আসুন, যে মানুষ বিবেক হারিয়েছে, তার জন্য আমরা অনুশোচনা করি! পেট বড় বালাই, কিন্তু তা যদি গোটা বিবেকটাকেই গিলে ফেলে, সে তখন এক মস্ত বিড়ম্বনা। তখন তার মন নেই, অনুভূতি নেই, যুক্তিবোধ নেই, মূল্যবোধ নেই, মানবসভ্যতার যে মহৎ সম্পদ বন্য পশুত্বের উপর মানবতার সুমহান বিজয় পতাকা উড়িয়েছে, সে সম্পদ থেকে সে বঞ্চিত। হতভাগ্য সে মানুষ কেবল পোশাকি মানুষ। পোশাকে সে সভ্য হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসাবে স্বাধীন নয়। তাই তার ‘বেল্ট যেখানেই থাক গলায় চিহ্ন থাকবেই।’ যুগে যুগে সে চিহ্নকে ঘৃণা করার শিক্ষাই হল আত্মবিক্রয় না করার শিক্ষা। কিন্তু সে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত মানুষ ক্ষমতার কাছে প্রসাদ পেতে সদা নতজানু। আসুন সে মানুষকে ঘৃণা করি। এই তো মেদিনীপুরের কোতোয়ালি থানার নিদারুণ নিষ্ঠুরতা! আমাদের বোনেদের উপর নির্মম অকথ্য অত্যাচার সভ্য মানুষ তাকে স্মরণে রাখবে। যখনই সভ্যতার প্রশ্ন উঠবে আমরা স্মরণ করব কোতোয়ালি থানার কথা। আমরা আলোচনায় নিমগ্ন হব যে সভ্যতা আজও তার কাঙিক্ষত পূর্ণতা অর্জন করেনি, না হলে দাসত্বের এমন নিকৃষ্ট উদযাপন আমরা দেখব কেন? আমার বোনেরা এ দেশের কোটি কোটি মানুষের শিক্ষার অধিকারের দাবিতে জেলবন্দি হয়ে নির্যাতিতা হয়েও যে স্বাধীন মর্যাদাময় পথকে দেখিয়ে দিতে পারল, এতগুলো লকআপের চাবির অধিকার নিয়েও কোতোয়ালি থানার পুলিশ ক্রীতদাসত্ব ছাড়া অন্য কোনও পথ দেখাতে পারল না। ধিক্কার কোতোয়ালি পুলিশকে। অন্যায়ের সাথে থেকে বিবেক বিক্রি করে পেট আপনাদের ভরতে পারে, কিন্তু কেবলমাত্র পেটের সন্তুষ্টি মানুষের মনকে শান্তি দেয় না। সরকারি প্রসাদে প্রমোশন নিয়ে আপনি উচ্চপদে যেতে পারেন, কিন্তু সে উচ্চতা অর্জন মানব জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না, তাই চিরকাল যারা শাসকের হয়ে অত্যাচারের পক্ষে, অন্যায়ের পক্ষে, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি আপনাদেরও করবে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন–
‘পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে সে চারায় কোনও কালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে। … পুলিশের মারের তো কথাই নাই, তার স্পর্শই সাঙ্ঘাতিক। …উহাদের নিঃশ্বাস লাগিলেই কাঁচা প্রাণের অঙ্কুর শুকাইতে শুরু করে।’
সেদিনের শাসক আজ নেই, শাসক বদলেছে। কিন্তু শাসন বদলায়নি। শোষণ বদলায়নি। শুধু তার চরিত্র বদলেছে। সেই দিনও যারা শাসকের কাছে আত্মবিক্রয় করে বিবেক বন্ধক দিয়েছে, তাদের উত্তরসুরীদের হাতেই কোতোয়ালি থানার লকআপের চাবি। আর সেদিন যারা কারা অন্তরালে মুক্তিকামী মানুষের হয়ে নির্যাতন ভোগ করেছে, তারাই আজ কোতোয়ালি থানায় নির্যাতিতা বোনেদের চোখে-মুখে প্রশান্তিময় হাসিতে বেঁচে আছে। ধন্য আমার বোনেরা।
সুমন দাস
যাদবপুর, কলকাতা