এই চিঠি আমি লিখছি নিজের তাগিদেই। আগে আপনাদের দলের কর্মীদের কাছে কয়েক বার শুনেছিলাম যে মিডিয়া নাকি আপনাদের প্রচার দেয় না। উত্তরে প্রতিবারই আমি বলেছি, কেন দেবে না, আপনারা দেওয়ার মতো প্রোগ্রাম করুন, তা হলেই দেবে। এ-বার আমার সে ভুল ভেঙে গেল। ২২ মার্চ আপনাদের বিক্ষোভ-মিছিল আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পুরোটা দেখেছি। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে রাস্তা উপচে মিছিল গেছে। আমার মতো আরও অজস্র মানুষ দাঁড়িয়ে মিছিল দেখেছে। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এত মানুষ এসেছে এস ইউ সি আইয়ের মিছিলে! পরে ভাবলাম, হবে না-ই বা কেন, এরাই তো একমাত্র সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলি নিয়ে লড়াই করে। আপনাদের প্রচার গত এক মাস ধরে আমি লক্ষ করেছি। মূল্যবৃদ্ধি থেকে বেকারত্ব, বেসরকারিকরণ থেকে ফসলের দাম–মানুষের জীবনের সব দাবিগুলিই ছিল সেই প্রচারে। মানুষের সাড়াও আমি লক্ষ করেছি। আমার পরিচিত কিংবা বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই স্বীকার করেন আপনাদের সিরিয়াসনেসের কথা। তাঁরা প্রায় সকলেই বলেন, অন্য দলগুলো যখন শুধু গদি নিয়ে কাড়াকাড়ি করে চলেছে, তখন এই একটা দলই নিষ্ঠা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে।
মিছিলে ছাত্র-যুবদের বিরাট অংশগ্রহণ আমাকে খুবই উৎসাহিত করেছে। আন্দোলনের মিছিলে এত ছাত্র-যুবক আমি খুব কমই দেখেছি। বেকারদের কাজের দাবিতে কিংবা সবার জন্য শিক্ষার দাবিতে বলিষ্ঠ স্লেগান যখন তারা তুলছিল, তখন অদ্ভূত একটা আশার ঢেউ মনের মধ্যে আছড়ে পড়ছিল। দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা হতাশাগুলো যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। যখন তাঁরা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছিলেন, সরকার পরিবর্তন নয়, সংগ্রামী বামপন্থাই মুক্তির রাস্তা, তখন যেন আমার ভেতরে একটা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশে দাঁড়ানো মানুষটি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, কত লোক হবে বলুন তো? আমি বললাম, আপনিই বলুন না। তিনি মিছিলের থেকে চোখ না সরিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, তা এক লাখ তো হবেই। লোকসংখ্যা নিয়ে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু তাঁর কথাটা আমিও যেন অবিশ্বাস করতে পারলাম না। লাখো মানুষের উপস্থিতির কথা শুনে কেন জানি না মনে কেমন একটা তৃপ্তি অনুভব করলাম। ভদ্রলোক বললেন, দেখবেন, কাল সব কাগজে এই বিরাট মিছিলের ছবি এবং খবর প্রথম পাতাতেই থাকবে। আমিও এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। দেখলাম বেশ কয়েকটা ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছবি তুলছে। ভাবলাম, নিশ্চয় ওরা লাইভ সম্প্রচার করছে। কারণ এত বড় খবর আজ তো ওরা আর কিছু পাবে না!
ধীরে ধীরে মিছিল শেষ হল। বাড়ির পথ ধরলাম। ফিরেই টিভিটা চালিয়ে দিলাম। বহুল প্রচলিত চ্যানেলটাই আগে খুললাম। বিজ্ঞাপন চলছে। অপেক্ষা করতে থাকলাম। বিজ্ঞাপন শেষ হলেই নিশ্চয় মিছিলের ছবি দেখাবে। কিন্তু, কই না তো। এক ফিল্মস্টারের ইন্টারভিউ চলছে। হতে পারে। হয়তো পূর্বনির্ধারিত, তাই দেখাচ্ছে। আচ্ছা দেখি তো অন্য চ্যানেলগুলো। একের পর এক ঘোরাতে থাকলাম। না, কেউই দেখাল না। কী করে হয়, কোনও চ্যানেলই দেখাল না এত বড় একটা প্রোগ্রাম? এই না দেখানোর অস্বস্তি ঘুমের মধ্যেও আমাকে তাড়িত করছিল।
ঘুম ভাঙল অন্য দিনের থেকে একটু আগেই। কাগজওয়ালা আমাদের বাড়িতে কাগজ দেয় খুব ভোরে। দৌড়ে গেলাম বারান্দায়। কাগজটা তুলেই প্রথম পাতায় চোখ রাখলাম। কই? এ তো রামপুরহাটের পুড়ে যাওয়া বাড়ির ছবি। হতেই পারে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর। নিশ্চয় ভেতরে আছে। পাতা উল্টে চললাম। কোথাও কোনও ছবি বা খবর দেখলাম না। দৌড়ে গেলাম পাড়ার কাগজের স্টলে। একটার পর একটা কাগজের পাতা ওল্টাতে থাকলাম। কোনও কাগজে নেই। মনে একটা বিরাট ধাক্কা খেলাম। তবে কি আপনাদের কথাই সত্যি! আপনাদের দলের খবর-ছবি না দেওয়াটা তবে সত্যিই মালিকদের পরিকল্পিত! পাড়ায় আপনাদের কর্মীদের সঙ্গে কত তর্ক হয়েছে। তাঁরা বলতেন, আমরা যেহেতু শোষিত মানুষের স্বার্থের কথা বলি, তাই পুঁজিপতিদের পরিচালিত মিডিয়া আমাদের প্রচার দেয় না। আমাদের শক্তিবৃদ্ধির কথা সামনে আনতে চায় না। আমি এ কথা বিশ্বাস করতাম না। ভাবতাম এ কি হতে পারে! মিডিয়া তো সবার কথাই বলে। কত গুরুত্বহীন দল, তাদের কথা ফলাও করে প্রচার করে। সারাক্ষণ তিলকে তাল করে তোলে। অথচ এত বড় একটা মিছিল, যা সাধারণ মানুষের জীবনের ন্যায্য দাবিগুলিকে তুলে ধরেছে, তার কোনও খবর তারা প্রকাশ করল না। আজ বুঝলাম আপনাদের কথাই ঠিক। কারণ, এর পিছনে অন্য কোনও যুক্তি মনের মধ্যে বহু খুঁজেও পেলাম না। আমার ধারণা বদলে গেল।
মনের উদ্বেগ হালকা করার জন্যই আপনাদের কাগজের দপ্তরে চিঠি লিখলাম। সঙ্গে অনুরোধ রাখলাম, আপনারা নিজেদের দৈনিক কাগজ এবং চ্যানেল তৈরি করুন। আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব।
অবিনাশ চৌধুরী, কলকাতা-৯