১৪৪ বছর পর গ্রহ নক্ষত্র যোগে প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভ মেলা এখন মধ্যগগনে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগীজির সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদিজির বদান্যতায় ও মেলা কমিটির অকৃপণ আয়োজনে রাজকোষের মাত্র ৭,৫৩৫ কোটি টাকার অধিক খরচ করিয়া মহাকুম্ভের নামে ধর্মান্ধতার অন্ধমোহে নিবিষ্ট করিতে দেশে ‘হিন্দু জাগরণে’র ব্যবস্থাটি বেশ পাকাপোক্ত হইয়াছে। অথচ দুর্ভাগ্যের হইলেও ইহাই সত্য, কেন্দ্রীয় সরকার মাত্র ৫ কোটি টাকাও বিজ্ঞান চিন্তার প্রসারের লক্ষ্যে বিজ্ঞান কংগ্রেসের জন্য বরাদ্দ করিতে অপারগ। ফলে বিজ্ঞান কংগ্রেস বিগত দুই-তিন বছর যাবত বন্ধ হইয়া রহিয়াছে। সত্য সেলুকাস, বিচিত্র এই দেশ! মাস দুয়েক পূর্ব হইতে নবজাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান পশ্চিমবাংলাতেও এ রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ফাটল ধরাইবার উদ্দেশ্যে সর্বত্রই বিরোধী দলনেতার উদ্যোগে ‘বাংলার হিন্দু সমাজ এক হোক’ বাণীতে বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের বাংলা হইতেও কুম্ভযাত্রীর সংখ্যা নেহাত কম হয় নাই। ধর্মে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস যে কোনও স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিকের একান্তই ব্যক্তিগত। এ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্র, সরকার কিংবা কোনও রাজনৈতিক দলেরই উচিত নয়। এমনকি গণমাধ্যমগুলির পক্ষ হইতেও কোনও এক বা একাধিক ধর্মের প্রতি আকর্ষণ জাগানো সংবাদ প্রচার করা নীতিবিরুদ্ধ। অথচ স্বাধীনতার পর হইতেই আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঘৃণ্য পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘদিন ধরিয়া তাহা চলিতেছে। প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার অভাবে, জীবনের নানা সমস্যায় জর্জরিত নিরুপায় মানুষ ভাগ্য ও কপাল তত্ত্বে ভর করিয়া পাপমুক্ত হইয়া অলীক পুণ্যলাভের আশায় হাজারে হাজারে মহাকুম্ভে পাড়ি দিতেছে।
আরও লক্ষণীয়, মহাকুম্ভ সন্নিহিত বিশাল এলাকা জুড়িয়া, বেশ কয়েক মাস পূর্ব হইতেই আমিষ আহার ভক্ষণ ও বিক্রি বর্জনীয় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও ব্যক্তিই মেলা প্রাঙ্গণে ব্যবসা করিতে পারিবে না বলিয়া হুলিয়া জারি করা হইয়াছে। ফলস্বরূপ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ভক্তদের পুণ্যস্নানের পর উদরপূর্তির জন্য খাবার খুঁজিতে খুবই কষ্ট স্বীকার করিতে হইয়াছে। উত্তরপ্রদেশের ও কেন্দ্রের সরকারের পরিকাঠামো ও পরিবহণের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রচার, বাস্তবে বহুলাংশেই অসত্য। পুণ্যার্থীদের জন্য ব্যবস্থা আসলে প্রয়োজনের তুলনায় অতীব নগণ্য। ঘন্টায় পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দিয়া নাকি হোটেল এবং রিসর্টে ভক্তদের থাকতে বাধ্য করা হইয়াছে। ইতিমধ্যেই অস্থায়ী তাঁবুতে তিনটি জায়গায় আগুন লাগিয়া সব ভষ্মীভূত হইয়া গিয়াছে। বিশেষপুণ্যতিথিতে স্নানযাত্রার সময় অপরিকল্পিত উদ্যোগ ও ভিড়ের চাপে কয়েকশো মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়াছে। তাহার সংখ্যা ও ক্ষতিপূরণের টানাটানি লইয়া যোগী সরকার ল্যাজেগোবরে। যদিও মেলা উদ্যোক্তাদের মতে মৃত ব্যক্তিদের স্বর্গপ্রাপ্তি হইয়াছে, যাহা নাকি খুবই মঙ্গলসূচক ও কল্যাণকর!
সমাজমাধ্যমে বিগত কয়েকদিন ধরিয়া নানা ট্রেনে ব্যাপক ভাঙচুরের ভিডিও দেখা গিয়াছে। সেই ক্ষেত্রে মাথায় ফেট্টি বাঁধিয়া, হস্তে বৃহৎ বৃহৎ লোহার রড ও ইট লহিয়া মহিলাদের শাড়ি ধরিয়া টানিতেও দেখা গিয়াছে ভক্তদের। ট্রেনের কামরাতে ঢুকিয়া সাধারণ যাত্রীদের হেনস্তা করা, জিনিসপত্র কাড়িয়া নেওয়া, মারধর করা যেন কুম্ভফেরত বিজয়ীদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে! যদিও এই বিষয়ে রেলের মন্ত্রী-কর্তাব্যক্তিদের দেখভালের কোনও প্রশ্নই নাই। তাঁহারা চোখে ঠুলি পরিয়াছেন। প্রশ্ন উঠিতেছে, যাহারা ভারতীয় রেলের সম্পদ নষ্ট করিল, মহিলা-যাত্রীদের শ্লীলতাহানি করিল, সিসিটিভিতে সবকিছু ধরা পড়িলেও কেন তাহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা লওয়া হইল না? সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সেই ছবি দেখিলে মনে হইবে না যে রেল পরিষেবা নামক ব্যবস্থাটি আদৌ আছে। খবরে প্রকাশ, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লি স্টেশনে রেলকর্তাদের ভুল ঘোষণায় প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসিবার গুজবে কেবল ভিড়ের চাপে ১৮ জনের মৃত্যু হইয়াছে।
যদিও কয়েক দিন পূর্বেই বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে অবিশ্বাসী রামমন্দিরের প্রধান পূজক পুরোহিত বাঁচিবার শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে নামকরা হাসপাতালে চিকিৎসা লইয়াই ‘পরলোকগমন’ করিয়াছেন!
স্বপন জানা, মেছেদা