কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে শিক্ষক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ থাকলেও সেই আইন মেনেই রাজ্যের তৃণমূল সরকার ‘রাজ্য শিক্ষানীতি ২০২৩’-এর মধ্য দিয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু করেছে সেমেস্টার প্রথা। এতদিন কলেজ স্তরে চালু থাকলেও এ বার উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলস্তরেও এই শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হচ্ছে এই প্রথা। ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডিএসও সহ বিভিন্ন স্তরের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ও বুদ্ধিজীবী মহল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুললেও তার কোনও তোয়াক্কা করেনি দুই সরকারই।
ঠিক কী কী অসুবিধা এই সেমেস্টার প্রথায়? প্রথমত, এই প্রথার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের যথার্থ, সুসংহত জ্ঞান অর্জনই সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের মনে পরীক্ষা ও নম্বর কেন্দ্রিক মানসিকতা এর মধ্যে দিয়ে বৃদ্ধি পাবে।
দ্বিতীয়ত, সেমেস্টার প্রথার মধ্যে একটি বছরকে দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতি সেমেস্টারে একটি করে পরীক্ষা হবে। প্রতি ছ’ মাস ১৮০ দিন হলেও নানা রকম ছুটিছাটার কারণে ক্লাস করার সুযোগ থাকে মাত্র ৮০-৮৫ দিন। এর ফলে ক্লাস শুরু হতে না হতেই একজন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য তৈরি হতে গিয়ে সিলেবাসের প্রতিটি বিষয়ের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। আবার, প্রথম ছ’মাসে শিক্ষার্থী যা শিখবে পরের ছ’মাসে শিক্ষণীয় বিষয় তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এর আগে বছরে একটি পরীক্ষা হত। মাঝে কয়েকটি ইউনিট টেস্ট হত। এতে শিক্ষার্থী বছরের শুরুতে যা শিখছে শেষে তা পুনরায় আরেকবার ঝালিয়ে নিতে পারত। এতে শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক শক্তির বিকাশের কিছুটা হলেও সুযোগ ছিল। কিন্তু সেমেস্টার প্রথায় সময়ের অভাবে বিষয়ভিত্তিক সামগ্রিক গভীর জ্ঞান শিক্ষার্থীদের পাওয়ার সুযোগ থাকছে না। দ্রুত সিলেবাস শেষ করতে গিয়ে অনেক বিষয় চাপা পড়ে যাবে। শুধুমাত্র পরীক্ষায় নম্বর তুলতে হবে এটি শিক্ষার্থীর চিন্তার মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে। এবং পরের সেমিস্টারে গিয়ে আগের সেমেস্টারে কী পড়েছে তা মনে থাকবে না।
তৃতীয়ত, এই সেমেস্টার প্রথায় থাকছে এমসিকিউ অর্থাৎ মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন। কয়েকটি উত্তর দেওয়া থাকবে, সঠিক উত্তরটির পাশে টিক দিতে হবে। ধরে নেওয়া যাক, দেওয়া হল ভূগোল শাস্ত্রের জনক এরোটোস্থেনিস-কে বলা হয়। শিক্ষার্থী এখানে সঠিক উত্তরের পাশে টিক দেবে। কিন্তু কী কারণে তাঁকে ভূগোল শাস্ত্রের জনক বলা হয়, তাঁর জীবনের সংগ্র্রাম প্রভৃতি যদি শিক্ষার্থী বাক্য গঠনের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে খাতায় লেখে তা হলে শিক্ষার্থীর ভাষায় দক্ষতা, মানসিক জ্ঞান এবং বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে। সেটাই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা এবং শিক্ষা সিলেবাস সম্পর্কে সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকে বলেন, শিক্ষার্থীরা এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট একটা নম্বর পাচ্ছে, সেটাই যথেষ্ট। কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধু নম্বর পাওয়া, নাকি ভাষায় প্রকাশ করার মাধ্যমে চিন্তার বিকাশ হওয়া?
পঞ্চমত, মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কোর্সের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের কোনও রকম শৃঙ্খলা আর থাকছে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান অপরদিকে পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, অঙ্ক এই বিষয়গুলি পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু এখন আর তা থাকছে না। ধরুন একাদশ শ্রেণিতে কোনও ছাত্র ইতিহাস ভূগোল এর সাথে অঙ্ক, সঙ্গীত এই বিষয়গুলি নিয়েছে। সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অপছন্দের বলে নিল না। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান সহযোগী করে ইতিহাসের যে গভীর জ্ঞান গড়ে উঠতে পারত এতে তা আর হবে না।
ষষ্ঠত, উচ্চমাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষার মতো স্কুলশিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটিও থাকছে না। যদিও বলা হয়েছে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির চারটি সেমেস্টার মিলে উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বর দেওয়া হবে।
সপ্তমত, বহু স্কুলে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় ক্লাসরুম নেই, নেই শিক্ষক ও যথেষ্ট পরিকাঠামো। আট বছর ধরে রাজ্যে উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষাই হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের পক্ষে এ রকম একটি সিলেবাস শেষ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অষ্টমত, প্রতি সেমেস্টারে দিতে হবে ভর্তির ফি, পরীক্ষার ফি। অর্থাৎ বাড়বে অতিরিক্ত ফি-এর বোঝা। বহু ছাত্র-ছাত্রী আছে তারা আর্থিক সঙ্গতির অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ শিক্ষা আর সবার জন্য থাকছে না। অর্থের বিনিময়েই মিলবে শিক্ষা, যা ইতিহাসগত ভাবে অনৈতিক। শিক্ষা হওয়া উচিত অবৈতনিক, গণতান্ত্রিক। ফলে সেমেস্টার সিস্টেম শিক্ষার সার্বজনীন চরিত্র যেটুকু টিকে আছে তাও ধ্বংস করবে।
এই সেমেস্টার প্রথায় পরীক্ষার মধ্য দিয়ে কেউ অনেক নম্বর পেতে পারে পরীক্ষার পর পরীক্ষা পাস করে অনেক বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করতে পারে। কিন্তু যথার্থ জ্ঞান, যথার্থ শিক্ষা এই প্রথার মধ্য দিয়ে পাওয়া সম্ভব কি? আজ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বেশি বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রদের জাতীয় স্তরে গড়ে ওঠা কোচিং মাফিয়াদের খপ্পরে পড়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খোয়াতে হচ্ছে। এই শিক্ষা সিলেবাস পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের ছাত্ররা যন্তে্র পরিণত হবে। সরকারের উচিত শিক্ষার সাথে যুক্ত শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীমহলের মতামত নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সিলেবাস পদ্ধতি চালু করা, যা যথার্থই প্রগতিশীল শিক্ষা এবং যা মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
বুদ্ধদেব রায়
ক্ষুদিরাম সরণি, কোচবিহার