নানা কিসিমের নির্দেশাবলি জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার উচ্চশিক্ষায় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ চালু করার প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত আছে। ইউজিসি, এআইসিটিই প্রভৃতি উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থার মাধ্যমেই একাজ চলছে। কিন্তু বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন কোনও কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থা তাদের হাতে নেই, যা দিয়ে সরাসরি তারা হস্তক্ষেপ করতে পারে। ফলে তারা নতুন ফন্দি এঁটেছে। ‘পিএম শ্রী’ নামে একটি নতুন প্রস্তাব তারা রাজ্যগুলোকে দিয়েছে। প্রস্তাবটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল–দেশের ১৪,৫০০ স্কুলকে তারা মডেল স্কুলের পর্যায়ে উন্নীত করবে, রাজ্যগুলির সঙ্গে পরামর্শ করেই তা করবে এবং তার জন্য ২৭,৩৬০ কোটি টাকা খরচ হবে। এই অর্থের ৬০ শতাংশ-র দায়ভার কেন্দ্রের, বাকি ৪০ শতাংশ রাজ্যের। স্কিম চালু হওয়ার প্রথম ৫ বছর কেন্দ্রীয় আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাবে, তারপর সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাজ্যের। প্রত্যেকটি ব্লকে অন্তত ২টি করে এমন স্কুল হবে। এই স্কুলগুলিতে ‘স্মার্ট’ শ্রেণিকক্ষ থাকবে, ডিজিটাল লাইব্রেরি থাকবে, উন্নত শিক্ষণ পদ্ধতি থাকবে ইত্যাদি অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ১৮ লক্ষ পড়ুয়া ভর্তির সুযোগ পাবে, কেন্দ্রীয় আর্থিক অনুদান সরাসরি স্কুলে পৌঁছাবে। কিন্তু ঝুলিথেকে বেড়াল তখনই বেরিয়ে পড়েছে, যখন বলা হয়েছে সেই রাজ্যগুলিতে তারা এই প্রকল্প চালু করবে যারা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ পুরোপুরি ভাবে চালু করার সম্মতি জানাবে। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোকে আর্থিক প্রলোভন দেখাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এতবড় নির্লজ্জতা এর আগে দেখা যায়নি।
কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশের শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-ছাত্র-অভিভাবক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রেমী জনসাধারণের মতামত পদদলিত করে যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ কার্যকর করছে তা সরকারের একের পর এক পদক্ষেপ থেকে পরিষ্কার। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের দুইটি ঘোষণা এই বিষয়টিকে আরও সুস্পষ্ট করেছে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বহুমুখী (মাল্টিডিসিপ্লিনারি) শিক্ষালয়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। গাইডলাইনটিতে যা আছে তা হল– ১) উচ্চশিক্ষার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে– (ক) বহুমুখী গবেষণা ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়, (খ) বহুমুখী শিক্ষণ ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়, (গ) ডিগ্রি প্রদানকারী স্বশাসিত বহুমুখী কলেজ। অর্থাৎ দ্বিতীয়ত ও তৃতীয় পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষণার সযোগ থাকছে না। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে গবেষণার সুযোগ না থাকলে তা জ্ঞানের বিকাশের পরিপূরক হয় না। স্বভাবতই গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির কৌলিন্য ও বাজার মূল্য বেশি হবে। ফলে উচ্চশিক্ষায় তিন ধরনের নাগরিক তৈরি হবে এবং তাতে বৈষম্য বাড়বে। তা কখনওই কাম্য হতে পারে না।
২) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির হার (জিইআর) ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ করার লক্ষ্যে অনলাইন ও দূরশিক্ষায় (ওডিএল) ভর্তির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ভর্তির হার হয়ত বেশি দেখানো যাবে, কিন্তু তাতে প্রকৃত শিক্ষালাভ সম্ভব হবে না।
৩) গুচ্ছ কলেজ (ক্লাস্টার অফ কলেজ) তৈরির নামে অনেকগুলো কলেজকে মিলিয়ে দিতে চাইছে। তার মাধ্যমে সরকার গুচ্ছ কলেজগুলির পরিকাঠামোকে একটি কলেজের পরিকাঠামো হিসাবে দেখাতে চাইবে। তাতে কলেজের পরিকাঠামো বৃদ্ধির দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে না। এই পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় সরকারের শঠতারই প্রকাশ।
৪) অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট (এবিসি) চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়ার পর ছেড়ে দিয়ে আবার অন্য একটি উচ্চশিক্ষালয়ে ভর্তি হতে পারবে। এইভাবে বহু বার ভর্তি হবে, আবার ছেড়ে দেবে। এমন করে বহু বছর ধরে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে একটু একটু করে ক্রেডিট সংগ্রহ করবে। সেই ক্রেডিট ‘ব্যাঙ্কে'(!) জমা হয়ে থাকবে। মোট ক্রেডিট নিয়ে সেই ছাত্র ডিগ্রি অর্জন করবে। এর ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং আসলে ডিগ্রির অবমূল্যায়ন হবে।
সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর পিএম শ্রী স্কুল ও তথাকথিত বহুমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছেন, বহুমুখী শিক্ষার নামে কেন্দ্রীয় সরকার পদার্থবিদ্যার সঙ্গে ফ্যাশান ডিজাইন বা রসায়নবিদ্যার সঙ্গে অর্থনীতি পড়ার ব্যবস্থা করবে যা সম্যক জ্ঞান গড়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তিনি আরও বলেন, দেশে প্রধানমন্ত্রীর নামে স্কুল-প্রকল্প চালু করার কোনও নজির নেই। এই সব স্কুলের শিক্ষণ পদ্ধতি পরীক্ষামূলক করার নামে শিক্ষার গৈরিকীকরণ থেকে শুরু করে, ইতিহাস বিকৃতি, বিজ্ঞানের বিকৃতি প্রভৃতি চর্চার আশঙ্কা থাকবে। তিনি এই দুই প্রস্তাব এবং তার সাথে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সার্বিকভাবে বাতিল করার দাবি জানান।