কাশীর ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কথা কাটাকাটির বিবরণ লিখে গিয়েছেন তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন– ‘‘আমি বিশ্বেশ্বর মানি না… বিদ্যাসাগরের এই উক্তি তাঁহার নাস্তিকতার প্রমাণ দেয়৷ বিদ্যাসাগর আপন মত স্বাধীনভাবে বলিতে কুণ্ঠিত হইতেন না৷ আবার তিনি অপরকে স্বাধীন ও সঙ্গত মত প্রকাশে অকুণ্ঠিত দেখিলে প্রীতিলাভ করিতেন৷’’ এই প্রসঙ্গে বিহারীলাল একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, একদিন ভট্টপল্লীর মহামহোপাধ্যায় রাখালাদাস ন্যায়রত্ন, মহামহোপাধ্যায় শিবচন্দ্র সার্বভৌম, মধুসূদন স্মৃতিরত্ন ও পঞ্চানন তর্করত্ন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন৷ কথায় কথায় ধর্মের তর্ক উঠল৷ বিদ্যাসাগর বললেন, ‘‘দেখ, ধর্ম–কর্ম ওসব দল বাঁধা কাণ্ড, এই দেখ, মনুর একটি শ্লোক– যে নাম্য পিতরো যাত য মেন মাতাঃপিতমাহাঃ/তেনযায়াৎ সতাং মার্গং তেন গচ্ছানন দুষ্যতি (মনুসংহিতা)৷ অর্থাৎ পিতা–পিতামহ যে পথে চলিয়াছেন, সৎপথ অবলম্বন করিয়া সেই পথেই চলিবে, তাহাতে চলিলে দোষ হয় না৷ কেন বাপু, সৎ পথেই যদি চলিবে তবে আবার পিতা–পিতামহ কেন? দুই পথ না বলিলে দল রক্ষা হয় না, এই না? পাছে অপর জাতির সৎপথে লোক যায়, দল ভাঙিয়া যায়, এই জন্যই না মনু ঠাকুরকে এত মাথা ঘামাইতে হইয়াছে তাই বলি ধর্ম–কর্ম ওসব দল বাঁধা কাণ্ড৷’’
এই হলেন বিদ্যাসাগর, এক আধুনিক বস্তুবাদী ও মানবতাবাদী চরিত্র, পুরনো দিনের বস্তাপচা ধারণা ভেঙে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন৷ এই বিদ্যাসাগরের অমূল্য ব্যক্তিত্ব ক’জন মানুষ বুঝেছেন না হলে নবজাগরণের পীঠস্থান এই বাংলায় আজ তাঁর মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়!
দুশো বছর পেরিয়ে গেলেও যাঁরা তাঁর চিন্তাকে নিজেদের জীবনে পাথেয় করেছেন তাঁরা বিদ্যাসাগরের ছবি বুকে নিয়ে হাঁটছেন৷ আর তাঁর মূর্তি ভাঙতে যাদের হাত কাঁপে না, সেই ধর্ম–ব্যবসায়ীরা আসলে ভয় পায় তাঁর উন্নত চিন্তা ও আধুনিকমনস্কতাকে৷
গোপাল সিং
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়