণের থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা যায় না! তা হলে এই সব কর্মসূচিতে তারা যে বিপুল ব্যয় করে তা আসে কোথা থেকে?

শাসক দলগুলি চলে পুঁজিপতিদের টাকায়

উত্তরটা পাওয়া যেতে পারে গত ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য থেকে। দেখা যাচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে বিভিন্ন ব্যক্তি, ট্রাস্ট বা কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে দেশের যে সব রাজনৈতিক দল সরাসরি ২০ হাজার বা তার বেশি টাকার অনুদান পেয়েছে তার শীর্ষে রয়েছে বিজেপি। পরিমাণটা ২ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের চেয়ে যা তিন গুণেরও বেশি। কংগ্রেস পেয়েছে ২৮৮.৯ কোটি টাকা। আগের বছর যা ছিল ৭৯.৯ কোটি।

এই টাকা কারা দেয় তা গোপন রাখার জন্য বিজেপি ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা চালু করেছিল। সেখানে টাকা কে দিচ্ছে সাধারণ ভাবে তা জানা যেত না। কিন্তু এই বন্ড কার্যত শাসক দলকে ঘুষ হিসাবে দিয়ে বৈধ এবং অবৈধ উপায়ে নানা সরকারি বরাত জোগাড়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছে বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ডকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে নিষিদ্ধ করে দেয় এবং কারা এই বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে কত টাকা দিয়েছে তা প্রকাশ করতে বলে। দেখা যায়, ২০১৯-এর এপ্রিল থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি একাই পেয়েছে ৬ হাজার ৬০ কোটি টাকা। যা বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া মোট টাকার প্রায় অর্ধেক। অন্য জাতীয় এবং আঞ্চলিক দলগুলি পেয়েছে বাকি অর্ধেক পরিমাণ টাকা।

পুঁজিপতিরা শাসক দলগুলিকে টাকা দেয় কেন

যে কোনও ব্যক্তি পছন্দের দলকে চাঁদা দিতেই পারে। কিন্তু এই যে বিপুল পরিমাণ চাঁদা, এ তো দলের কোনও সাধারণ সমর্থক বা সদস্যের চাঁদা নয়, এ হল ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলির দেওয়া টাকা। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ব্যবসায়ী এবং পুঁজিপতিরা এত বিপুল পরিমাণ টাকা রাজনৈতিক দলগুলিকে, বিশেষত বিজেপিকে কেন দিচ্ছে?

সাধারণ ভাবে সকলেরই অভিজ্ঞতা, ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা একটা টাকা খরচ করলেও লাভ-ক্ষতির হিসেব কষে করে। তা হলে এ ক্ষেত্রে তারা এতখানি উদার-হস্ত কেন? রাজনীতির নামে সাধারণত ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের নাক কোঁচকাতেই দেখা যায়। তা হলে এই সব রাজনৈতিক দলকে এমন বিপুল পরিমাণ টাকা তারা দেয় কেন? বাস্তবে এটি উদারতার কোনও বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রেও তারা টাকা দেয় লাভ-লোকসানের হিসেব কষেই। ব্যবসায়ীরা টাকা সেখানেই ঢালে যেখান থেকে তা বহু গুণ হয়ে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলকে টাকা দিলে তা বহু গুণ হয়ে ফিরে আসে কী করে?

স্বাধীনতার আগে থেকেই কংগ্রেস পুঁজিপতিদের টাকা নিয়েছে

আসলে এরা টাকা দেয় মূলত শাসন ক্ষমতায় যে দল রয়েছে কিংবা আগামী দিনে ক্ষমতায় বসার সম্ভাবনা রয়েছে এমন দলকেই। এ দেশের শিল্পপতিরা, একচেটিয়া পুঁজিপতিরা স্বাধীনতার পর থেকে শাসক কংগ্রেসের পিছনেই টাকা ঢেলে এসেছে এবং বিনিময়ে সরকার ও প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সব রকমের সুবিধা আদায় করেছে। কংগ্রেসও তাদের বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য দল হিসাবে এই সুবিধা দিয়ে গেছে। অবশ্য এর শুরু স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির একটা বড় অংশ যেমন ছিলেন দেশের বড় বড় ধনীরা, তেমনই বিড়লা, বাজাজ, সারাভাই, লালভাই ও অন্যান্য ধনী শিল্পপতিরা ছিলেন কংগ্রেসের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। গান্ধীজি তো দিল্লিতে বিড়লার বাড়িতেই থাকতেন। এই সব দেখে কংগ্রেসেরই এক শীর্ষ নেতা লালা লাজপত রাই গান্ধীজিকে বলেছিলেন শিল্পপতিদের থেকে কংগ্রেসের জন্য চাঁদা না নিতে। তিনি গান্ধীজিকে অনুরোধ করেছিলেন দল এবং আন্দোলনের খরচের জন্য জনগণেরই উপর নির্ভর করতে। গান্ধীজি সে অনুরোধ উড়িয়ে দিয়ে জবাব দিয়েছিলেন, কেন, ধনীদের কি দেশকে ভালবাসার অধিকার নেই? গান্ধীজি-বর্ণিত পুঁজিপতিদের দেশপ্রেমের আসল চেহারাটা কী, তা স্বাধীনতার গত প্রায় আট দশক ধরে দেশের শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ মানুষ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন জীবনভরা ষন্ত্রণায়, শোষণ-বঞ্চনার তীব্রতায়।

এখন কংগ্রেসের জায়গা নিয়েছে বিজেপি

স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ভারতে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় এবং পুঁজিবাদী পথে, পুঁজিবাদের বিকাশের সহায়ক সমস্ত নীতি গ্রহণের মধ্যে দিয়েই তা এগোতে থাকে। শাসক কংগ্রেস এবং পুঁজিপতি তথা শিল্পপতি শ্রেণি পরস্পরের পরিপূরক সখ্যতার মধ্য দিয়েই চলতে থাকে। এ ভাবে পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই একদিন কংগ্রেস তার জনপ্রিয়তা হারায়। পুঁজিপতিরা তখন তাদেরই আর এক বিশ্বস্ত এবং স্বার্থরক্ষায় নির্ভরযোগ্য দল হিসাবে বিজেপিকে তুলে ধরে। এই ভাবে বিজেপির উত্থান ঘটে। পুঁজিপতি শ্রেণি শিবির বদলে নতুন শাসক বিজেপির নৌকায় সওয়ার হয়। তাই বিজেপিই এখন অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের প্রথম পছন্দের দল।

জনগণের সম্পদেই পুঁজিপতিদের ভেট

জাতীয় সম্পদ ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও সম্পত্তির বেসরকারিকরণ কংগ্রেসের মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে শুরু হলেও গত দশ বছরের বিজেপি শাসনে তা লাগামছাড়া আকার নেয়। শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কল-কারখানা, রেল তেল ব্যাঙ্ক বিমা বন্দর খনি জঙ্গল জমি প্রভৃতি সমস্ত জাতীয় সম্পদের এখন ব্যাপক বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। কাদের হাতে সেগুলি তুলে দেওয়া হচ্ছে? একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে। কোটি কোটি দেশবাসীর কঠোর পরিশ্রম ও কষ্টার্জিত করের টাকায় যেগুলি দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে সেগুলি বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে তুলে দেওয়া হচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ মকুব করে দেওয়া হচ্ছে। করছাড় দেওয়া হচ্ছে, কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট কর। যা আসলে জনগণের সম্পত্তি, জনগণের কল্যাণে কাজে লাগার কথা, তা থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে সে-সব শাসকদের হাতে তুলে দিচ্ছে বিজেপি। অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণির একান্ত অনুগত সেবক হিসাবে শাসক বিজেপি সমস্ত উপায়ে সেবা করে চলেছে তাদের। এর ফল কী? এর ফলে পুঁজিপতিদের ভাণ্ডার উপচে পড়ছে। দেশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজির হাতে। উল্টো দিকে বিজেপি সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী নীতির পরিণামে জনজীবনে নেমে এসেছে অশেষ দুর্ভোগ। ক্রমাগত নিঃস্ব হয়ে চলেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। দেশের এক শতাংশ পুঁজিপতির হাতে কুক্ষিগত হয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশের বেশি, আর নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। তাই পুঁজিপতিরা তাদের এমন বিশ্বস্ত সেবককে অর্থ দিয়ে, প্রচার দিয়ে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টা তো করবেই। পছন্দের রাজনৈতিক দলকে টাকা দেওয়া তাদের ব্যবসারই অঙ্গ।

শাসক শ্রেণির অনুগত অন্য দলগুলিও ভাগ পায়

আবার শুধু শাসক বিজেপিকে টাকা দিয়ে গেলেই চলবে না। কারণ আগামী দিনে বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ হলে, বাস্তবে যে ক্ষোভ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, অন্য কোনও নির্ভরযোগ্য দলকে তৈরি রাখতে হবে। তাই তারা বিজেপির পাশাপাশি আর এক জাতীয় দল কংগ্রেসকেও টাকা দেয়। আবার রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা আঞ্চলিক দলগুলির থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করার জন্য তাদেরও দেয়। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে কর্পোরেট অনুদানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তেলেঙ্গানার ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি। তারা পেয়েছে ৫৮০ কোটি টাকা। এখন নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া নির্বাচনী বন্ডে এ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ১৭০৮ কোটি টাকা, ওড়িশার বিজেডি ১০১৯ কোটি এবং তামিলনাড়ুর ডিএমকে পেয়েছে ৬৩৯ কোটি এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআর পেয়েছে ৫০৩ কোটি টাকা।

জাতীয় তথা জনগণের সম্পদ এই ভাবে নির্বিচারে গ্রাস করার সুযোগ পুঁজিপতিদের করে দিচ্ছে যে সব দল, পুঁজিপতিরা নিজেদের লুঠের খানিকটা অংশ সেই সব দল এবং তাদের এমপি-এমএলএ-মন্ত্রীদের পিছনে খরচ করে তাঁদের আরাম-আয়েসে, বিলাস-ব্যসনে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। তাই এই দলগুলির মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়করা জনপ্রতিনিধিত্বের নামে সরকারি নীতিনির্ধারণে বাস্তবে পুঁজিপতিদেরই প্রতিনিধিত্ব করে।

বর্ধমান শহর

দলের শ্রেণিচরিত্রও জনগণকে বুঝতে হবে

যারা সাধারণ ভাবে সমাজে শ্রেণি শাসন, শ্রেণি দলের অস্তিত্ব ধরতে পারেন না, এই ঘটনা তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে কাজ করে যে দল, তা যে নামেই থাকুক, তার পতাকার রঙ যা-ই হোক, তা আসলে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণিরই দল। অন্য দিকে শাসক শ্রেণির স্বার্থের বিপরীতে শোষিত জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য লড়াই করছে যে দল তা শোষিত মানুষের দল। সমাজে শ্রেণি যেমন দুটো– শোষক এবং শোষিত, শাসক এবং শাসিত, তেমনই দলের সংখ্যা যতই হোক, বাস্তবে দলও দু’রকমের– পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দল আর শোষিত মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী দল। যারা আজ পুঁজিপতিদের একটি দলের অপশাসনে ক্ষুব্ধ হয়ে পুঁজিপতিদেরই অপর একটি দলকে সমর্থন করছেন এবং তার মধ্যে দিয়ে জীবনে সুরাহা খুঁজছেন, তারা রাজনৈতিক কানাগলিতে পথ হারাতে বাধ্য। আজ এই সত্য সকলকেই বুঝতে হবে যে, শোষিত মানুষের নিজস্ব দল ছাড়া তাদের স্বার্থ রক্ষা হতে পারে না। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) হল সেই দল। তাই সে জনগণের স্বার্থরক্ষার প্রতিটি সংগ্রাম সফল করার জন্য জনগণের কাছে গিয়েই হাত পাতে, পুঁজিপতি শ্রেণির কাছে যায় না এবং জনগণও তাদের সাধ্যমতো এই দলের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। পুঁজিপতিদের শোষণের বিরুদ্ধে, জনগণের সম্পদ লুঠ করার বিরুদ্ধেই এই দলের সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম কখনও পুঁজিপতি শ্রেণির দেওয়া টাকায় হতে পারে না। আজ এই দলের দ্রুত শক্তিবৃদ্ধির উপর নির্ভর করছে জনজীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধান। তাই সাধারণ মানুষকে তার নিজস্ব শ্রেণি দল চিনতে হবে। পুঁজিপতিরা যেমন ঠিক চিনেছে তাদের শ্রেণি দলকে। না হলে সাধারণ মানুষ আর কতকাল এই সব বুর্জোয়া দলের পিছনে নিজেদের শক্তিক্ষয় করবে?