কেমন আছেন রাজ্যের পাথর খাদান অঞ্চলের শ্রমিকরা? বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার, মল্লারপুর, রামপুরহাট, নলহাটি, মুরারই ব্লকের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে উন্নত মানের কালো পাথরের বিশাল ভাণ্ডার। এই পাথরের নিচে আবিষ্কৃত হয়েছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক। এখানে মাটির উপরিভাগে রুক্ষ পাথরের জমি আর বনাঞ্চলে বসবাস কিছু হতদরিদ্র আদিবাসী ও নানা সম্প্রদায়ের গরিব মানুষের। এঁদের নামমাত্র মজুরিতে খাটিয়ে খাদান, ক্রাশার মালিকরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে।
এখানকার গরিব মানুষেরা অভাবের তাড়নায় তাঁদের জমি বিক্রি বা লিজ দিতে বাধ্য হচ্ছেন ওই মালিকদের কাছেই। তারপর জমি হারিয়ে তারা সেই জমিতেই দিনমজুরি করতে বাধ্য হচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এটাই দস্তুর। বৈধ খাদান, ক্রাশার থেকে রয়ালটি নিচ্ছে সরকার। আর অবৈধ খাদান– যার সংখ্যাই সব থেকে বেশি, সেখান থেকে নিয়মিত বিপুল অঙ্কের টাকা মাসোহারা নিচ্ছে শাসক পার্টির নেতা, অফিসাররা। কিন্তু শ্রমিকের দুরবস্থা দেখার তাদের সময়ও নেই, ইচ্ছাও নেই। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট, ওয়েস্ট বেঙ্গল ফ্যাক্টরিজ রুল, এসব আছে কিন্তু তা সবই খাতায়-কলমে, বাস্তবে প্রয়োগ নেই। শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা, শ্রমবিধি, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ভালো ভালো আইনের কথা লেখা আছে। কিন্তু তা কার্যকর করার কোনও দায় নেই প্রশাসনের। আর মালিকের তো প্রশ্নই আসে না। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার পাথর শ্রমিকের জীবনযন্ত্রণার ছবি এক কথায় বিভীষিকাময়।
শ্রমিকের পক্ষে কী কী আইন আছে তা অধিকাংশ শ্রমিকই জানেন না। শাসক দলের শ্রমিক ইউনিয়নগুলি শ্রমিকদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে এ সব জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। মালিকেরও তা মানার প্রয়োজন হয় না। শ্রমদপ্তর ঠাণ্ডা ঘরে বসে থাকে, এ বিষয়ে কখনও কোনও উচ্চবাচ্যও করে না। এখানে সরকার নির্ধারিত দৈনিক ন্যূনতম মজুরি দক্ষ শ্রমিকের ৭৫২ টাকা, অর্ধ দক্ষদের ৫৫২ টাকা, অদক্ষদের ৪৩৭ টাকা। কিন্তু কোথায় কী! নির্ধারিত মজুরির অর্ধেকেরও কম টাকায় তাদের খাটতে হয়। পিএফ, গ্র্যাচুইটি, নির্ধারিত হারে বোনাস, পেনশন এ সব তো তাদের কাছে স্বপ্ন! চাইতে গেলেই বরখাস্ত। কোম্পানিগুলিতে শ্রমিক হাজিরার ঠিকঠাক খাতাও নেই। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় ৪টি মাত্র কোম্পানিতে এ আই ইউ টি ইউ সি অনুমোদিত ইউনিয়ন আছে, যেখানে দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকের এই অধিকারগুলি আদায় হয়েছে। বাকি সমস্ত জায়গাতেই শ্রমিকদের করুণ দুর্দশা।
এই আর্থিক শোষণ-বঞ্চনার সাথে যুক্ত রয়েছে প্রাণহানিকর ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পাথর ক্র্যাশিং, ট্রাক-ডাম্পার লোডিং এবং চলাচলের সময়ে যে বিপুল পরিমাণ পাথরের গুঁড়ো, ধুলো-বালির ঝড় বয়ে চলে, সে অবস্থার ভয়াবহ দৃশ্য না দেখলে তা বোঝা কঠিন। কর্মরত শ্রমিক ছাড়াও ওখানে বসবাসকারী মানুষজনের অবস্থাও আরও সঙ্গীন। নাক-মুখ দিয়ে অবিরত শরীরে ঢুকছে সূক্ষ্ম পাথরের গুঁড়ো, ধুলোবালি। ফুসফুসে বাসা বাঁধছে মারণ রোগ সিলিকোসিস। জীবনের মেয়াদ শেষ করে দিচ্ছে দ্রুত তালে। কারওই কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। পরিবেশ দূষণ রোধের ব্যবস্থা তো দূরের কথা। মুখে একটা মাস্ক পর্যন্ত নেই। কিছু মানুষ কাজের সময় নাক-মুখ গামছা বা কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখেন। আবার অনেকে তাও রাখেন না। ওই পরিবেশে কাজ করতে করতে তাঁদের চেহারাগুলো যা, তা দেখলে তাঁদের প্রকৃত বয়স আন্দাজ করাও মুশকিল। ওরই মধ্যে চলে খাওয়া-দাওয়া। শিশুরাও বেড়ে উঠছে এই বিভীষিকাময় দূষিত পরিবেশের মধ্যেই। অল্প বয়সেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে তারা। স্বাস্থ্য পরীক্ষা, চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থাই নেই!
এসব ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কী? রাজ্যে মেডিক্যাল ইন্সপেক্টর অফ ফ্যাক্টরিজ-এর ৯টি পদের মধ্যে ৮টিই শূন্য। সরকারের দায়িত্ব এবং আন্তরিকতা সম্পর্কে কি এ তথ্যই যথেষ্ট নয়? কাছেপিঠে যে ব্লক হাসপাতালগুলি আছে কার্যত সেখানে চিকিৎসা পরিকাঠামো বলতে বিশেষ কিছু নেই। রোগী রেফার হয়ে যায় ২৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সিউড়ি সদর আর রামপুরহাট সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে।
সম্প্রতি এ রাজ্যে সিলিকোসিস রোগীদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের সরকারি নীতি নাকিঘোষিত হয়েছে। কিন্তু তার হদিস মেলে না। ফলে সাধারণ রোগীদের মতো সেখানে আবার তাদের রোগ নির্ণীত হয় হাঁপানি বা যক্ষ্মা বলে। সিলিকোসিস বলে নির্ণীত হওয়ার উপায় নেই। একান্ত আলোচনায় ডাক্তাররা ওই সমস্ত রোগীদের সিলিকোসিস রোগ নির্ণয় করার অসহায়তার কথা বলেন। কেন না সিলিকোসিস রোগীদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের দায়িত্ব পড়ে আইনত সরকারের ঘাড়ে। তাই প্রশাসনিক চাপের কাছে তারাও সত্য কথা বলেন না। এও এক মর্মন্তুদ চিত্র! আর এই পাকেচক্রে পড়ে অকালে অনেকেরই জীবনদীপ নিভে যাচ্ছে সকলের অলক্ষ্যে। এটাই এই এলাকার অভিশপ্ত নিয়ম। এই চিত্রই জেলার পাঁচামি, সালবাদরা, বড়পাহাড়ি, লখনামারা, বাহাদুরপুর, জিৎপুর, কল্যাণপুর, গোপালপুর সর্বত্র। এভাবেই অল্প কয়েক বছরের ভেতরে অকালে জীবনদীপ নিভেছে মুরারই ১ নম্বর ব্লকের বনরামপুর গ্রামের বকুল মাল (৩৫), বীরনগর গ্রামের নেপাল মাল (৩৯), মঙ্গল মাল (৩৯), লজেন মাল (৪১), শ্রীরামপুর গ্রামের আদল মাল (৪৫), শুকচাঁদ সেখ (৪২), নুটা সেখ (৩৮), রাজু সেখ (৩১), মানারুল সেখ (৩২), সাদেক সেখ (৫৫), পিরু সেখ (৩৮) সহ এমনই কত শ্রমিক। আবার অসুস্থ অবস্থায় রোজগার হারিয়ে বিনা চিকিৎসায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে ওই গ্রামগুলিরই আকবর সেখ (৩৫), তাসিরুল শেখ (৩৪), বাবর শেখ (৪৬), কার্তিক মাল (৪০), মতিবুর শেখ (৩৬)-দের মতো অসংখ্য শ্রমিককে।
ঠিকমতো অনুসন্ধান করলে অকালমৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের আরও ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠবে। টিভি টক শো আর খবরের কাগজে যারা সরকারের প্রশস্তিতে ভরে দেন এই সমস্ত এলাকায় কখনওই তাদের পদার্পণ ঘটেনি। ঘটলে এভাবে বলা সম্ভব হত না। কেন না এতটা অসত্য বলা সে ক্ষেত্রে তাদের পক্ষেও সম্ভব হত না বলেই মনে হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা আর তাদের বাঁচাতে সরকার কী কী করেছে এসব কথা শুনলে ওই এলাকার মানুষ বিদ্রুপের হাসি হাসে, কখনও বা ঘৃণা আর ক্ষোভ প্রকাশ করে মাত্র।
১৯৩২ সালে জোহানেসবার্গ সম্মেলনে এই সিলিকোসিস রোগটিকে ‘পেশাগত রোগ’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। আমাদের দেশে ১৯৫১ সালের শ্রম আইনে এই রোগটিকে ‘নোটিফায়েড ডিজিজ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু চিহ্নিত করা আর এই সর্বনাশা রোগকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ় এবং মানবিক পদক্ষেপ নেওয়া ভিন্ন কথা। এই প্রশ্নে কোনও সদর্থক ভূমিকা না কেন্দ্রীয় সরকার, না রাজ্য সরকারগুলি গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সাবধানবাণীকে কোনও পাত্তা না দিয়েই চলছে পাথর খাদান, বালি খাদান, সিমেন্ট কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র (বিশেষত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই), বিভিন্ন খনি, স্টিল কারখানা, তামাকজাত দ্রব্যের কারখানা, বাজি কারখানা, স্পঞ্জ আয়রন কারখানা।
আর এই সব কারখানার কোটি কোটি শ্রমিক নানা ধরনের পেশাগত রোগের শিকার হচ্ছে মারাত্মকভাবে। সারা দেশে কয়েক কোটি মানুষ পেশাজাত রোগের শিকার। দিনে দিনে তারা কাজ-শরীর-স্বাস্থ্য খুইয়ে মৃত্যুর মুখে পড়ছে। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রই বটে! ভয়ঙ্কর দুর্মূল্যের বাজারে বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে এই জীবনের বাইরে যে আর কিছু চাওয়া যায় এটাই তাঁরা এখনও জানেন না। দেড়শো বছর পূর্বে মহান এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির দুরবস্থা। মর্মস্পর্শী ভাষায় তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। দেখিয়েছিলেন আগামী দিনে অর্থাৎ আজকের সমাজে শ্রমিক শ্রেণির জীবনে পুঁজিবাদী নিষ্পেষণ কী ভয়ঙ্কর চেহারা নিতে যাচ্ছে। চূড়ান্ত মুনাফালোলুপ এই পুঁজিবাদী সমাজের নির্মম শোষণ থেকে মুক্তির পথ ভোট-রাজনীতির মধ্যে নেই। প্রতিকারের পথ আছে শ্রমিকশ্রেণির সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্যে। কিন্তু আপসকামী ইউনিয়নগুলি এঁদের উপর শান্তির জল ছিটিয়ে বঞ্চনাকে ললাট লিখন হিসাবেই ভাবতে শিখিয়েছে। শ্রমিক সংগঠন এ আই ইউ টি ইউ সি এঁদের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে জাগরণী চিন্তা।
গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ৩ জুন ২০২২