পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, কেরালা– সমাজ জুড়ে নারী নির্যাতন চলছেই

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী স্পেশাল ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের অধীনে জেলাগত ভাবে নজরদারি কমিটি গঠনের কথা বলেছেন– যাতে মহিলা ও শিশুদের উপর ঘটে চলা অত্যাচারের বিচার দ্রুত হতে পারে। আর জি করে ডাক্তারি ছাত্রীর নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দেশজোড়া ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন প্রবাহ দেখে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ‘অপরাজিতা’ আইন এনেছেন।

যখন প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মহিলা নিরাপত্তার কথা বলছেন, তখনই ঘটে চলেছে রাজ্যে রাজ্যে কদর্য ও নৃশংস সব ঘটনা। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌয়ে মুমূর্ষু স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্স চালক ও তার সহকারীর হাতে নিগৃহীত হন এক মহিলা। বাধা দেওয়ায় দু-জনকেই চলন্ত অ্যাম্বুলেন্স থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দুষ্কৃতীরা। পরদিন মারা যান ওই মহিলার স্বামী। হরিয়ানার ঝিন্দে এক কিশোরীকে অপহরণ করে ২০ দিন ধরে তার উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় দুষ্কৃতীর। মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনীতে প্রকাশ্য রাস্তায় এক অতি দরিদ্র মহিলার উপর পৈশাচিক অত্যাচার চালায় এক যুবক। পথচারীরা বাধা দেয়নি, তারা ঘটনার ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিল। একটি ঘটনা নৃশংসতায় যেন আর একটিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।

দেশের পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে যখন নাগরিক আন্দোলনের ঢেউ চলছে আর জি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ ও নৃশংস খুনের প্রতিকার চেয়ে, তখনই দক্ষিণে কেরালায় মালয়ালাম চলচ্চিত্র জগত তোলপাড় হচ্ছে মহিলা শিল্পীদের উপর যৌন নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে। ঘটনার সাথে যুক্ত নামী চিত্রাভিনেতা, পরিচালক সহ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত শাসক-ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী নেতা পর্যন্ত। সরকার গঠিত হেমা কমিটির রিপোর্টে শিল্পীদের উপর অত্যাচারের ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কতটা ঠুনকো, দেখিয়ে দিচ্ছে নানা ঘটনাপ্রবাহ। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা আটকানোর জন্য ২০১৩ সালে আইন চালু হয়েছে দেশে। দশ বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও যৌন হয়রানি, যৌন হয়রানিকে কাজ পাওয়ার এবং উন্নতির শর্ত বানিয়ে তোলার মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ কমেনি।

রাজ্যে রাজ্যে এ ধরনের নৃশংস ঘটনাপ্রবাহ বন্ধ হবে কী ভাবে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, শাসক বা ক্ষমতালোভী দলগুলি এই দুষ্কৃতীদের প্রশ্রয়দাতা। তারা মদত দিয়ে দুষ্কৃতীদের পুষ্ট করে, যাতে যে কোনও অন্যায় এদের দিয়ে করানো যায়। কারণ শাসন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে হাজারো অন্যায় তারা করে থাকে। দুষ্কৃতীরাও জানে, দুষ্কর্ম করলেও শাসক ‘দাদা-দিদিদের’ হাত তাদের পিঠের উপর রয়েছে। ফলে শাস্তির আশঙ্কা নেই। শাসকরা প্রতিনিয়ত কাজ করে চলে অপরাধীকে আড়াল করায়। ফলে হাথরসের ঘটনায় আসল অপরাধীকে আড়াল করে খবর করতে যাওয়া সাংবাদিককে জেলে পোরা হয়, বিজয়ী বীরের সর্ম্বধনা দেওয়া হয় জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বিলকিস বানোর ধর্ষক-অপরাধীদের, কিংবা কাঠুয়ায় নিষ্ঠুর ভাবে কিশোরীকে খুন করা ধর্ষকদের হয়ে মিছিল করে শাসক দলের সাংসদ-বিধায়করা। শাসকের এই প্রশ্রয়ই আরও অপরাধের জন্ম দিতে সাহায্য করে।

আজ যারা দিকে দিকে এ ধরনের ঘটনা দেখে ব্যথিত হচ্ছেন, ভাবছেন সমাজটা কী করে দুষ্কৃতীদের আঁতুড়ঘর হল? বুঝতে হবে সমাজের এই পরিস্থিতি একদিনে ঘটেনি। বর্তমান সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমাজে চরম স্বার্থপরতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে চরম উৎশৃঙ্খলতার জন্ম দিয়ে চলেছে। এই ব্যবস্থার রক্ষক বৃহৎ সংবাদমাধ্যম ‘পারমিসিভ সোসাইটি’র নামে ডিস্কো-থেকে মদের ফোয়ারা, যৌন যথেচ্ছাচারের নাম দেয় ‘সাবালকত্ব’। তাদের মদতপুষ্ট সাহিত্যে এই যথেচ্ছাচারকেই মধ্যবিত্ত সমাজের স্বাভাবিক চিহ্ন বলে তুলে ধরে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারে টিকে থাকা মানবিক মূল্যবোধগুলি এই কর্পোরেট মদতপুষ্ট উচ্চকোটির মানুষজনের বিদ্রুপের শিকার। এই সমাজই ছাত্র যুবকদের শেখায় ‘আধুনিক’ হওয়া মানে পঙ্কিল স্রোতে গা ভাসানো। সমাজে গেড়ে বসে থাকা পুরুষতান্ত্রিকতা ইতিমধ্যেই মেয়েদের ভোগ্য বস্তু হিসাবে দেখাতে শেখায়। এই সমাজব্যবস্থা শেখায় মানব জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কিছুই পণ্য। নারী শরীর মহার্ঘ পণ্য।

এই পরিস্থিতি সাগ্রিকভাবে সমাজের মূল্যবোধের কাঠামোয় ঘুণ ধরাতে বাধ্য। পরিবারে পরিবারে তার বিষময় ফল আজ ফুটে বোরোচ্ছে। এর সাথে ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে অবাধ যৌনতার প্রসার চলছে। সব মিলিয়ে এ সমাজে নাগরিক জীবন এক পঙ্কিল ঘুর্ণিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর জি করের রক্তাক্ত মেয়েটি এই সমাজ মননে একটা জোর ঝাঁকুনি দিয়েছে। মানুষ সচেতন হয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইছেন। এটাই আশার।