আজ ২৫ এপ্রিল সোমবার। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। গতকালের অভিজ্ঞতা লিখতে বসেছি। এমন এক অভিজ্ঞতা যা না হলে জীবন যেন অপূর্ণ থাকত।
আসল কথায় আসি। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বাসে মেদিনীপুরে আসি বিরাট উত্তেজনা নিয়ে। এখানে এসে ‘আমি’ থেকে যেন ‘আমরা’ হয়ে গেলাম! আসলে সঙ্গীসাথী যখন কমরেড তখন আর ‘আমি’ শব্দটা চলে না। প্রত্যেকেরই ৯.২৫-এর ট্রেনে ওঠার কথা, কিন্তু ট্রেন ধরতে পারলাম না আমরা তিনজন। পরের ট্রেন ১১টায়। মেদিনীপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি– কখন যে সংখ্যাটা তিন থেকে বেড়ে গণনার বাইরে চলে গেল বুঝতে পারলাম না।
উপস্থিত হলাম কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে। মাঠে পা রেখে প্রথমেই মনে হল– ‘এত মানুষ!’ এর আগে অনেক জমায়েত দেখেছি, কিন্তু এত গরমে এত অস্বস্তিতেও এত জনের জমায়েত জীবনে প্রথমবার দেখলাম। হঠাৎ ‘ইনকিলাব’ ধ্বনিতে গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। বুঝলাম, জীবনে এগিয়ে চলার প্রেরণা আছে এসইউসিআই(সি)-র এই জমায়েত-অঙ্গন ঘিরেই। বুঝলাম, কেন হাজার হাজার মানুষের ভিড় উপচে পড়েছে কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে। বুঝলাম, শুধু আমিই একা কাকভোরে ঘর থেকে বেরোইনি, আরও হাজারো মানুষ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছেন। ভাবছিলাম, এত বড় সমাবেশের জন্য কতজন কমরেড কতদিন ধরে ঘরে-ঘরে গিয়ে, পথচলতি মানুষের থেকে সাহায্য চেয়েছেন! প্রবল তাপপ্রবাহের মধ্যে মঞ্চসজ্জা থেকে অন্যান্য আয়োজন এবং এই বিরাট জমায়েতকে সামাল দিয়ে পুরো অনুষ্ঠানটি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করেছেন যে স্বেচ্ছাসেবকরা, বাকি যাঁরা এই অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সর্বোপরি যাঁদের জন্য আমি ওখানে যেতে পারলাম– প্রত্যেককে সংগ্রামী লাল সেলাম।
মনে হচ্ছিল, জীবনটা হয়ত আমার বৃথা হত যদি না ওখানে উপস্থিত হতে পারতাম! এ যেন এক স্বপ্নের দিন যা বাস্তবে দেখতে পেলাম! অবাক হলাম, ৮৬ বছর বয়স্ক একজন ব্যক্তিকে তরুণের মতো তেজোদীপ্ত দীর্ঘ বক্তব্য রাখতে দেখে। এই মানুষটি সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের অন্যতম সহযোদ্ধা কমরেড প্রভাস ঘোষ, যিনি ১৯৫০ সালে এসইউসিআই(সি)-র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রভাবশালী দেশের চাওয়া-পাওয়া, কার কী মনোভাব– এত অনায়াসে এত সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন যা রীতিমতো বিস্মিত করেছে আমাকে। বিপ্লবীদের গণমুক্তির স্বপ্ন কেন পূরণ হল না, কীভাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি ধর্ষক তৈরির কারখানা গড়ে তুলছে এবং কেন এই পরিস্থিতি বদলাতে আজ অসংখ্য ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতার প্রয়োজন, প্রভৃতি বহু বিষয় নিয়ে তিনি সমৃদ্ধ বক্তব্য তুলে ধরলেন। আমি সামান্য ব্যক্তি। পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করার জন্য আমার শব্দভাণ্ডার অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর। একজন ক্ষুদ্র সংগ্রামী হিসাবে আমার লেখার মধ্য দিয়ে ওঁকে লাল সেলাম জানাতে চাই।
প্রায় দু’ঘণ্টা সেই অমূল্য বক্তব্য শোনার পর ফেরার পথে হাওড়া স্টেশনে যেদিকেই তাকাচ্ছি কমরেডদের দেখতে পাচ্ছি! সকলে মিলে আমরা যেন একজনই!
মৃন্ময় চৌধুরী, খড়গপুর কলেজ