পাশ–ফেল পুনঃপ্রবর্তন সংক্রান্ত বিল আগামী জুলাই মাসে সংসদের বাদল অধিবেশনে পেশ হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর৷ তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল ফিরবে৷ কেন পাশ–ফেল ফেরানো উচিত সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, পাশ–ফেল প্রথা না থাকাতে শিক্ষার মান নেমে গিয়েছে৷ তথ্য দিয়ে বলেছেন, গোটা দেশে ২২ লক্ষ পড়ুয়ার উপর সমীক্ষা করে দেখা গেছে, ‘ক্লাস এইটের পড়ুয়া তৃতীয় শ্রেণির অঙ্ক করতে পারছে না৷ সাবলীলভাবে একটা গোটা ইংরেজি বাক্য পড়তে গিয়েও হোঁচট খাচ্ছে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী’৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত নভেম্বরে সরকারি উদ্যোগে এই সার্ভে করা হয়েছিল তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির ২২ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, সমীক্ষা ক্ষেত্র প্রসারিত করলে একই নৈরাশ্যজনক চিত্র পাওয়া যাবে অন্যান্য ক্লাসেও৷
কিন্তু কীসের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছেন, শুধুমাত্র পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল ফেরালে শিক্ষার মান তরতরিয়ে উঠবে? প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাশ নম্বর না পেলেও উত্তীর্ণ হওয়ার মহা সুযোগ রেখে দিলে ওই ফাঁক দিয়েই কি শিক্ষার মান নামবে না? এটা কি শিক্ষার মান ফেরানোর যথার্থই আন্তরিকতার পরিচয়? শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে শেখার যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে৷ তার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, সিলেবাস আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করতে হবে, এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ছাত্ররা বোঝে, না শিখে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না৷ এটাই তো মূল্যায়ন৷ পাশ নম্বর না পেলেও পাশ করিয়ে দেওয়ার যে মারাত্মক ভ্রান্ত নীতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিদ্যাদিগ্গজ পণ্ডিতরা বাতলেছেন, তার ফলেই শিক্ষার মান নেমেছে৷ সেই ভ্রান্ত নীতি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ না করে, ৮টি ক্লাসের মধ্যে ৬টিতে তা বহাল রেখে দিয়ে মাননীয় মন্ত্রী কী করে শিক্ষার মান ফেরাবেন?
পাশ–ফেল ফেরানোর যে কথা মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তা এসইউসিআই (সি)–র দেশজোড়া আন্দোলনের ফল৷ এটা এসইউসিআই (সি)–র দীর্ঘ আন্দোলনের ন্যায্যতারই প্রমাণ এবং জয়ের গুরুত্বপূর্ণ দিক৷ লক্ষণীয় হল, এসইউসিআই (সি) ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক দল এই দাবিতে আন্দোলন করেনি৷ ১৯৮১ সালে পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন সিপিএম সরকার চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেয়৷ ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল সরকার কেন্দ্রীয় আইনের অজুহাত দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেয়৷ এই সময় কংগ্রেস, বিজেপি সহ ভারতে যত জাতীয় বা আঞ্চলিক দল রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল তারা সকলেই পাশ–ফেল প্রথা তুলে দেয়৷ পাশ–ফেল বিতাড়ন পর্বে বাম–ডান নির্বিশেষে সব দল একই অবস্থান নেয়৷ কিন্তু প্রকৃতিতে নিয়ম বিরুদ্ধ কাজের যেমন কুফল ভুগতে হয় তেমনি সমাজেও, যা আজ সকলেই গভীর উদ্বেগে লক্ষ করছেন৷
আজ কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা, রাজ্য সরকারগুলির কর্তারা পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার পরিণাম বোঝার জন্য রাজকোষের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সমীক্ষক বসাচ্ছেন৷ কিন্তু একেবারে সূচনাপর্বে কোনও সমীক্ষা ছাড়াই এসইউসিআই (সি) কীসের ভিত্তিতে বলেছিল এর পরিণাম হবে ভয়াবহ? বলেছিল, মার্কসবাদী বিচারধারা প্রয়োগের মধ্য দিয়েই৷ দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদরা শিক্ষার যে কাঠামো এতদিন গড়ে তুলেছেন তার চিন্তাগত ভিত্তিটি ছিল জনস্বার্থে গুণগত শিক্ষা প্রদান করা৷ কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যতই বাজার সংকটে পড়তে থাকে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ততই এই চিন্তা থেকে সরতে থাকে৷ ততই বিনিয়োগের নতুন নতুন বাজার হিসাবে শিক্ষা, চিকিৎসা সহ সরকারি উদ্যোগে চলা বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রকে বেছে নেয়৷ এ ক্ষেত্রে সরকার পুঁজিপতিদের পাশে দাঁড়ায়৷ সরকার পরিকল্পিতভাবে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মান ধসিয়ে দেওয়ার জন্য যা যা করণীয় সবই করতে থাকে যাতে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার দিকে মানুষ যেতে বাধ্য হয়৷ এই পরিকল্পনার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল পাশ–ফেল তুলে দেওয়া৷ এবং লক্ষণীয় পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার পরই এ রাজ্য সহ সারা দেশে বেসরকারি স্কুল খোলার হিড়িক পড়ে যায়৷
পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণির শুধু অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না, ছাত্রদেরকে প্রায় অশিক্ষিতের মতো করে রাখা বা কার্যকারণ সম্পর্ক বোঝার ক্ষমতা তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে না দেওয়াও ছিল সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য৷ টলস্টয়ের ভাষায়, ‘জনগণের অজ্ঞতাই সরকারের শক্তির উৎস’৷ ফলে শাসকরা প্রকৃত শিক্ষার বিরোধিতাই করে৷ অটোমেটিক প্রোমোশন থাকলে ছাত্র যে কিছুই শিখবে না এটা সরকার ভাল করেই জানে৷ সরকার এও জানে, এই ছাত্ররা ভবিষ্যৎ জীবনসংগ্রামে দাঁড়াতে পারবে না৷ সরকার জেনেশুনেই তো এটা করতে চেয়েছে৷ এটাই তার শ্রেণি উদ্দেশ্য৷
শিক্ষার মানের যে অবনমন নিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেই অবনমন রুখতে হলে পাশ–ফেল চালুর পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে, তা হল, পরীক্ষার প্রশ্ণপত্রের ধাঁচের পরিবর্তন৷ অধিক নম্বর পাইয়ে দেওয়ার আদিখ্যেতায় যেভাবে এম সি কিউ টাইপ প্রশ্নের আধিক্য ঘটছে এবং বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন বিদায় নিচ্ছে তাতে পড়ুয়াদের বিশ্লেষণী ক্ষমতার বিচার হবে কী করে? বিশ্লেষণী ক্ষমতা গড়ে উঠবে কী করে? সম্প্রতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কৃতী পড়ুয়াদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, অন্য বোর্ডের মতো এ রাজ্যের পড়ুয়ারাও যেন বেশি নম্বর পায়৷ মুখ্যমন্ত্রীর এ কথার তাৎপর্য কী? নম্বর দেওয়ার দায়িত্ব কি শিক্ষামন্ত্রীর, না কি কে কত নম্বর পাবে তা ঠিক হবে পড়ুয়াদের লেখা উত্তরের ভিত্তিতে? এগুলি হল সস্তা চমক৷ বেশি নম্বর পাইয়ে দেওয়ার দ্বারা কি শিক্ষার মান বাড়তে পারে?
সরকার আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে অর্থাৎ মূর্খ করে রাখতে চায়৷ অন্য দিকে সমাজের সচ্ছল একটি অংশকেই কেবল শিক্ষার সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনে, তাদের মুনাফাভিত্তিক ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে কিছু আমলা, যন্ত্রবিদ, হিসাবরক্ষক প্রভৃতি তৈরি করতে চায়৷ অর্থাৎ একটি দেশের মধ্যে দুটি দেশ, একটি জাতির মধ্যে দুটি জাতি–শাসক ও শাসিত তৈরি করতে চায়, তাই সরকার সমীক্ষার নাম করে, নানা মিটিং–এর নাম করে বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে, অথচ পাশ–ফেল চালুর সিদ্ধান্তটি কার্যকর করছে না৷ সরকারের এই ভণ্ডামি গণআন্দোলনের পথেই রুখতে হবে৷ গত ৮ থেকে ২২ জুন পক্ষ কাল ধরে এসইউসিআই (সি) প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল চালুর দাবিতে বিশেষ প্রচারাভিযান চালিয়েছে৷ জুলাইয়ে যে বিলটি সংসদে উত্থাপিত হতে চলেছে তাতে প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেলের নিদান না থাকলে আন্দোলন তীব্রতর হবে৷ আমরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আবারও বলছি, শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটাতে হলে, প্রথম থেকে অষ্টম প্রতিটি ক্লাসেই পাশ–ফেল ফেরাতে হবে৷
এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে৷ শিক্ষা যুগ্ম তালিকা ভুক্ত৷ কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রীও ইতিপূর্বে বলেছেন, রাজ্যও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ আমরা মনে করি, কেন্দ্রীয় আইনের দোহাই দিয়ে যে তৎপরতায় রাজ্য সরকার পাশ–ফেল তুলে দিয়েছে, ততোধিক তৎপরতায় যুগ্ম তালিকার ভিত্তিতে রাজ্য সরকারকে পাশ–ফেল চালুর বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে৷
(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)