অস্ত্র-ব্যবসা ভারতেও জাঁকিয়ে শুরু হয়েছে। ২০২১-‘২২ অর্থবর্ষে ভারত ১৩ হাজার কোটি টাকার যুদ্ধ সরঞ্জাম বিদেশে রপ্তানি করেছে। এর ৭০ শতাংশ করেছে একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণি। ৩০ শতাংশ করেছে সরকার। ভারত অস্ত্র যেমন বিদেশ থেকে আমদানি করে, তেমনি বিদেশে রপ্তানিও করে। ২০১৫-‘১৬ অর্থবর্ষে ভারত থেকে ২,০৫৯ কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র বিদেশে রপ্তানি হয়েছিল। গত ৫ বছরে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ গুণের বেশি।
কোন কোন দেশে ভারতের অস্ত্র রপ্তানি হচ্ছে? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে ভারত অস্ত্র রপ্তানি করছে। ভারতের অস্ত্র যাচ্ছে আমেরিকাতেও। এ বছর জানুয়ারি মাসে ২,৭৭০ কোটি টাকার ব্রহ্মস সুপারসনিক ত্রুজ মিসাইল ভারত থেকে কেনার জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে ফিলিপিন্স। ভারতের পুঁজিপতিরা আশা করছে ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামেও তাদের অস্তে্রর বাজার খুলে যাবে।
ভারত অস্ত্রশিল্পে খুবই জোর দিয়েছে। ভারতের ডিফেন্স সেক্রেটারি অজয়কুমার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ডিফেন্সে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের (এআই) ব্যাপক প্রয়োগ ঘটছে। এ সংক্রান্ত আধুনিক ও উন্নত ৭৫ রকমের অস্ত্র ও প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। এ ছাড়া আরও ১০০ রকমের যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। (টাইমস অব ইন্ডিয়াঃ ০৯.০৭. ২০২২)
অগ্রসর পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশ আমেরিকা, জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, ইটালি, ইংল্যান্ড বহু আগেই এই মারণ-ব্যবসায় ঢুকেছে। এখন ভারত এই ব্যবসায় যথেষ্ট জায়গা করে নিয়েছে। কেন এই মারণ-ব্যবসায়?
যুদ্ধাস্ত্র তৈরির পোশাকি নাম প্রতিরক্ষা শিল্প। নামটির সঙ্গে দেশের সুরক্ষার বিষয়টি যুক্ত করে এক জাতীয় গরিমা তৈরির চেষ্টা হয়। একে ঘিরে দেশ বাঁচানোর জিগির তোলে শাসকরা। এই আবেগ সাধারণত দু’ভাবে কাজ করে। যখন বহিঃশত্রুকে রুখে দেওয়া হয় তখন যেমন এই আবেগ প্রবল গতিতে উঠে আসে, তেমনি যখন পরদেশে হানা দিয়ে বিজয়ী হয়।
প্রতিরক্ষা নামটির সঙ্গে দেশরক্ষার মোড়ক থাকায় এই শিল্পে বেশি বেশি করে অর্থ বরাদ্দ মানুষ সমর্থনও করে। বিশ্বের সব দেশেই শাসকশ্রেণি এখন এই শিল্পে বেশি বেশি করে বরাদ্দ করছে। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, কোনও দেশই বলছে না, তারা পরদেশ আক্রমণ করবে না। ‘পরদেশ আক্রমণ করব না’ এই নীতি সব দেশ মেনে চললে কোনও দেশেরই প্রতিরক্ষা বিঘ্নিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না। তারা এই ঘোষণা করে না কেন? কেন তারা তারা শুধু অস্ত্র তৈরির উপরই জোর দেয়? কেন অস্ত্র রপ্তানি করে? আবার অস্ত্র আমদানিও করে? কারণ অস্ত্রব্যবসাই আজ পুঁজিবাদী অর্থনীতির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুদ্ধ, সন্ত্রাস এই সমস্ত ধ্বংসাত্মক কাজে অস্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক ভাবে বেড়ে চলেছে। বহু পূর্বেই মার্কসবাদী চিন্তানায়ক, রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপকার লেনিন বলেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধের জন্ম দেয়। কেন তিনি এ কথা বলেছেন? কারণ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি বাজার সম্প্রসারণের জন্য পরদেশে হানা দেয়। পুঁজিবাদ সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের পথে যে বাজার সংকটের জন্ম দেয় তার থেকে সাময়িকভাবে হলেও উদ্ধারের জন্য সে অর্থনীতিকে ক্রমাগত যুদ্ধনির্ভর করে তোলে। অর্থাৎ যুদ্ধের অস্ত্র-শস্ত্র, যুদ্ধ বিমান, যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরিতে পুঁজিপতিরা বেশি বেশি করে ঝোঁকে। কারণ এই বাজারের একটা আপেক্ষিক স্থায়িত্ব আছে, যেহেতু সরকারই এখানে ক্রেতা। কিন্তু এর পরিণাম হল, সামরিক বাজেটে বেশি বেশি করে অর্থ বরাদ্দের ফলে অন্যান্য জনস্বার্থবাহী খাতে বরাদ্দ কমতে থাকে। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। শিক্ষায়, চিকিৎসায় কার্যকরী বরাদ্দ বাড়ার বদলে কমতে থাকে। সারে, বিদ্যুতে, গ্যাসে ভর্তুকি কমতে থাকে বা বন্ধ হওয়ার পথে যায়। এই ভাবে যুদ্ধ-অর্থনীতির কুফল জনজীবনে বর্তাতে থাকে। মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, ছোট বড় মাঝারি সব পুঁজিবাদী দেশেরই এই প্রবণতা থাকে অর্থনীতিকে যুদ্ধমুখী করে তোলার।
এই মারণ খেলায় পুঁজিবাদ আজ মত্ত। সারা বিশ্বের মানুষ ইউক্রেন, রাশিয়া যুদ্ধের পরিণতিতে ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধিতে ধুঁকছে। এর থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে, শান্তির ভিত্তির উপর সমাজকে দাঁড় করাতে হলে পুঁজিবাদের অবসান এবং সমাজতন্ত্রের প্রবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়।