এ কথা ঠিক, বিদ্যাসাগর উপনয়ন ধারণ, পিতা–মাতার শ্রাদ্ধ সবই করেছেন৷ কিন্তু বিদ্যাসাগরের জীবনীকার গোঁড়া হিন্দু বিহারীলাল সরকার আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘‘নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসাগর, উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন৷’’
ধর্ম বিদ্যাসাগরের জীবনকে কোনও মতেই প্রভাবিত করেনি৷ খোদ রামকৃষ্ণকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘তা তিনি (ঈশ্বর) থাকেন থাকুন, আমার দরকার বোধ হচ্ছে না৷ আমার তো কোনও উপকার হল না৷’’
রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর… আচারের যে হৃদয়হীন প্রাণহীন পাথর দেশের চিত্তকে পিষে মেরেছে, রক্তপাত করেছে, নারীকে পীড়া দিয়েছে, সেই পাথরকে দেবতা বলে মানেননি, তাকে আঘাত করেছেন৷ অনেকে বলবেন যে, তিনি শাস্ত্র দিয়েই শাস্ত্রকে সমর্থন করেছেন৷ কিন্তু শাস্ত্র উপলক্ষমাত্র ছিল, তিনি অন্যায়ের বেদনায় যে ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন সে তো শাস্ত্রবচনের প্রভাবে নয়৷’’
আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, একথা বোধহয় তোমরা জানো না ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আমাদের দেশে যখন ইংরাজি শিক্ষার প্রবর্তন হয়, তখন আমাদের ধর্মবিশ্বাস শিথিল হইয়া গিয়াছিল৷ যে সকল বিদেশীয় পণ্ডিত বাংলাদেশে শিক্ষকতা আরম্ভ করিলেন, তাঁহাদের অনেকের নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাস ছিল না৷ ডেভিড হেয়ার নাস্তিক ছিলেন, একথা তিনি কখনও গোপন করেন নাই, ডিরোজিও ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লবের সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার ভাব হৃদয়ে পোষণ করিয়া ভগবানকে সরাইয়া যুক্তির পূজা করিতেন৷ … চিরকাল পোষিত হিন্দুর ভগবান সেই বন্যায় ভাসিয়া গেলেন৷ বিদ্যাসাগর নাস্তিক হইবেন তাহাতে আর আশ্চর্য কি?’’
বিদ্যাসাগরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকার গভীর আক্ষেপের সঙ্গে লিখেছেন, ‘‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখকাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন?’’ উত্তর বিহারীলাল নিজেই দিচ্ছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর কালের লোক৷ কালধর্মই তিনি পালন করিয়া গিয়াছেন৷ ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে, হিন্দু ধর্মে আঘাত লাগিয়াছে৷’’ বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই কথা বলেছেন, ‘‘তাহার নিত্যজীবনের আচার ব্যবহার, ক্রিয়াকলাপ আস্থাবান হিন্দুর অনুরূপ ছিল না, অপরদিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের লক্ষণের পরিচয়ও কখনও পাওয়া যায় নাই৷’’
বিদ্যাসাগরের সহোদর শম্ভুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘অগ্রজ মহাশয় শৈশবকাল হইতে কাল্পনিক দেবতার প্রতি কখনই ভক্তি বা শ্রদ্ধা করিতেন না৷’’
সংস্কৃত কলেজের পঠনপাঠন সম্পর্কে ব্যালেন্টাইনের উত্তর দিতে গিয়ে বিদ্যাসাগর বলেন, ‘‘পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও হিন্দুশাস্ত্রের মধ্যে সব জায়গায় মিল দেখানো সম্ভব নয়৷ সম্প্রতি দেশে বিশেষ করে কলকাতায় ও তার আশেপাশে পণ্ডিতদের মধ্যে এক অদ্ভুত মনোভাব পরিস্ফূট হয়ে উঠেছে৷ শাস্ত্রে যার বীজ আছে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্বন্ধে তাদের শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত অর্থাৎ সেই শাস্ত্রের প্রতি তাদের বিশ্বাস আরো গভীর হয় এবং শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে৷ তাঁরা মনে করেন যেন শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে, বিজ্ঞানের জয় হয়নি৷’’
বিদ্যাসাগরের সময় থেকে আমরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে, হঠাৎ প্রাক–বিদ্যাসাগর, প্রাক–রামমোহন যুগে দেশকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার একটা ফ্যাসিবাদী চক্রান্ত প্রত্যক্ষ করছি৷ এটিকে প্রতিহত করতে আমাদের পাথেয় হোক বিদ্যাসাগরেরই কথা, ‘‘ধর্ম যে কী, তাহা মানুষের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোনও প্রয়োজন নাই৷’’
সুকুমার মিত্র, কলকাতা–১২৫
(বিদ্যাসাগরের জীবনসংগ্রাম সঠিকভাবে বুঝতে ২৫ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যসমৃদ্ধ এই চিঠিটি সহায়ক হবে মনে করে প্রকাশ করা হল৷)