পাঠকের মতামতঃ কলেজ শিক্ষায় সর্বনাশ

 

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দ্বারা প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি কলেজ স্তরে চালু করল রাজ্য সরকার। দেশের ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০২০ সালের ২৯ জুলাই এই শিক্ষানীতি বিজেপি সরকার দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। দাবি করা হয় এই নীতি শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কিন্তু কার্যত শিক্ষার প্রাণসত্তাকেই ধ্বংস করবে এই শিক্ষানীতি। বিজ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার কোনও স্থানই নেই এই শিক্ষানীতিতে। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ আশা করেছিল, এ রকম সর্বনাশা শিক্ষানীতির বিরোধিতাই করবে তৃণমূল সরকার। কিন্তু তা না করে ‘রাজ্য শিক্ষানীতি ২০২৩’-এর নামে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির সামান্য কিছু পরিবর্তন করে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণাই করে দিলেন ‘কারিকুলাম অ্যান্ড ক্রেডিট ফেমওয়ার্ক’। এ বারে ছাত্রছাত্রীরা কলেজে তিন বছরের পরিবর্তে চার বছর থাকবে।

শিক্ষার্থীরা এক বছর বা দু’ বছর পর পাবে এক একটা সার্টিফিকেট। আবার চার বছর বাদে পাবে রিসার্চ উইথ অনার্স ডিগ্রি সার্টিফিকেট। কলেজগুলো শুধু ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট কেনাবেচার একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে। জ্ঞান যে একটা সামাজিক সম্পদ– এই বোধ গড়ে তোলাই হল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই বোধ একেবারেই গড়ে উঠবে না। সার্টিফিকেট নিয়ে কিছু একটা করে জীবন নির্বাহ করার চিন্তাভাবনাই শিক্ষার্থীদের মনে কাজ করবে, যা তাকে সমাজ বিমুখ করবে।

দ্বিতীয়ত, ড্রপ-আউটের সংখ্যা বাড়বে। এই চার বছরের ডিগ্রি কোর্সে বলা হয়েছে, একজন শিক্ষার্থী এক বছর বা দু’বছর পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট নিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে পারবে। আমাদের মতো দেশে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারে না। অনেককে স্কলারশিপের উপর নির্ভর করতে হয়। অনেককে স্কলারশিপ আবার দেওয়াও হয় না। এই অবস্থায় এক বছর বাড়তি খরচ চালাতে হলে বহু ছাত্রছাত্রী পড়ার কথা ভাবতেই পারবে না। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের উচিত ছিল শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করে শিক্ষার সমস্ত দায়ভার সরকারেরই নেওয়া। কিন্তু তার বদলে বেসরকারি হাতে শিক্ষা তুলে দিয়ে ছাত্রদের উপর ব্যয়ভার বাড়ানো হয়েছে।

তৃতীয়ত, রয়েছে সেমেস্টার প্রথা যেখানে একটি বছরকে ছ মাস করে দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই প্রথার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর সার্বিক গভীর জ্ঞান অর্জন কখনওই সম্ভব নয়। নানা ছুটিছাটার মধ্য দিয়ে শিক্ষাদিবস নষ্ট হওয়ার ফলে সময়ের অভাবে অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা সিলেবাস দ্রুত শেষ করতে গিয়ে অনেক বিষয় হয়ত পড়াতেই পারবেন না। ফলে বিষয়ভিত্তিক গভীর জ্ঞান গড়ে উঠবে না।

চতুর্থত, কলেজ স্তরে থাকবে ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কোর্স’। এই পদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষাতে বিজ্ঞানসম্মত বিষয় বিভাজন থাকবে না। আমরা জানি রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলে সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস জানতেই হয়। আবার পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করলে গণিত ও রসায়ন ভালো করে পড়তেই হয়। কিন্তু এখন এতে আর বাধ্যবাধকতা থাকছে না। শিক্ষার্থীর বেশি নম্বর পাওয়ার মানসিকতা থাকার ফলে ইচ্ছামতো যে কোনও বিষয় নির্বাচন করে পড়াশোনা করতে পারবে। বিশেষ বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করে সেই বিষয়ে অভিজ্ঞ বা স্পেশালিস্ট বলে আমরা এতদিন যে, জেনে এসেছি এতে তা আর থাকছে না।

পঞ্চমত, কলেজের পরিকাঠামো অনুযায়ী বহু কলেজে অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী, প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি সহ বহু পরিকাঠামোই নেই। যেখানে তিন বছরের কোর্স শেষ করাই কঠিন, সেখানে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নষ্টই করবে।

দেশে যাঁরা শিক্ষার সাথে যুক্ত শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী তাঁদের দাবি মেনে যদি এই শিক্ষানীতি বাতিল না হয় তাহলে দেশের ছাত্রসমাজ ভবিষ্যতে ডিগ্রিধারী যুক্তিহীন যন্ত্রমানবে পরিণত হবে।

বুদ্ধদেব রায়

ক্ষুদিরাম সরণি, কোচবিহার