গণদাবী ৭৫ বর্ষ ২৮ সংখ্যায় ট্রাম তুলে দেওয়ার খবরটি মন ছুঁয়ে গেল। প্রতিবেদনটি ট্রাম সংক্রান্ত বহু ঐতিহাসিক তথ্যকে আবারও সামনে আনল। ১৮৭৩ সালে কলকাতায় ঘোড়ায় টানা ট্রামের হাত ধরে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল গণ পরিবহণ ব্যবস্থা ট্রাম। সেই হিসেবে এ বছর ট্রামের যাত্রা ১৫০ বছরের। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরানো কলকাতা শহরের গণ পরিবহণে প্রায় অর্ধেক সময় ট্রাম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে।
অধুনা ভারতের অন্যান্য শহরে ট্রাম পরিষেবা অবলুপ্ত হলেও কলকাতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বহুকাল ট্রামের যাত্রা অটুট থেকেছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি শহরের মাত্র একটা কি দুটো রুটেই ট্রাম কোনও মতে টিকে রয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং উদ্বেগের কারণও।
আমি দক্ষিণ কলকাতার বেহালা ট্রাম ডিপো সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দা। ছেলেবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে ট্রামে চড়ে যাতায়াতও চলেছে। ১৯৮৯ সালে ঘটা করে বেহালা-জোকা নতুন ট্রাম রুটের পত্তন স্মৃতিতে উজ্জ্বল। দেখেছি ১৯৯১-এর বিধানসভা নির্বাচনে একেই প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার করে কীভাবে সিপিএম সরকার ভোট বৈতরণী উতরেছিল। এ কথাও ভোলার নয়, ২০১২ সালে জোকা-এসপ্ল্যানেড মেট্রোর দোহাই দিয়ে রাতারাতি চালু ট্রাম রুটকে বন্ধ করার উদ্যোগ। চালু ১০-১২টি ট্রামকে ভেঙে নষ্ট করে (পড়ূন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা সরকারি সম্পত্তি, সরকারি উদ্যোগেই নয়ছয় করে) সরিয়ে ফেলা হল। ট্রামের মান্থলি টিকিট কেটে বেহালা থেকে চৌরাস্তা বা ঠাকুরপুকুর যাতায়াত করে স্কুল-কলেজ জীবন কাটিয়েছি। বাবাকেও দেখেছি, মান্থলি টিকিট কেটে বেহালা-খিদিরপুর অফিস করতে। সাধারণ মানুষকে গণ পরিবহণে যে আর্থিক শোষণের শিকার হতে হয়, ট্রাম তার মান্থলি টিকিট সিস্টেমে আমাদের অনেকটাই আড়াল করে রাখতে পেরেছিল তার থেকে।
অনেকে বলেন, গতির যুগে ট্রাম হল একটি স্লথ পরিবহণ ব্যবস্থা। এর জন্যই কলকাতা শহরে ভয়ানক যানজট। সুপ্রাচীন কলকাতার মোট আয়তনের মাত্র ৬ শতাংশ রাস্তাঘাটের জন্য নির্দিষ্ট, যা বাড়ানো কোনওমতেই সম্ভব না হলেও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই সময় হাতে গোনা কয়েকটা ট্রাম রুট চালু থাকলেও কেন শহর যানজট মুক্ত হচ্ছে না, এর উত্তর কি? ট্রাম তার নির্দিষ্ট রুট ধরে চললে এবং পথে অন্যান্য গাড়ির বাধা না পেলে গন্তব্যে পৌছাতে তার খুব একটা বেশি সময় লাগতে পারে না। কাজেই, যানজটের জন্য ট্রামব্যবস্থা কখনই দায়ী নয়।
ক্রমেই বেড়ে চলেছে পরিবহণে গতির চাহিদা। সাথে সাথে বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে চলা যানবাহন থেকে নিঃসৃত দূষণের পরিমাণ। তাই উষ্ণায়ণ রোধে পরিবেশ বান্ধব বৈদ্যুতিক যান হিসাবে ট্রামের প্রয়োজনীয়তা আজ অনস্বীকার্য। অন্যদিকে ট্রাম পরিবহণের পরিকাঠামো বহু বছর ধরেই শহরে চালু রয়েছে। প্রয়োজন শুধু এই সুবিধা জনসাধারণকে দেওয়ার জন্য সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্যোগের। ট্রামের আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে সরকার চূড়ান্ত উদাসীন। বরং শহরের নানা স্থানে ট্রামগুমটির জন্য বরাদ্দ ও অবস্থানগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ জমিগুলি বেসরকারি প্রোমোটারদের হাতে তুলে দিয়ে টাকা রোজগারে তারা বেশি আগ্রহী। পৃথিবীর অন্যান্য শহরগুলিতে যখন ট্রামকে আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নত করে পরিবহণে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, আমাদের রাজ্যে সরকার তার বিপরীত অবস্থান নিচ্ছে।
তবে আশার কথা, পরিবহণে ট্রামের গুরুত্ব যথাযথ উপলব্ধি করে সচেতন নাগরিক সমাজের একাংশ শহরের সব ট্রাম রুটগুলিকে আবার চালু করার দাবিতে একত্রিত হতে শুরু করেছেন। আমি আশাবাদী পঞ্চাশের দশকের ঐতিহাসিক ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের মতো অদূর ভবিষ্যতে সংগঠিত আন্দোলনের দ্বারা সাধারণ মানুষ তাদের দাবি আদায়ে সক্ষম হবেন।
সুনন্দ ভট্টাচার্য
বেহালা ট্রাম ডিপো, কলকাতা-৩৪