নাম পাল্টানোর হিড়িক পড়েছে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যে। রং তুলি দিয়ে মুছে দেওয়া হচ্ছে অতীতের সব নামধাম। উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদের নাম পাল্টে করেছে প্রয়াগরাজ। মুঘলসরাই রেলওয়ে জংশনের নাম পাল্টে করেছে দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন। ফৈজাবাদ স্টেশনের নাম পাল্টে করেছে অযোধ্যা ক্যান্টনমেন্ট। মধ্যপ্রদেশের হাবিবগঞ্জ রেল স্টেশনের নাম পাল্টে করল রানি কমলাপতি স্টেশন।
কেন নাম পাল্টানো? এতে কি ওই এলাকার সাধারণ মানুষের কোনও উন্নতি ঘটবে? এর দ্বারা মূল্যবৃদ্ধি, বেকার সমস্যা, অপুষ্টি, অনাহার ইত্যাদি জনজীবনের গুরুতর সমস্যাগুলির কোনও পরিবর্তন ঘটবে? মুঘরসরাই স্টেশনে আগে যেমন পুঁজিবাদী শোষণে সবহারা মানুষের দল অনন্যোপায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করত, তা কি বন্ধ হবে দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন নাম করায়? নিরাশ্রয় হয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যারা রাতের প্রহরটুকু কাটাতে আসে, বা আসবে আগামী দিনে, সেই সব দরিদ্রদের আশ্রয় জুটবে? তাদের উপর পুলিশি হয়রানি বন্ধ হবে? এটা জানা কথা যে, কিছুই হবে না। বাস্তবে সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে এই ধরনের নাম পাল্টানোর কোনও সম্পর্ক নেই। তাহলে বিজেপি এটা করতে গেল কেন? এর পিছনে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে ভোটের নিখুঁত হিসাব। আর রয়েছে বিভেদের আগুন নিয়ে প্রাণঘাতী খেলা।
প্রতিটি জায়গায় নামকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইতিহাস জড়িয়ে থাকে। সেগুলো পাল্টানো শুধু ইতিহাস মুছে দেওয়া নয়, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো, যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে ভ্রান্ত ধারণা। হাবিবগঞ্জ স্টেশনটি ভোপালের ভূতপূর্ব বেগমের পৌত্র হাবিবুল্লার অর্থানুকূল্যে, তাঁরই জমিতে হয়েছিল। বিজেপি তা পাল্টেকরে দিল গোণ্ড জনজাতির রানির নামে। এর তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য বিজেপি থেকে মুখ ফেরানো জনজাতির মানুষদের কাছের লোক সাজতে চাওয়া। আর সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য হল আরএসএস উদ্ভাবিত হিন্দু-ঔদ্ধত্যবাদী সমাজ নির্মাণ। শোনা যাচ্ছে, ‘আজমগড়’কে পাল্টে করবে ‘আর্যমগড়’। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিম স্মৃতি দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে দুটো উদ্দেশ্য ওরা সফল করতে চায়। এক) মুসলমানদের সন্ত্রস্ত করে তোলা, যাতে তারা নিরাপত্তার জন্য বিজেপির দোরেই হত্যে দেয়। দুই) সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে প্রকৃত সমস্যা থেকে তাদের চোখ সরিয়ে দেওয়া।
এর দ্বারা হিন্দুধর্মাবম্বী সাধারণ মানুষের কী লাভ হবে? উগ্র ধর্মাভিমানের ফাঁদে ফেলে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে মানুষের জীবনের সব সঙ্কটকে সাময়িকভাবে হলেও ভুলিয়ে দেওয়ার এ এক মারাত্মক পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র। কোনও সচেতন মানুষ এ ফাঁদে পা দিতে পারেন? কোনও সুস্থ চেতনার মানুষ এই নিকৃষ্ট চর্চার বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে পারেন না।
ভোট রাজনীতির কী নিকৃষ্ট রূপ! কিন্তু সরকার এসব করতে পারছে কেন? এক অংশের মানুষও সহজেই এর মধ্যে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেই বা কেন? এই অংশের মানুষ ধর্মবর্ণ জাতপাতের সুড়সুড়িতে আচ্ছন্ন হয়ে যে মাঝে মাঝে মানুষ সত্তা হারিয়ে গোষ্ঠী চেতনায় সংকীর্ণায়িত হয়ে পড়ছে তার প্রথম কারণটি হল দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমাজের গণতন্ত্রীকরণের কাজটি সফল না হওয়া। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ধারা আপসমুখী হওয়ায় তৎকালীন নেতৃত্ব এই জরুরি সংগ্রামে গুরুত্ব দেয়নি। স্বাধীনতার পর এই জরুরি কাজটি কংগ্রেস সহ তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলি কেউই করেনি। সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব ছিল বামপন্থীদের। কিন্তু বড় বলে পরিচিত বামদলগুলি এই দায়িত্ব পালন না করে ভোটের হিসাব-নিকাশে সামিল থেকেছে।
দীর্ঘদিন ধরে বিজেপি দেখছে সংসদীয় সব দল ভোটের স্বার্থে কমবেশি ধর্মীয় মেরুকরণ ও জাতপাতের লাইনে হাঁটছে। পার্থক্য শুধু মাত্রায়, পরিমাণে। ‘সেকুলারিজম’ শব্দটি তোতাপাখির মতো আওড়ালেও এদের আচরণে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোথাও তার চিহ্নমাত্র নেই। ফলে যথার্থ বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন হলে, তার প্রভাবে জনমানসিকতার উত্তরণ ঘটার যে সুযোগ থাকে সেটাও অনুপস্থিত। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়েই ধর্মীয় বিভাজনের মারণ খেলা চালাতে পারছে তারা। না হলে জোরালো প্রশ্ন উঠত, নাম পাল্টে কী হবে, পাল্টাতে যদি চাও, পাল্টাও দেখি বেকারত্ব, দারিদ্র, মূল্যবৃদ্ধি! শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস হিসাবে বিজেপি সরকারের ভূমিকায় মানুষ ক্ষুব্ধ। এই অবস্থায় নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে বিজেপি সরকার নাম পাল্টানোর পথ নিয়েছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতিবাদই পারে এসব প্রতিরোধ করতে।