গাজা সহ প্যালেস্টাইনে ইজরায়েল কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যা অনেকের মতোই মেনে নিতে পারেননি অস্কার বিজয়ী বর্ষীয়ান সিনেমা সেলিব্রিটি সুজান সারানডন। তিনি বলেছেন, ‘গাজাবাসীর দুঃখ দুর্দশা বুঝতে প্যালেস্টিনীয় হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি তাদের পক্ষেই দাঁড়াব। কারণ যতক্ষণ না আমরা সবাই এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হব ততক্ষণ কেউ একাকী এর থেকে মুক্তি পাবে না।’
কিন্তু কিসের থেকে মুক্তি? সুজান তাঁর বক্তব্যে সে কথা আক্ষরিকভাবে উল্লেখ করেননি। বিগত ৭০ বছর ধরে প্যালেস্টিনীয়রা যুদ্ধবাজ আমেরিকা ও ব্রিটেন সহ পশ্চিমি সাম্রাজ্যলোভীদের মদতপুষ্ট ইজরায়েলি অবরোধ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে মুক্তির লড়াই লড়ছেন তার সাথে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী শোষণ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের যে একটা গভীর যোগ রয়েছে, তাঁর উক্তি থেকে এই সত্যটি শোষিত শ্রেণির সচেতন মানুষ মাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন।
কিন্তু গাজার ২৩ বিলিয়ন নিরপরাধ ও নিরস্ত্র নারী-পুরুষ-শিশুদের বিরুদ্ধে শুধু ইজরায়েলই যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, সারা বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের স্যাঙাতরা সম্মিলিতভাবে এক অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। প্যালেস্টিনীয়দের শত শত বছরের ইতিহাস মুছে ফেলতে তারা চেষ্টার কসুর করেনি। ধৈর্যশীল ও শান্ত স্বভাবের প্যালেস্টিনীয় নাগরিকদের অমানুষ এমনকি পশুর সাথে তুলনা টেনে তাদের সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিহ্ন করবার হুঙ্কার দিয়েছে ইজরায়েলি শাসকদল সহ তথাকথিত বিশ্বনেতারা। তবে সমস্ত কদর্য প্রয়াসকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ড সহ বিশ্বের দেশে দেশে, শহরে শহরে লাখো লাখো সাধারণ মানুষ, বামমনস্ক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার-নার্স স্বাস্থ্যকর্মী, কমিউনিস্ট, নারী-শিশু-কিশোর, প্যালেস্টিনীয় শিশু-নারী সহ গাজায় নাগরিকদের নির্মম হত্যালীলা ও ইজরায়েলি অবরোধ বন্ধের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। জায়নবাদী স্লোগান দিয়েও ইজরায়েলি শাসক নিজের দেশ ও বিদেশের ইহুদি ধর্মালম্বী মানুষদের এই অনৈতিক ও অমানবিক হত্যালীলার পক্ষে আনতে পারেনি।
শুধু তাই নয় প্রতিদিন যখন ইজরায়েলি সেনা শত শত প্যালেস্টিনীয় শিশুদের বোমা মেরে ও স্নাইপার হামলা চালিয়ে হত্যা করছে তখন খোদ ইজরায়েলের মধ্যে শত শত সাধারণ মানুষ, নারী-পুরুষ-শিশু যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ মিছিল করছেন। তাদের ব্যানারে লেখাঃ ‘আমাদের নাম নিয়ে আর এই গণহত্যা নয়’, ‘স্বৈরাচারী ইজরায়েল সরকার যুদ্ধ বন্ধ কর’। বহু ইজরায়েলি শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী মানুষ গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী নেতানিয়াহু সরকার তাদের জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করছে। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। আমার জানা নেই আমেরিকা নিবাসী শ্রদ্ধেয় সুজান-এর মতো প্রতিবাদী সেলিব্রিটিদের কতজন তাদের কাজ হারিয়েছেন। তবে নিশ্চিত করেই বলতে পারি গাজায় ঘটে চলা শিশু ও নরহত্যার সত্যকে বিশ্বের সামনে উপস্থিত করতে গিয়ে শতাধিক সাংবাদিক শহিদ হয়েছেন। যুদ্ধ-অপরাধী ইজরায়েলের বোমার আঘাতে গাজায় ১২টি হাসপাতাল সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। আর নিজেদের রোগীদের রক্ষা করতে গিয়ে তিন শতাধিক ডাক্তার, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী ইজরায়েল অকুপেশন ফোর্স কর্তৃক বন্দি হয়েছেন। তাঁরা এখনও নিখোঁজ। প্যালেস্টাইনের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা আজ জীবনের চরম মূল্য দিচ্ছেন। আমরা কি শুধুই দর্শক হয়ে শতাব্দীর এই নির্মমতম নিধনযজ্ঞ দেখতে থাকব, নাকি সুজানের কথার তাৎপর্য বুঝে নিজেদের মুক্তির লড়াইকে প্যালেস্টিনীয়দের মুক্তির লড়াইয়ের সাথে যুক্ত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলব?
মাঝে কয়েকদিনের যুদ্ধ বিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আবার সাম্রাজ্যলোভী যুদ্ধবাজরা তাদের অনৈতিক ও অবৈধ দখলদারি জায়েজ প্রতিপন্ন করার জন্য হামাসের আক্রমণের জবাব হিসেবে নিজেদের কাপুরুষোচিত, পৈশাচিক নরসংহার চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে–প্যালেস্টাইনের পূর্ব প্রান্তে তো হামাস নামক কোনও সংগঠন নেই। তা হলে সেখানে প্যালেস্টিনীয়দের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে কেন? কেন পূর্ব জেরুজালেমে শত শত প্যালেস্টিনীয়কে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে? কেন তাদের বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা হচ্ছে? আমরা বুঝেছি, নরখাদকদের কাছ থেকে ন্যায় কিম্বা যুক্তির উত্তর আশা করা বৃথা। তাই যেমন করে ফ্যাসিবাদী হিটলার বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিলেন সোভিয়েত জনতা এবং তাদের নেতা মহান স্ট্যালিন, চাই তেমন করে আজকের বিশ্ব জনতার প্রতিরোধ, চাই তেমন কোনও বিশ্বনেতার নেতৃত্ব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হাজার হাজার স্পেনীয় শিশুর হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী কার্ডিওথোরাসিক সার্জেন ডাক্তার নরমান বেথুন বলেছিলেন, ‘যদি সম্ভব হত তা হলে গাব্র্রিয়েলের তূর্য নির্ঘোষে আমার কণ্ঠ জাগিয়ে তুলত স্পেনের আক্রান্ত সীমানার অপর পারের লক্ষ লক্ষ উদাসীন মানুষকেঃ তোমরা যারা আজ রাতে শান্তিতে ঘুমাচ্ছো, তোমাদের প্রত্যেকের হাত আজ নিরপরাধ মানুষের রক্তে কলুষিত। আর আজ আমরা দেখছি হাজার হাজার প্যালেস্টিনীয় শিশু-কিশোর এমনকি নবজাতকদের নির্মম হত্যালীলা। এ সব দেখেশুনে অনেকে দুঃখ করেই বলেছেন, প্যালেস্টিনীয় শিশুরা এঞ্জেল হয়ে স্বর্গে যাচ্ছে। কিন্তু আমি যেন স্বপ্ন দেখছিঃ শতাব্দীপ্রাচীন কবর থেকে বিশ্বের প্রবাদপ্রতিম দুই বৃদ্ধ বন্ধু আমাদের ইশারা করছেন, ‘আঃ! থামাও তর্ক। … এসো আমাদের শিশুদের জন্য এই পৃথিবীর বুকেই গড়ে তুলি সাধারণ মানুষের বহুকাঙ্খিত স্বর্গ।’
ডাঃ দীপক কুমার গিরি, বেলদা, পশ্চিম মেদিনীপুর