২১ জানুয়ারির মহামিছিল দেখে অবাক হয়েছিলাম। আরও অবাক হলাম পরদিন সকালের খবরের কাগজ খুলে। কলকাতার বুকে এমন বিশাল একটি মিছিলের কোনও ছবি, খবর নেই কোথাও! ভেতরের পাতায় মিছিলের একটি ট্যাবলোর ছবি আর ছবির নিচে দু’লাইন ক্যাপশন ছাড়া কিছু পেলাম না অনেক খুঁজেও। দু চারটে অন্য কাগজও দেখলাম পাড়ার দোকানে গিয়ে, সেখানেও একই ব্যাপার। অথচ নিজের চোখে আগের দিন দেখেছি, হেদুয়া থেকে যতদূর পিছনে চোখ যায়, শুধু জনসমুদ্র। প্রতিবাদী স্লোগান লেখা পোস্টার, ফ্লেক্স, লাল পতাকা নিয়ে ঢেউয়ের মতো এগিয়ে আসছে নানা বয়সের মানুষ। আওয়াজ উঠছে, ‘অভয়ার বিচার চাই, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা মানছি না, বিদ্যুতের স্মার্ট মিটার বসানো চলবে না, সরকারি স্কুল তুলে দেওয়া চলবে না’।
বৃদ্ধা মহিলাও স্লোগান দিচ্ছেন আকাশে হাত তুলে, দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন কতো মা। দেখলাম একেবারে গ্রাম থেকে আসা আটপৌরে শাড়ি পরা মহিলা, হিজাব মাথায় মুসলিম মহিলারাও আছেন, উকিলরা হাঁটছেন কালো কোট পরে। যে আর জি কর কাণ্ড নিয়ে পাঁচ মাস ধরে শহর-রাজ্য উত্তাল, বিচারের আশায় লক্ষ মানুষ পথে নেমেছেন, সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রবল অসন্তোষ জমা হচ্ছে, সেই ঘটনা নিয়ে এমন একটা প্রতিবাদী জনজোয়ারের ছবি দিল না কাগজগুলো? গোটা আর জি কর আন্দোলন পর্বে মাঝে মাঝেই শুনতাম, এ আন্দোলনে নাকি গ্রামের মানুষ, গরিব মানুষ নেই। কিন্তু সেদিনের মিছিল দেখে মনে হচ্ছিল, ভুল শুনেছি। কলেজ ইউনিভার্সিটির ঝকঝকে চেহারার পাশেই পরিচারিকা মা বোনেদের একসাথে দৃপ্ত হাঁটা, সোচ্চারে বিচার চাওয়া দেখে বুকের ভেতর ভিড় করছিল নিজের ছাত্রজীবনের স্মৃতি। প্রেসিডেন্সির সামনে আমার পাশেই দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক বললেন, ‘‘মিছিল তো শেষই হচ্ছে না ভাই। মনে হচ্ছে, এরাই পারবে’’। বাড়ি ফেরার পথে বাসেও শুনলাম, একজন পাশে বসা সহযাত্রীকে বলছেন, ‘‘আজ এসইউসিআই-এর মিছিল দেখলে? বিরাট লোক হয়েছিল। পুলিশই বলছে চল্লিশ হাজার, তার মানে আরও অনেক বেশি হবে।’’ ভদ্রলোকের গলার স্বরে উত্তেজনা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, মিছিলের উত্তাপ আমার মতোই ছুঁয়ে গেছে তাঁকেও।
বেশ কিছু সাংবাদিককেও তো দেখলাম মিছিলের পাশে ক্যামেরা, মাইক নিয়ে হাঁটছেন। তাহলে কাগজে কিছুই এল না কেন? অন্য দলগুলোর একেবারে ছোটখাটো মিটিং, জমায়েতের খবরও প্রায়ই ছাপা হয়, দেখি। ভোট তরজা, নেতা-মন্ত্রীদের কুকথার প্রতিযোগিতা, আম্বানি-আদানি’র টাকার ফোয়ারা, সিনেমা-স্টারদের হাঁড়ির খবর কিছুই তো বাদ দেন না এঁরা। অথচ সাধারণ লোকের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে এমন একটা সুবিশাল সুশৃঙ্খল মিছিলের ছবি, খবর জায়গাই পেল না এসব কাগজে? কলেজের এক শিক্ষক বলেছিলেন, নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বলে কিছু হয় না, মিডিয়াকে হয় শাসকের পক্ষ নিতে হবে, নয় তো সাধারণ মানুষের। তাহলে এই কাগজগুলো কার স্বার্থরক্ষা করছে? চিন্তার জটটা ছিঁড়ে গেল কাগজ দোকানের দাদার ডাকে, ‘‘কী এত ভাবছেন’’? একটু হেসে বললাম, ‘‘না মানে, কালকের একটা মিছিল…’’ দোকানদার কথাটা লুফে নিলেন, ‘‘এসইউসি’র মিছিল তো? দেখেছে কাল আমার ভাই, বলছে লাখ খানেক লোক ছিল নাকি? একটা এমএলএ-এমপি নেই, পার্টিটার তেজ আছে কিন্তু’’।
অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি অনেকটা। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল আগেরদিন বিকেলে দেখা মিছিলের ছবি, শীতের বিকেলে আকাশে উড্ডীন লাল পতাকার সারি, বলিষ্ঠ স্লোগান আর দৃপ্ত জনস্রোত। মনে পড়ছিল বাবার কথা। আমার বামপন্থী বাবা বলতেন, বামপন্থা মানে বিপ্লবপন্থা। যারা বিপ্লব করে এই সমাজব্যবস্থাটাকেই আমূল পাল্টে ফেলতে চায়, বামপন্থী তারাই। বহুদিন ভোট ছাড়া আর কোনও কথা শুনি না বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তৃতায়।কিন্তুসেদিনএসইউসিআই (সি)-এরমঞ্চথেকেশুনলাম, ভোট নয়, আন্দোলনই পাখির চোখ, পাল্টাতে হবে এই সিস্টেমকে। সে কাজ কতদিনে সাধন হবে জানি না, তবে একুশে জানুয়ারির এই মিছিল দেখে মনে হল, বিপ্লবের এই স্বপ্নটা চারিয়ে যাবে এই লাখো মানুষের হাত ধরে। শহর থেকে গ্রামে, দেশের প্রতিটি প্রান্তে।
সাগ্নিক সরকার, টালিগঞ্জ, কলকাতা