প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত মোনালিসা ছবিতে সম্প্রতি কুমড়োর স্যুপ ছুঁড়ে মেরেছেন দুই মহিলা। চিৎকার করে বলেছেন—‘কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? শিল্প না স্বাস্থ্যকর ও সাশ্রয়ী খাবার? আমাদের কৃষি ব্যবস্থা অসুস্থ। কৃষকেরা কাজ করতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন।’
একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ফ্রান্সের সরকারের জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদ জানাতে এই পথ বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। প্রথমবার এমন ঘটল তা নয়। গত কয়েক বছরে ইউরোপের বেশ কয়েকটি শহরে রেনেসাঁস আমলের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত শিল্পকর্মে পচা আলু কিংবা টম্যাটো ছুঁড়ে বার বার প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে মানুষকে।
এইসব ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। বোঝা যায়, ভারতের মতো ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও সরকারের জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ জমা হচ্ছে সাধারণ মানুষের বুকে। রাষ্ট্রের শাসক পুঁজিমালিক ধনকুবেরদের মুনাফার স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার সরকারগুলি খেটে-খাওয়া মানুষের উপর নিষ্পেষণ ক্রমেই আরও জোরদার করছে। শ্রমিক-কৃষক স্বার্থবিরোধী কালা-আইন চালু করছে একের পর এক। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত তলানিতে পৌঁছচ্ছে। এর বিরুদ্ধে মানুষের মতো করে বাঁচার দাবিতে ইউরোপের দেশে দেশে একের পর এক উত্তাল আন্দোলনে ফেটে পড়ছে মানুষ। রেনেসাঁসের অনবদ্য অবদান মোনালিসার অনিন্দ্যসুন্দর ছবিটিতে কুমড়োর স্যুপ ছুঁড়ে দিয়ে ওই দুই প্রতিবাদী তাই বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সামন্তী যুগের অবসান ঘটিয়ে ‘সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা’-র যে স্লোগান দিয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই স্লোগান আজ কোথায় হারিয়ে গেল? ধনবান আর সর্বস্বান্ত মানুষের চরম আর্থিক বৈষম্যে প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশই তো জর্জরিত! কোথায় আজ মানুষে-মানুষে মৈত্রী? কোথায়ই বা মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি মানুষ? ওই দুই প্রতিবাদী হয়তো বলতে চেয়েছেন, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতেই নাভিশ্বাস উঠছে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের, মোনালিসার ছবির সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ কোথায় তাদের! যাবতীয় শিল্পকলা তো এখন মুষ্টিমেয় ধনবানের ভোগের বিষয়!
এই ঘটনা আবারও দেখিয়ে দেয়, ক্ষোভের পাহাড়ের উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে মেহনতি বঞ্চিত মানুষের বুকে। তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকার যতদিন না সুনিশ্চিত হয়, যতদিন না তাদের রুদ্ধ হয়ে থাকা সার্বিক বিকাশের রাস্তা খুলে যায়, ততদিন নানা পথে সেই ক্ষোভের আগুনের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকবে।
রাজীব সিকদার, কলকাতা