‘যা কহিলে সত্য হল গান্ধারী জননী…’ এই আক্ষেপ উক্তিটি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পরাজিত, হতাশ, অবসন্ন, ভগ্নদেহ স্বয়ং দুর্যোধনের৷ গান্ধারী তাঁর তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টির এবং অসামান্য মেধার দ্বারা আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন কুরক্ষেত্রের যুদ্ধের কী পরিণতি হতে পারে৷ বারংবার তিনি দুর্যোধনকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন, ঠিক একই রকম ভাবে বছর কয়েক আগেই দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা ভারতের অর্থনীতির আকাশের ঈশান কোণে এক চিলতে কালো মেঘ দেখতে পেয়েছিলেন৷ বারবার সতর্ক বার্তা প্রেরণ করেছিলেন৷ সেই মন্দার কালো মেঘ শুধু ভারতে নয়, সারা পৃথিবীর অর্থনীতির আকাশ ছেয়ে প্রলয় ঘন্টা বাজিয়ে দিয়ে গেছে৷
আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার তথা আইএমএফ–এর কর্ণধার ক্রিস্টালিনা জর্জিভা স্বীকার করে নিয়েছেন ২০১৯ সালে আর্থিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ার (ইকনমিক্যাল গ্রোথ স্লো ডাউন হওয়ার) সম্ভাবনায় বিশ্বের ৯০ শতাংশ এলাকাতেহ, প্রায় থমকে গিয়েছে বাণিজ্য৷ আমেরিকা, জাপান, ইউরোপ, চীন– আর্থিক কর্মকাণ্ড কমেছে প্রায় সর্বত্র, ভারত, ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর প্রভাব সব থেকে স্পষ্ট৷ চীনেও শ্লথ হচ্ছে বৃদ্ধি৷
শুধু গাড়ি শিল্পেই ভারতে কাজ খুইয়েছেন কয়েক লক্ষ কর্মী৷ পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন যে, গাড়ি থেকে বিস্কুট সমস্ত পণ্যের বিকিকিনি প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অর্থনৈতিক মন্দা মোটামুটি স্থায়ীভাবে জারি রয়েছে৷ এ জন্য পণ্য উৎপাদন ব্যাপক হারে সংকুচিত হচ্ছে৷ কল–কারখানায় লক–আউট, ক্লোজার নিয়মিত হয়ে পড়েছে৷ কোটি কোটি কর্মচ্যুত শ্রমিক মরিয়া হয়ে জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ এটি এখন দৈনন্দিন সাধারণ চিত্রপ্রবাহ৷
মাননীয়া অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনজি মোটর–ভেহিকেল ইন্ডাস্ট্রির মন্দাতে সরাসরি দায়ী করেছেন ভারতের ইয়ং জেনারেশন বা জেন ওয়াই–কে৷ তারপরে বিভিন্ন পত্র–পত্রিকাতে এই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা আমার চোখে পড়েছে৷ কিন্তু বড়ই আক্ষেপের বিষয় এই যে, কোথাও এই সংকটের কার্ল মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ অন্তত আমার চোখে পড়েনি৷ আমি অর্থনীতির লোক নই, পাশাপাশি মার্কসীয় তাত্ত্বিকও নই৷ একেবারে সাধারণ মানুষ৷ সাধারণ চোখে যা দেখেছি তাই লিপিবদ্ধ করছি৷
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬–’১৭ সালে ট্যাক্সি পরিষেবার জন্য দেড়লক্ষ গাড়ি বিক্রি হয়েছিল৷ ২০১৭–’১৮ সালে সংখ্যাটা ৭৫ হাজারে নেমে আসে৷ অর্থাৎ এক বছরে এক ধাক্কায় উৎপাদন সংকুচিত হয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ আঘাতটি বিশাল৷ পাশাপাশি, মনের মধ্যে আরও বেশ কিছু প্রশ্নমালা উঁকি মারে যেমন– ক) এই গাড়ি শিল্পের নানারকম যন্ত্রাংশ সরবরাহকারি সংস্থা যাকে সাধারণত অনুসারি শিল্প বলা হয়, সেখানেও নিশ্চয়ই ওই হ্রস্বমুখী উৎপাদন হারকে মাথায় রেখে নিজেদের উৎপাদনকেও অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে৷ সেই সংস্থাগুলিতেও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কর্মদিবস ও কর্মীসংকোচন হয়েছে–তা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গিয়েছে৷ শুধু পরিবহণ নয়, সব ধরনের উৎপাদন শিল্পেই কালো মেঘ ঘনিয়েছে৷
খ) যারা এই সব অনুসারি শিল্পে বিভিন্ন কাঁচামাল অর্থাৎ লোহা, আকরিক, ইস্পাত, কাস্ট আয়রন, নাইলন, রাবার টায়ার, ফোম, ফাইবার গ্লাস, কাঁচা সামগ্রী ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকেন তাদের খবর কে রাখে? সেখানেও সমানুপাতিক হারেই সরবরাহ সংকোচনের রেখাচিত্রটি নিম্নগামী হয়েছে৷ এই স্বাভাবিক সত্যটি বোঝবার জন্য আমাদের অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই৷ চোখ–কান খোলা থাকলেই যথেষ্ট৷
গ) আরও একটু পিছনে তাকালেই দেখা যাবে যে এইসব প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহকারী সংস্থার পিছনে রাসায়নিক সরবরাহকারি সংস্থার কত কর্মী কর্মচ্যুত হয়েছেন সে ব্যাপারে আমরা গাঢ় অন্ধকারে৷ যে কোনও শিল্পের মন্দাই একটা চেইন রিঅ্যাকশন রিফ্লেক্ট করে৷ এটা একটা প্যারাডাইম মাত্র৷ এই কর্মচ্যুত শ্রম–শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে যে পরিমাণ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন তার সঙ্গে পরিবারের ন্যুনাধিক পাঁচজন নির্ভরশীল ব্যক্তি হিসেব করলে আর্থিক ক্ষতির অভিঘাত–জর্জরিত মানুষের সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা পুঁজিপতিরা হিসেব কষে দেখছেন তো?
অর্থনীতির গভীরতর অসুখ এখন৷ প্রায় দুই শতক ধরে বুর্জোয়া শিল্পপতিরা, পুঁজিপতিরা যে লাগাতার নির্মম শোষণ এই বিশ্বের নাগরিক সমাজে চালিয়ে গেছেন তারই কদাকার রূপ হল সামগ্রিক শিল্পের ধ্বংসায়ন৷ পরিবহণ শিল্প তার একটা ছোট নমুনামাত্র৷ স্বর্ণ, বস্ত্রবয়ন, আবাসন, সমস্ত সেক্টরেরই এক হাল৷ একটু কান পাতলেই সর্বত্র তার হাহাকার শুনতে পাওয়া যবে৷ পুঁজি সেন্ট্রালাইজড হতে হতে এমন চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছে যে এখন আমজনতার হাতে কোনও উদ্বৃত্ত অর্থই নেই৷ যার ফলে জনতার কমছে সঞ্চয় এবং রাশ পড়ছে কেনাকাটায়৷ একটা মৌচাককে যদি গামছার মধ্যে ফেলে কষে নিংড়ানো যায় তার পরে কি আর তার কাছে এক বিন্দুও মধুর প্রত্যাশা করা যায়৷ ঠিক একরকমভাবে আমাদের সমাজ ট্রিকলড ডাউন ইকনমি বা চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতির হাতে পড়ে আক্ষরিক অর্থেই নিঃশেষিত৷ সামগ্রিক খোলনলচে বদলানো ছাড়া এর থেকে পরিত্রাণ নেই৷ অর্থনৈতিক সংস্কার নয়, চাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের বিপ্লব৷
মাননীয়া সীতারামনজি এটা হয়তো বুঝতে পারছেন না যে, ক্রমাগত পুঁজি কেন্দ্রীভূত হতে হতে এখন গতিহীনভাবে থমকে আছে৷ ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি তাঁর গবেষণাপত্র (ক্যাপিটাল ইন দ্য ফার্স্ট সেঞ্চুরি গ্রন্থের লেখক) সরাসরি দেখিয়েছেন ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য এখন গত ৯৬ বছরের মধ্যে সবথেকে বেশি৷ ‘ধনের ধর্মই অসাম্য’ শীর্ষক লোকহিত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল্যবান মন্তব্য আমরা যেন ভুলে না যাই৷ অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট তো বলছেই ভারতবর্ষের সব থেকে ধনী ১ শতাংশ পরিবারের হাতে কুক্ষিগত দেশের মোট সম্পদের অর্ধেকেরও বেশি৷ অর্থাৎ শোষণ এভারেস্টের চূড়া জয় করে ফেলেছে আর শোষণ করা যাচ্ছে না৷ এবার রেখাচিত্রকে নিচে নামতেই হবে৷
আমরা সাধারণ মানুষ বেশ বুঝতে পারছি যে, পুঁজিবাদী ডাক্তাররা রোগীর রোগ ধরতে পারছেন না৷ ফলে এলোপাথাড়ি নানা ওষুধের প্রেশক্রিপশন করে যাচ্ছেন৷ এই ভেবে যদি কোনওটা কাজে লেগে যায়৷ কখনও রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৫.১৫ শতাংশ তো, কখনও রিভার্স রেপো একই হারে ৪.৯০ শতাংশ৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০১৯ সালে পাঁচবার ঋণ নীতিতে সুদ কমালো, ভবিষ্যতে আরও কমানোর রাস্তা খুলে রাখল৷ কিন্তু রোগীর অবস্থা ক্রমশই শোচনীয় হচ্ছে৷ যার পরিণাম সমস্ত উৎপাদন ভিত্তিক শিল্পে ভাটার টান, পরিষেবা ভিত্তিক কর্মক্ষেত্রগুলি টিমটিমিয়ে বেঁচেবর্তে আছে৷ এরই প্রতিফলন ধরা পড়েছে মার্কিন কম্পিউটার ও প্রিন্টার প্রস্তুতকারক সংস্থায়৷ এইচ পি আগামী কয়েক বছরে বিশ্বজুড়ে তাদের মোট শ্রম সম্পদের ১০ শতাংশের বেশি কমাবে৷ তিন বছর আগে একই পদক্ষেপ করেছিল এইরকম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ভাবেই৷ অশোক লে ল্যান্ড ২০১৯–এর অক্টোবর মাসে তাদের বিভিন্ন কারখানায় ১৫ দিন পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ রাখবে৷ কারণ দেশজুড়ে সব ধরনের গাড়ির চাহিদা কম৷ বিক্রিতে ভাটা তাদেরও৷
২০১৭ সালে ক্রেডিট সুইস সংস্থা প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভারতের সব থেকে সম্পদশালী পরিবারটিকে প্রথম স্থানে রেখে অন্যপরিবারগুলিকে তাদের সম্পদের ভিত্তিতে ক্রমানুসারে সাজালে দেখা যাবে যে, ২০০২ থেকে ২০১২–এর মধ্যে এই ক্রমবিন্যাসের প্রথম ১ শতাংশ পরিবারের সম্পদ ভারতের মোট সম্পদের ১৫.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫.৭ শতাংশে৷ শেষ ৫০ শতাংশ পরিবারের সম্পদ ৮.১ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪.২ শতাংশ৷ ২০১৮–’১৯–এ সম্পদ বন্টনে বৈষম্যের চেহারা আরও ভয়াবহ৷ খেটে খাওয়া মেহনতি ভারতীয়ের হাতে ফুটো পয়সাটিও নেই৷
তামাম দরিদ্র বিশ্ববাসীর সমীপে আমার বিনম্র আবেদন, বিশ্বজুড়ে এই অর্থনৈতিক বেহাল পরিস্থিতি দেখে আপনারা মোটেও মুষড়ে পড়বেন না, বরং উল্লসিত হোন৷ কারণ শম্বুক গতিতে হলেও এই পুঁজি নিবিড় বুর্জোয়া অর্থনীতির ক্রমান্বয়ে মাল্টি–অর্গান ফেল করছে৷ কোনও ভেন্টিলেশনে একে বাঁচানো যাবে না৷ বুর্জোয়া অর্থনীতির চিতাভষ্ম থেকেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ফিনিক্স পাখি তার আগুনে–সোনালী ডানা আকাশে মেলে উড়বে৷ শুধু ধৈর্যে বুক বেঁধে তৈরি হোন৷ সে আসছে … সে আসছে… সে আসছে৷ সে খুব বেশি দূরে নেই৷ তার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে৷
বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য
কল্যাণগড়, উত্তর ২৪ পরগণা