১১ই আগস্ট। ১৯০৮ সালে আঠেরো বছরের ক্ষুদিরাম বসুকে এই দিন ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসক। ফাঁসির মঞ্চের দিকে তেজোদৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন এই অগ্নিকিশোর। তার অসমসাহসী আত্মবলিদান জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল পরাধীন ভারতবর্ষের লক্ষ মানুষের হৃদয়। তার তিন বছর পরে, কটকের স্কুলে বন্ধুদের নিয়ে ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিন পালন করেছিলেন বছর দশেকের আরেক কিশোর। তার নাম সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষচন্দ্র, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, ভগৎ সিং-রা চেয়েছিলেন এক সত্যিকারের স্বাধীন, শোষণমুক্ত ভারতবর্ষ, যেখানে প্রতিটি মানুষ মর্যাদায় মাথা উঁচু করে বাঁচবে। অথচ এই স্মরণীয় দিনটির প্রাক্কালে, স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পূর্তির ক’দিন আগে, এই বাংলার বুকে ঘটে গেল আর জি কর হাসপাতালের অভাবনীয় নৃশংস ঘটনা। শহর কলকাতার একটি প্রথম সারির সরকারি হাসপাতালের অন ডিউটি ডাক্তার, এক মেধাবী সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল তরুণীর পৈশাচিক ধর্ষণ ও হত্যা অনেকগুলো প্রশ্ন তুলে দিল। সমাজে মেয়েদের চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতা, সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অপদার্থতা ও গাফিলতির নিন্দার কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়। সবার আগে অপরাধীর বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, তারা কি নিজেদের কাজটুকু করছি বা করেছি ঠিক মতো? খুন ধর্ষণের ঘটনা কেন রোজের হেডলাইনে পরিণত হচ্ছে আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজে? আমরা কি সন্তানের সামনে, নবীন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারছি কোনও অনুসরণীয় চরিত্র, মূল্যবোধ? যে সমাজ মানুষকে এমন নৃশংস বর্বরে পরিণত করছে, সেখানে বাস করে আমাদের কি কিছুই করার ছিল না?
১১ আগস্টের সকালে দেখা যায়, কলকাতার রাস্তায়, পাড়ার মোডে, মফস্বলের বাজারে হাটে ক্ষুদিরামের ছবিতে মালা দিচ্ছে একদল তরুণ- তরুণী। আপনাকে তারা ডাকবে– ‘আসুন ছবিতে মালা দিন, ক্ষুদিরামকে শ্রদ্ধা জানান।’ হয়তো বাজার করার ব্যস্ততায়, সংসারের পাঁচটা ঝামেলায় আপনি ‘ব্যস্ত আছি’ বলে এড়িয়ে যাবেন, হয়তো এগিয়ে যেতে গিয়েও নানা হিসেবি চিন্তা আপনাকে থামিয়ে দেবে। হয়তো একটু থেমে একমুঠো ফুল আপনি রাখবেন ক্ষুদিরামের শহিদ বেদিতে।
এদের আপনি প্রায়ই দেখেন। গলিতে, রাজপথে, আপনার ঘরের দরজায়। এরা আসে, আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চায় ২৯ জুলাই, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১১ আগস্ট। মনে করিয়ে দেয় বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ভগৎ সিং, প্রীতিলতা, সূর্য সেনের কথা। ২৩ জানুয়ারি সকালে যখন প্রায় সর্বত্র পিকনিকের মেজাজে নেতাজি-উৎসব চলে, তখন এই নাছোড়বান্দা ছেলেমেয়েগুলো আপনার হাতে ধরিয়ে দেয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি, ব্যাজ। ছবির তলায় তাঁর উদ্ধৃতি– অন্যায়ের সাথে যে আপস করে, অত্যাচার দেখলে যে প্রতিবাদ করে না সেও সমান অপরাধী। নিজের মতো করে নিজের জগতে ডুবে থাকা, ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া এই পৃথিবীতে অন্য এক আলো-পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে এই উজ্জ্বল তরুণেরা, হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনের, নবজাগরণের মনীষীদের জীবন, তাঁদের মূল্যবোধ। সমাজে অন্যায় অত্যাচার হলেই আপনি বিক্ষোভে মিছিলে প্রতিবাদে পাবেন এদের, যে মিছিল যে বিক্ষোভ দেখে হয়তো আপনি যানজটে আটকে পড়া বাসে বসে বিরক্ত হয়েছেন। যে প্রতিবাদে পা মেলাতে গিয়েও কোনও এক সাবধানী মন আপনাকে পেছনে টেনে ধরেছে।
আজ ভেবে দেখার দিন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করার দিন। যতবার আমি আপনি এদের এড়িয়ে গেছি, যতবার নিজে সামিল হইনি বা সন্তানকে বাধা দিয়েছি এমন উদ্যোগে সামিল হতে, ততবার সমাজে একটি মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে বাধা দিয়েছি আমরাও, বপন করেছি আত্মকেন্দ্রিকতার বীজ। মদের ঢালাও লাইসেন্স দিয়ে, ব্লু ফিল্ম দেখিয়ে, অপসংস্কৃতির জোয়ারে মাতিয়ে আমাদের শিরদাঁড়াকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছে শাসক, আমরা নিষ্ক্রিয় থেকে সেই ফাঁদে পা দিয়েছি। যতবার সন্তানকে নিজের বৃত্তের বাইরে, কোচিং কেরিয়ার কম্পিটিশনের বাইরে কিছু ভাবতে দিচ্ছি না, এই অমানুষ তৈরির প্রক্রিয়ায় অনুঘটক হয়ে থাকছি আমরাও।
বছরখানেক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা স্বপ্নদীপের স্বপ্নগুলো হস্টেলের চারতলা থেকে আছড়ে পড়েছিল মাটিতে। সেই থেঁতলে যাওয়া দেহ দেখে আমরা শিউরে উঠেছি, বিনিদ্র রাতে ঘুমন্ত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। আজ যখন অনেক বড় ডাক্তার হতে চাওয়া, বহু পরিশ্রমে ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করা সুস্থ-সবল মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত দেহ চোখের সামনে ভেসে উঠছে, আমরা একইভাবে শিউরে উঠছি। মেয়েটির মর্মান্তিক মৃত্যুযন্ত্রণা, অসহায় চিৎকার ভেবে নিজেদের শ্বাসরোধ হয়ে আসছে বারবার। আমাদের সন্তান, আমাদের আপনজনের মুখ মনে করে এক হিমশীতল আতঙ্ক গ্রাস করছে আমাদের। কিন্তু এমন করে বাঁচতে পারব না, বাঁচাতে পারব না প্রাণপ্রিয় সন্তানকে। বানতলা-সুটিয়া- কামদুনি-পার্ক স্ট্রিট-আর জি কর হয়ে খুনি-ধর্ষক নিঃশ্বাস ফেলবে আমাদের পাশের পাড়ায়, হয়তো পাশের বাড়িতেই। যদি সত্যিই এই অসুস্থ সমাজের পরিবর্তন চাই, তা হলে আজ অন্তত স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটি। বিকল্প সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তোলার লড়াইতে সর্বশক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়াই। না হলে অদূর ভবিষ্যতে ‘মানুষ’ নামক নিশ্চিহ্ন প্রজাতির ফসিল সংরক্ষণ করতে হবে মিউজিয়ামে। আজও যদি জেগে ঘুমিয়ে থাকি, সেদিন ইতিহাস দায়ী করবে আমাদেরও। শূন্যতার অতলে তলিয়ে যেতে যেতে সেদিন যেন বলতে না হয়–
‘আমি জানি এই ধ্বংসের দায় ভাগে “আমরা দুজনে সমান অংশীদার। অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে“ আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার।’
সূর্যস্নাতা সেন, দমদম