স্কুল স্তরে পাশ-ফেল প্রথা না থাকলে শিক্ষা-ব্যবস্থার বর্তমান পরিকাঠামোয় বেশিরভাগ ছাত্র যে কিছুই শেখে না, এই সত্য বহুবার তুলে ধরেছেন অসংখ্য শিক্ষাবিদ। রাজনৈতিক দল হিসাবে এস ইউ সি আই (সি) ধারাবাহিক ভাবে আন্দোলন করে গেছে পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার দাবিতে। আন্দোলনের চাপে কিছুটা হলেও পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনতে সরকার বাধ্য হয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আবার রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের ঢালাও নম্বর দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। তা নিয়ে শিক্ষাবিদরা উদ্বিগ্ন। কারণ এর ফলে মার খাবে শিক্ষার মান। এই উদ্বেগ যে কতটা সত্য, এবার সরকারি সমীক্ষাতেও তা উঠে এল।
ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন (ইউডিআইএসই)-এর করা সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২০১৬-‘১৭-এর পর থেকে ২০২১-‘২২ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিকস্তরে ধারাবাহিকভাবে পাশের হার বেড়েছে। জেনারেল ক্যাটিগরির ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি, এসসি, এসটি, ওবিসি শ্রেণিভুক্ত ছাত্রছাত্রীর পাশের হার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। অপর একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ওই সময়ে একই ক্লাসে থেকে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমেছে। মাত্র ১ শতাংশের় কাছাকাছি ছাত্রছাত্রী পরপর দু-বছর একই ক্লাসে থেকেছে।
সরকারি নেতামন্ত্রীরা প্রচার করবেন, এটি একটি অগ্রগতি। কিন্তু সেই সঙ্গে অপর একটি সমীক্ষা রিপোর্ট দেখাচ্ছে, ২০১৭-১৮-র তুলনায় ২০২১-২২ সালে অষ্টম এবং দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার মান কমেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা এনসিইআরটি পরিচালিত ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রতিটি ক্লাসে বেশিরভাগ পাঠ্যবিষয়েই ছাত্রছাত্রীদের ফল খারাপ হয়েছে। এই পরীক্ষা অনুসারে দশম শ্রেণির বিজ্ঞান পরীক্ষায় জেনারেল শ্রেণিভূক্ত (জাতিগত সংরক্ষণের আওতায় না থাকা) ছাত্রছাত্রীদের গড়ে ৩৪ নম্বর কমেছে।
এসসি, এসটি, ওবিসি শ্রেণিভুক্তদের গড়ে কমেছে যথাক্রমে ৪৫, ৪৮ এবং ৪০ নম্বর। অষ্টম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গড়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কমেছে ১৬ নম্বর। এসসি, এসটি এবং ওবিসি শ্রেণিভুক্তদের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ২৭, ২৭ এবং ২৩ নম্বর করে গড়ে কমেছে। অষ্টম এবং দশম উভয় শ্রেণির ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান, গণিত, সমাজবিজ্ঞান এই বিষয়গুলিতে একই ধরনের অবনমন চোখে পড়ছে। একমাত্র জেনারেল এবং ওবিসি ছাত্রছাত্রীদের অষ্টম শ্রেণির ভাষা ছাড়া সর্বত্রই এই অবনমন স্পষ্ট। অর্থাৎ ২০১৭-‘১৮ সালের তুলনায় ২০২১-এ পাশের হার অনেকটা বাড়লেও শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়নি, বরং কমেছে।
ভারতে এমনিতেই চরম সংকটগ্রস্ত বুর্জোয়া অর্থনীতি করোনা মহামারির ধাক্কায় আরও সংকটগ্রস্ত হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাড়-জিরজিরে চেহারা যেমন আরও বেআব্রু হয়ে পড়েছে, ঠিক তেমনই সংকটের থাবা শিক্ষা ব্যবস্থার উপরেও পড়েছে। সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে অনলাইন শিক্ষা, ডিজিটাল শিক্ষার কথা প্রচার করেছে। দীর্ঘ দুই বছর করোনা মহামারির জন্য ক্লাসরুম শিক্ষা বন্ধ রেখে ভার্চুয়াল মোডে পড়াশোনা চলেছে। যদিও তার সুযোগ নিতে পেরেছে ছাত্রছাত্রীদের ছোট একটি অংশই। সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে ব্লেন্ডেড মোডে অর্থাৎ ক্লাসরুম-ভিত্তিক শিক্ষাদানের সাথে কম্পিউটার, ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইন শিক্ষা দেওয়ার কথা বলছে।
সেই সঙ্গে পাশ-ফেল কার্যত তুলে দিয়ে, অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে ঢালাও পাশ করিয়ে শিক্ষার ‘অগ্রগতির’ মিথ্যা রিপোর্ট পরিবেশন করেছে তারা। এখন সরকারি সমীক্ষাই সরকারের প্রচারের সেই ঢাক ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র বিরোধিতা করতে গিয়ে ‘অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি’ সহ দেশের শিক্ষাবিদেরা বারবার যে সত্য তুলে ধরছেন, সরকারি সংস্থার সমীক্ষার ফলেও তার সমর্থন মিললেই সরকার যে নীতি পরিবর্তন করবে এমন আশা করা বৃথা। কারণ সরকারি গদিতে যে দলই থাকুক না কেন, দেশের আসল পরিচালক একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে শিক্ষাব্যবস্থায় মুনাফা লুটের জন্য তারা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার চেষ্টা করবেই। শিক্ষার এই অবনমন শিক্ষানীতিরই ফল। একে আটকাতে হলে জনবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতিকেই ছুঁড়ে ফেলতে হবে। প্রবর্তন করতে হবে জনমুখী শিক্ষানীতি।