পাঠকের মতামতঃ জীবনবোধের অমূল্য শিক্ষা

 

নানা সময়ে পার্টির তহবিল সংগ্রহ করতে গিয়ে ৫০০ টাকা আগেও পেয়েছি। বাড়িতে বসিয়ে নিকট আত্মীয়ের মতো আপ্যায়নের অভিজ্ঞতাও নতুন নয়। অতীত দিনের পার্টির নেতা-কর্মীদের জীবনপণ সংগ্রাম, মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসা, বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও নিষ্ঠার সাথে আদর্শ চর্চার ফসল হিসাবে এ সবই বর্তমানে আমাদের কাছে সহজলভ্য। কিন্তু আজ একটা অন্য জিনিস পাওয়া গেল।

ঘড়িতে তখন পৌনে বারোটা। নতুন এক ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতলার দরজায় কলিং বেল বাজালাম। গৃহকর্ত্রী এসে দরজা খুললেন। এলোমেলো ছড়ানো আসবাব, জামাকাপড, সবজি-আনাজ। ঘরের ভেতরের দৃশ্য দেখে সহজেই বোঝা যাচ্ছিল, এই পরিবারটি খুব অল্পদিনই ফ্ল্যাটটিতে এসেছেন। আমরা পরিচয় দিয়ে আসার কারণ বললাম। আমাদের কথা শুনে ভিতরের ঘর থেকে গৃহকর্তা এসে হাজির। ভিতরে আসতে অনুরোধ করলেন। চিরকালীন বদঅভ্যাসের বশবর্তী হয়ে বেখেয়ালি মন তখন ব্যস্ত গণদাবী বিক্রি, বই বিক্রি বা অর্থসংগ্রহের অঙ্ক সংক্রান্ত পাটিগণিত নিয়ে। প্রচারের সময় নষ্ট হবে ভেবে প্রথমে তাই বাড়িতে বসতে বলার আন্তরিক অনুরোধ হাসিমুখে একরকম প্রত্যাখ্যানই করি আমি ও আমার সঙ্গী কমরেডটি। এরপরই তিনি এক মোক্ষম প্রশ্ন করলেন, ‘এটা তো আপনাদের নিজেদের বাডি, ভিতরে আসবেন না কেন’? এ প্রশ্নের পর আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

চলল নানা বিষয় নিয়ে মিনিট কুড়ি নির্ভেজাল আড্ডা-গল্প। গৃহবধূ ও দুই স্কুল পড়ুয়া মেয়ে নিয়ে ছোট্ট ছিমছাম সংসার মধ্যবয়স্ক কমলবাবুর। কষ্টের উপার্জন জমিয়ে সদ্য ফ্ল্যাটটি কিনেছেন। তাঁর মামার বাড়ি জয়নগরে। শৈশব কৈশোরের অনেকটা কেটেছে ওই অঞ্চলে। স্থানীয় বহু নেতার সঙ্গে এখনও রয়েছে অল্প-বিস্তর যোগাযোগ। স্মৃতিতে তাই উঠে এল দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় এস ইউ সি আইয়ের লড়াই আর সিপিএমের অত্যাচারের কাহিনি। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠন করেন। আগে করতেন সিটু, এখন আইএনটিটিইউসি। সেই অভিজ্ঞতাও ভাগ করলেন। এরই মাঝে রান্না থামিয়ে কখনও লেবুর শরবত, কখনও লিকার চায়ের যোগান দিয়ে গেলেন স্ত্রী। বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষমান কমরেডদের বার তিনেক ফোন আসার আগে পর্যন্ত ওঠার কোনও উপায় ছিল না। সব শেষে যখন উঠতে চাইলাম, তখন জানতে চাইলেন, কত দেব? আমরা বললাম, যতটা আপনার অসুবিধা না করে দেওয়া সম্ভব। তখনও সাধারণ এই খেটে খাওয়া মানুষটির কাছ থেকে আমরা ৫০০ টাকা অনুদান প্রত্যাশা করিনি। পরিতৃপ্তির একগাল হাসি নিয়ে যখন মোচড়ানো নোটটা আমাদের হাতে তুলে দিলেন, সঙ্গী কমরেডটি তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার এতে সমস্যা হবে না তো?‘ উত্তরে তিনি যা বললেন তা এক অমূল্য শিক্ষা। বললেন, ‘কাল যদি বেঁচে না থাকি, তা হলে কোনও সমস্যা হবে না। না হলে যতদিন বেঁচে থাকব জীবনে কোনও না কোনও সমস্যা থাকবেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই সমস্যাগুলো নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে জীবনে ভাল কাজে কতটা অবদান রেখে যেতে পারলাম।’

সুবিধাবাদের এই পঙ্কিল যুগে, ছাপোষা এই সাধারণ মানুষটির অতি সরলতার সাথে উপস্থাপিত জীবনবোধের এই অমূল্য শিক্ষা আমার মনোজগতে একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। এ শিক্ষার মর্মার্থ বোঝা জীবনে বড় প্রয়োজন। সততার সাথে স্বীকার করলে দ্বিধাহীন ভাবে বলতে পারি, এখনও এ ভাবে ভাবতে শিখিনি। হয়তো শিখতে এখনও সময় লাগবে। হয়তো কোনও একদিন শিখতে পারব। যদি কখনও পারি, তবে কমলবাবুর অবদানের অস্বীকৃতি অন্যায় হবে।

তাপস হোড়

রবীন্দ্র সরোবর, কলকাতা-৩৩