পাঠকের মতামতঃ ‘এই মাটি ছেড়ে যাব না’

১৫ মে, রাত আটটা নাগাদ আমার কাছে একটা ফোন এল, বিকাশ ভবনে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের উপর প্রবল লাঠিচার্জ হয়েছে। মেডিকেল হেল্প লাগবে দ্রুত। হাতের কাছে যা কাজ ছিল, মিটিয়ে ছুটলাম। কাছাকাছি গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। গলায় স্টেথোটা ছিল বলে ভিড় সরে গিয়ে জায়গা করে দিল। দেখলাম প্রচুর পুলিশ আর ব়্যাফ বাহিনী জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। আমার আগেই অনিকেত মাহত সহ বেশ কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স পৌঁছে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। আমি সেদিন বিশেষ কিছু করতে পারিনি, শুধু যা উপলব্ধি করেছি সেটা সকলকে জানানোর জন্যই এই লেখা।

পৌঁছেই দেখি বিকাশ ভবনের মেন বিল্ডিং-এর ঠিক সামনে একজন শিক্ষক মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছেন, পাশে একটা পুলিশের লাঠি মাঝখান থেকে ভাঙা অবস্থায় শয্যাশায়ী। কার্য আর কারণের সম্বন্ধটা পরিষ্কার হল। আহত ব্যক্তিকে ঘিরে থাকা ভিড়কে সরিয়ে দেখে বুঝলাম, ওনার ডান পায়ের ফিমার বোন ফ্র্যাকচার হবার আশঙ্কা। অনেকক্ষণ পড়ে আছেন। ভিড় ঠেলে অ্যাম্বুলেন্স আসার কোনও সুযোগ নেই। যাই হোক তাঁকে বরফ, ব্যথার ওষুধের স্প্রে ইত্যাদি দেওয়া হল। তাঁকে দেখতে দেখতেই এক দিদি ডেকে নিয়ে গেলেন, একটি বোনের কাছে, তাঁর বাম কানের উপরে লাঠির বাড়ি পরে ফুলে আলুর মতো হয়ে গিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। এর পর একবার এ ডাকে একবার ও। যে দিকেই দেখি শুধু আহত নিরস্ত্র মানুষ, আর চারদিকে নির্বিকারে ঘুরে বেড়ানো উর্দিধারী দেশপ্রেমিকের দল, যাদের লাঠি চোর-ডাকাতের দিকে চলে না, ধেয়ে আসে আন্দোলনরত মানুষের দিকে।

শ’দুয়েক ব্যথার বড়ি, বারোটা আইসপ্যাক আর দশটা স্প্রে ঝড়ের মতো শেষ হয়ে গেল। আবার আনতে পাঠানো হল।

অনেক কষ্ট করে অ্যাম্বুলেন্স এনে ওই দু-জন আহতকে হাসপাতালে পাঠানো হল। শুনলাম এর আগে আরও অনেকেই সাংঘাতিক আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন। তাদের কারোর চোখে চোট, কারোর বা স্ট্রোকের মতো হয়েছে। ‘রক্ত চাই, রক্ত নাও…’ কথাটা অনেকবার শুনেছি, সেদিন দেখলাম, সরকার শুধু নিয়েই যায়, দেয় না। এরপর সবাইকে বিকাশ ভবনের বাইরে বের করে দিয়ে ভিতরের দখল নিল সশস্ত্র বাহিনী। আন্দোলনকারীদের দখলে মেট্রোর নিচের প্রায় এক কিলোমিটার অঞ্চল, যেখানে বসে বা শুয়ে আছেন হাজার কয়েক শিক্ষক-শিক্ষিকা।

আমার এমএসসি মেডিকেল টিমের সদস্যরা মূল জায়গাটার খেয়াল রাখছিলেন, আমি তখন একজনকে নিয়ে দূরের দিকে যাঁরা আছেন তাঁদের দিকে গেলাম। যেদিকেই তাকাই ডাক আসে, স্যার একটু দেখুন, এ দিকে আসুন। এই করতে করতে স্প্রে শেষ, আইস প্যাক সব গলে গেছে।

আমি কোনও দিন যুদ্ধ দেখিনি, শুনেছিলাম কোনও এক যুদ্ধে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুটারির ব্যারাকে সৈনিকদের মধ্যে ল্যাম্প হাতে ঘুরতেন। খানিকটা সে রকমই লাগছিল। তফাতটা শুধু এঁরাও দেশের সৈনিক–শিক্ষার সৈনিক, তাঁরা আক্রান্ত ভিনদেশিদের দ্বারা নয়, নিজের দেশের পুলিশের দ্বারা।

একজন আক্রান্তকে একটা ব্যথার বড়ি দিলাম, তিনি বললেন, খালি পেটে খাব? আমি বললাম হ্যাঁ। বলার পরই জিজ্ঞাসা করলাম কিছু খাননি? চোখের জলে বললেন– হ্যাঁ স্যার, খেলাম তো পুলিশের মার! এরপরই আবার চোয়াল শক্ত– যাব না ডাক্তার, এই মাটি ছেড়ে যাব না। যতই মারুক। এই করতে করতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেছে খেয়াল করিনি। দেখলাম অনেকেই রাস্তায় প্লাস্টিক বিছিয়ে খালি পেটেই শুয়ে পড়েছেন। আমার সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করলাম, এঁদের খাবারের কী ব্যবস্থা হবে? কোনও উত্তর কারোরই জানা নেই। আসলে এটা নিয়ে ভাবার সময় কারোর ছিল না। আমার এক সাথী বললেন, অন্তত কয়েক বস্তা মুড়ি হলেও ছেলেমেয়েগুলোর পেটে কিছু দেওয়া যেত। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল সুহৃৎ, ভোলা, পিন্টুদা, অপু সেখদার কথা– যাঁরা এই ধরনের কাজে সবসময় এক পায়ে খাড়া। মুড়ি, চানাচুর, বাতাসা এসেও গেল এক ঘণ্টার মধ্যে, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই।

এরই মধ্যে একজন অসুস্থ শিক্ষক ভাইকে ব্যথার ওষুধ দেবার সময় বললাম, আর নেই। আপনাকেই শেষ বড়িটা দিলাম। একটু ভেবে তিনি ফিরিয়ে দিলেন, ডাক্তারবাবু রেখে দিন, আমি সহ্য করে নেব। যদি আরও কারোর দরকার হয়। মুড়ি বিতরণের সময়, এক শিক্ষিকা এসে আমাদের এক ডাক্তারকে বললেন, আমার বাড়ি থেকে ভাত দিয়ে গেছে, সেটা তুমি খেয়ে নিয়ো। কতক্ষণ একটানা কাজ করছ। সে বলল না দিদি, এ কি হয়? আমরা শেষ করে কিছু না কিছু খেয়েই নেব। তোমার বাড়ি থেকে দিয়ে গেছে। মেয়েটি বলল, ওরে আমার গলা দিয়ে নামবে না, আমার এত ভাই-বোন না খেয়ে রয়েছে। আমি কি ভাত খেতে পারি?

আমাদের দেশের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, একটা জাতি না খেয়েও দাঁড়ায়, না খেয়েও সে লড়ে, যদি মনুষ্যত্ব থাকে, নৈতিকতা থাকে। দেখলাম আজকের এই সমাজে যেখানে দেশনেতারা অনৈতিকতার পাঠ দিচ্ছেন প্রতিদিন, সেখানে আন্দোলন তার প্রতিষেধক তৈরি করছে। নতুন নৈতিকতা-বিশিষ্ট মানুষের চাষ হচ্ছে আন্দোলনের মঞ্চে। আর জি কর আন্দোলনেও দেখেছি, আবার দেখলাম। দু’বছর আগে, দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে দেখেছি, উড়তা পাঞ্জাবের নেশাগ্রস্ত যুবকরা, যাদের কোনও চেষ্টাতেই নেশা ছড়ানো যায় না, তারা আমাদের ক্যাম্পে এসে বলতেন, ডাক্তার এখানেই থাকব, এই লড়াই ছেড়ে যাব না। যতই নেশা ডাকুক, ফিরব না। তোমরা শুধু কিছু ওষুধ দিয়ে হেল্প করো। দেশের নামকরা সাইকিয়াট্রিস্টরা আন্দোলন দিয়ে নেশা ছাড়ানোর এই উদাহরণগুলো শুনে তাজ্জব হয়ে গেছেন।

আজকের শিক্ষক আন্দোলন কোন পথে সফল হবে সেটা তাঁদেরই ঠিক করতে হবে। কিন্তু আশা রাখি– বিভেদকামী, দুর্নীতিগ্রস্ত শক্তিগুলোকে তাঁরা পরিহার করে চলবেন। তবেই এই লড়াই হবে আপসহীন। একের পর এক তৈরি হবে নতুন নৈতিকতা-বিশিষ্ট মানুষ। এটা তাঁদের দাবি আদায়ের সাথে সাথে সমাজকেও পথ দেখাবে। আসুন, আমরা আশায় বুক বাঁধি। একটার পর একটা আন্দোলনের ধাক্কায় জাতির নৈতিকতা ফিরুক। সঠিক পথ চিনে নতুন দিনের লক্ষ্যে লড়াই চলুক। আমরা সামিল আছি, থাকব।

ডাঃ শুভঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, সল্টলেক

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৩০ মে – ৫ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত