প্রধানমন্ত্রী এখন বলে চলেছেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দেশে এখন ‘অমৃত কাল’ চলছে। তাঁর অমৃত যে আসলে হলাহল তা আবার টের পেলেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পেনশন বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ফলে ১১-১২ মার্চ গুয়াহাটিতে দু’দিনের কর্মচারী প্রভিডেন্ট ফান্ডের কেন্দ্রীয় অছি পরিষদের বৈঠককে ঘিরে পিএফ-এর অন্তর্গত সংগঠিত ক্ষেত্রের ৬ কোটি শ্রমিক-কর্মচারী এবং ৭৫ লক্ষ অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগী কর্মচারীদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ এবং আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য প্রতিশ্রুতিগুলির মতো এটাও ভুয়ো। কেন্দ্রীয় সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তে পি এফ-এর সুদ ৮.৫ শতাংশ থেকে কমে ৮.১ শতাংশ হয়ে গেল–যা ১৯৭৭-‘৭৮ সালের পর ৪৪ বছরে সর্বনিম্ন। পেনশনের হারও বাড়ল না– সেই সর্বনিম্ন এক হাজার টাকাই থেকে গেল। শুধু বিষয়টি বিলম্বিত করার জন্য আর একটি এক্সপার্ট কমিটির হাতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সরকারের এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক একতরফা সিদ্ধান্তে শ্রমিকদের মধ্যে চূড়ান্ত ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় অছি পরিষদের মিটিংয়ে এ আই ইউ টি ইউ সি সহ অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের প্রতিবাদে কানই দিলেন না কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান শ্রমমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব। দাবি উঠেছিল, ন্যূনতম পেনশন ৩০০০ টাকা হোক। কিন্তু নানা টালবাহানার পর তা মানা হল না। আসলে নির্বাচন শেষ, সরকারের প্রতিশ্রুতিও শেষ। এআইইউটিইউসি-র প্রতিনিধি বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্য সুস্পষ্টভাবে হিসাব দেখিয়ে যুক্তি সহকারে বলেছিলেন, কেন পি এফ-এর সুদের হার অন্ততপক্ষে ৮.৫ শতাংশ হারে দেওয়া সম্ভব। তা সত্ত্বেও সুদ সর্বনিম্ন হল কেন?
আমাদের দেশের ধনকুবেররা ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, ফেরত দেয়নি। সরকার এই টাকা উদ্ধার করার চেষ্টাই করেনি তাদের মালিক-তোষণ নীতির জন্যই। বৃহৎ পুঁজিপতিদের ট্যাক্স ছাড়, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্কঋণ মকুব, সম্পদ কর ছাড়, সুদে ছাড়– এ সবের ফলেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প এবং ব্যাঙ্কগুলি রুগ্ন এবং দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। ব্যাঙ্কে সুদের হার কমেছে। আর এটাকেই অজুহাত করে পেনশনের সুদও সরকার স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় কমিয়ে দিল।
এ ছাড়াও পিএফ-এর হাজার হাজার কোটি টাকা দাবিদারহীন অবস্থায় (আনক্লেমড এবং আনঅ্যাকাউন্টেন্ড) পড়ে আছে। পি এফ-এর টাকা খাটিয়ে বহু কোটি টাকা সুদ পাচ্ছে সরকার এবং বহু ডেমারেজের টাকাও সরকার পায়। এই সব মিলিয়ে অন্ততপক্ষে ৮.৫ শতাংশ পিএফ-এর সুদ না দেওয়াটাই আশ্চর্যের।
স্বয়ংশাসিত ত্রিপাক্ষিক সংস্থা হওয়া সত্তে্বও ইপিএফও (এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অর্গানাইজেশন) কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রকের অঙ্গুলিহেলনে চলে। অর্থমন্ত্রকই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়– কেন্দ্রীয় অছি পরিষদের সিদ্ধান্তকে অতিক্রম বা অগ্রাহ্য করেই। ভারতের মতো পুঁজিবাদী রাষ্টে্র একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণি এবং কর্পোরেটদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটানো হচ্ছে। পিএফ এবং ইএসআই-এর মতো দেশের সর্ববৃহৎ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার এক পয়সাও বরাদ্দ করে না। অথচ তারাই সব সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে। পেনশন স্কিমে ভর্তুকি মাত্র ১.১৬ শতাংশ। শ্রমিক সংগঠনগুলির দাবি মেনে এই ভর্তুকি সামান্য বাড়ালেই নূ্যনতম পেনশন ৩০০০ টাকা হতে পারত। সরকার সেটা করেনি।
সরকার এতই নির্মম যে, অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক, মৃত শ্রমিক, স্বল্পকালীন চাকরি করে বরখাস্ত শ্রমিক, বা যাঁরা নানা কারণে ক্লেইম করতে পারেননি, তাঁদের হাজার হাজার কোটি টাকা যা আনক্লেইমড বা দাবিদারহীন অবস্থায় পড়ে আছে, নাম-ঠিকানা, আইডি ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও সরকার খোঁজ করে তাঁদের টাকা তাঁদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি এআইইউটিইউসি এই দাবি তোলায় এবং অছি পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেও সরকার তা করেনি। বরং সরকার প্রস্তাব দিয়েছিল, যাঁরা ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে সিনিয়র সিটিজেন পেনশনার, তাঁদের পেনশন এই আনক্লেইমড টাকা থেকেই বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। সরকার একবারও ভাবল না যে কার টাকা তারা কাকে দিচ্ছে! দাবিদারহীন টাকারও তো দাবি আসতে পারে–সরকার তখন কী করবে? শ্রমিক-কর্মচারীদের বঞ্চিত করে তাদেরই একাংশের বিরুদ্ধে একাংশকে লড়িয়ে দেওয়ার হীন চাতুরি ছাড়া একে কী-ই বা বলা যায়!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুনিয়া জুড়ে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উত্থান ঘটেছিল এবং পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি নিজেদের মধ্যেই পারস্পরিক যুদ্ধের ফলে হীনবল হয়ে পড়েছিল। মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন দুনিয়াকে দেখিয়েছিল, কী ভাবে মানুষের দ্বারা মানুষের উপর শোষণ নির্মূল করা যায়। এই শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেণির জীবনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে তাদের অধিকার সুনিশ্চিত করেছিল। সেই সময় বিশ্বজোড়া সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপুল ও যুগান্তকারী অগ্রগতি ও মানবমুক্তির প্রভাব পুঁজিবাদী দুনিয়াতেও আলোড়ন তুলেছিল। এর ফলে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রবল আকর্ষণ দেখে তাদের ভুলিয়ে রাখতে পুঁজিবাদী দুনিয়াও দেখাতে চেয়েছিল যে তাদেরও মানবিক মুখ আছে। আমাদের দেশেও সেই সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রভাবেই স্বাধীনতার সময় ও তার পরপরই শ্রমিক কল্যাণে প্রণীত হয়েছিল সামাজিক সুরক্ষা, কাজের সুরক্ষা, শ্রমিক কল্যাণমূলক আইনগুলি। যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাস্টার অ্যাক্ট ১৯৪৭, ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট ১৯৪৮, প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাক্ট ১৯৫২, ইএসআই অ্যাক্ট ১৯৪৯ ইত্যাদি শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত আইন। প্রতিটি শ্রম আইনের পিছনেই আছে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু আজ পুঁজিবাদ চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল এবং সংকট জর্জরিত। সমাজতান্ত্রিক শিবিরও এখন নেই। ফলে একমেরু পুঁজিবাদী বিশ্ব নিয়ে এসেছে বিশ্বায়ন, উদারিকরণ ও বেসরকারিকরণের সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদী নীতি। সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে শ্রমিক শোষণ তীব্রতর হচ্ছে। সরকারগুলিও এই কর্পোরেট এবং পুঁজিপতিদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় সামাজিক সুরক্ষার আইনগুলির উপর আঘাত নেমে এসেছে।
একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে আমাদের দেশের সরকার শ্রম আইনের সংস্কার করে মালিক শ্রেণির স্বার্থে ‘শ্রম কোড’ জারি করেছে। সামাজিক সুরক্ষার আইনগুলিকে গুরুত্বহীন করে দিচ্ছে। এ সবের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির বহু সংগ্রামে অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মালিক শ্রেণির স্বাচ্ছন্দ্য, লগ্নিবান্ধব নীতি ইত্যাদির নামে নানা সুযোগ-সুবিধা মালিকদের দিচ্ছে। লেবার কোডে পিএফ তহবিলে মালিকের দেয় ১২ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। পিএফএবং ইএসআই-কে ঐচ্ছিক করে দিয়ে বেসরকারি মিউচুয়াল ফান্ড বা মেডিকেল বিমা ইত্যাদির ব্যবসা চালু করতে চাইছে। এ ভাবেই মালিক শ্রেণির স্বার্থে পিএফ এবং ইএসআই-এর প্রয়োগ বা কভারেজকেও মালিকদের ইচ্ছাধীন করার নীতি প্রবর্তন করেছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ চটকল শ্রমিক, চা শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক এবং আরও অন্যান্য ক্ষেত্রের সামাজিক সুরক্ষা ও অন্যান্য অধিকারহীন শ্রমিকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ব্যাপক হারে বাড়ছে কন্ট্রাক্ট শ্রমিক, আউটসোর্সিং, ফিক্সড টার্ম শ্রমিক এবং দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা। যারা শ্রম আইনের আওতার বাইরে থাকবে। মালিক শ্রেণিকে খুশি করতে সরকার ইন্সপেকশন, ভিজিলেন্সও তুলে দিয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকারের আসল মালিক কারা!
এ আই ইউ টি ইউ সি-র সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং পিএফ অছি পরিষদের সদস্য কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্য বলেন, পিএফ-এর সুদ কমানো, নূ্যনতম পেনশন না বাড়ানোর বিরুদ্ধে আমাদের তীব্র প্রতিবাদ ও আপত্তি সরকার কানেও তোলেনি। বঞ্চিত হল শ্রমিকরা। তাঁদের ভবিষ্যনিধির সঞ্চয়ে কোপ পড়ল।
১৯৫২ সালে পিএফ আইনেই বলা হয়েছিল যে, শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়েছিল, এটা শ্রমিকদের কষ্টার্জিত সঞ্চয়। একজন শ্রমিকের যদি দশ হাজার টাকা মজুরি হয়, তা হলেও তাকে মাসে ১২ শতাংশ অর্থাৎ ১২০০ টাকা বাধ্যতামূলক সঞ্চয় হিসাবে পিএফ-এ টাকা জমা রাখতেই হবে। অর্ধভুক্ত থেকে বা জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনগুলিকে কাটছাঁট করেও তাই টাকা তাকে জমা রাখতে হয়। এ জন্য পিএফ-এর এই সঞ্চয়ের সাথে অন্যান্য উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের কোনও তুলনাই চলে না এবং এই কারণেই এর সুদ কমানো চলে না।
যতদূর সম্ভব সর্বোচ্চ সুদ শ্রমিকরা পেতে থাকলেই সামাজিক সুরক্ষা অর্থবহ হতে পারে। অথচ সরকার সেই সুদে বা সঞ্চয়েই কোপ মারছে এবং পুঁজিপতিদের নানা ছাড় দিচ্ছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সরকারের এই শ্রমিক স্বার্থবিরোধী নীতিকে আড়াল করতে গিয়ে, ব্যাঙ্কের সঞ্চয়, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি অন্যান্য উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের সুদের হারকে গুলিয়ে দিয়ে চালাকির সাথে মানুষকে বোকা বানাতে চাইছেন। সরকারের এই নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি চূড়ান্ত জনস্বার্থ বিরোধী পুঁজিবাদী নীতি–যা শ্রমিক কল্যাণের নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এর সুরাহা হবে না। একমাত্র সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনই পারে শ্রমিক শ্রেণিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে। এই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির কঠিন সময়ে সঞ্চয়ের সুদে এবং পেনশনে আঘাতের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করেই সরকারের স্বৈরাচারী পদক্ষেপের মোকাবিলা করতে হবে।