সম্প্রতি এক সাংগঠনিক সভায় বিজেপি এবং বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো সংগঠনগুলি রাজ্যের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করে হিন্দুত্বের আদর্শ প্রচারের জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
প্রশ্ন হল, এই সংগঠনগুলি কী অর্থে রাজ্যের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বলে মনে করছে? তা কি এই যে, একদিকে প্রশাসন ও সমাজের স্তরে স্তরে ব্যাপক দুর্নীতি, অন্য দিকে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি রাজ্যের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে? না, আলোচনায় এই সব বিষয় উঠে এসেছে বলে জানা যায়নি। তবে কি হিন্দুত্বের প্রচারের অভাবকেই এই সংগঠনগুলি রাজ্যের ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করে? বাস্তবে হিন্দুত্বের প্রচার হওয়া না হওয়ার সঙ্গে কি এই পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে? পরিস্থিতি যদি সত্যিই তারা বদলাতে চায় তবে তো এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পুলিশের দলদাস আচরণের বিরুদ্ধে, শিক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যাপক ব্যয়বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, রাজ্যে কর্মসংস্থানের যে ব্যাপক ভাটা চলছে তার বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করা দরকার। সরকারকে বাধ্য করা দরকার এ সব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। সেটা কি তারা করতে চায়? না হলে এই পরিস্থিতি কী ভাবে বদলাবে? অবশ্য তারা যে রাজ্যগুলিতে ক্ষমতায় রয়েছে সেখানকার পরিস্থিতিও অন্য রকম কিছু নয়।
আর যদি তারা হিন্দুত্বের প্রচারকেই একমাত্র পরিস্থিতি বদলানোর উপায় বলে মনে করে থাকে তবে তা রাজ্যে আরও এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। তাদের হিন্দুত্বের প্রচার মানে তো রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষকে বাড়িয়ে তোলা, যা ইতিহাস নয় তাকে ইতিহাস বলে প্রচার করা, কে কী খাবে তা সংগঠনের পক্ষ থেকে ঠিক করে দেওয়া, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যে স্বাভাবিক অংশগ্রহণ, তা বন্ধ করার ফতোয়া জারি করা। এর দ্বারা রাজ্যে দীর্ঘ সংগ্রামে যে সম্প্রীতির পরিবেশটি গড়ে উঠেছে তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু তাই নয়, এর দ্বারা গণতান্ত্রিক পরিবেশ যতটুকু রয়েছে সেটুকুও নষ্ট হবে। রাজ্যে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি হবে।
শোষিত মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানের যে লড়াই তা পিছনে চলে যাবে। বিজেপির এই প্রচারকে মোকাবিলা করার নামে তৃণমূলও নিজেকে বড় হিন্দু প্রমাণ করতে প্রতিযোগিতা শুরু করে দেবে। অন্য দিকে বিজেপির হিন্দুত্বের প্রচারকে দেখিয়ে তৃণমূল মুসলিমদের ত্রাতা সাজার চেষ্টা করবে। যা রাজ্যের মানুষ মুখ্যমন্ত্রী থেকে নানা স্তরের তৃণমূল নেতাদের বক্তব্যে শোনা যাচ্ছে। এই ভাবে হিন্দুত্বের প্রচারের দ্বারা মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি হয়তো লাভবান হবে কিন্তু রাজ্যের জনগণের কী লাভ হবে? তাদের তো দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবে। বিজেপি হয়তো ভেবেছে যে এ রাজ্যে এটিই তাদের সংগঠন বৃদ্ধির সহজ রাস্তা। কিন্তু এ তো অত্যন্ত বিপদজনক রাস্তা।
রাজ্যে যতটুকু সুস্থ সামাজিক পরিবেশ রয়েছে তাকে বিদ্বেষ বিষ ছড়িয়ে আরও অসুস্থ, অশান্ত করে তোলা। কোনও সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, তা তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন, এ জিনিস চাইবেন না। তাই বিজেপি আরএসএসের এই হিন্দুত্ব প্রচারের কর্মসূচির সম্পর্কে গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন ও শুভবুদ্ধির প্রতিটি মানুষের সচেতন থাকাই শুধু নয়, স্পষ্ট বিরোধিতায় এগিয়ে আসা দরকার।
মানব মিত্র, কলকাতা-৯৯