পর্নোগ্রাফির হাজার কোটির ব্যবসা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে কৈশোর

ফাইল ফটো

সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘ফোনে পর্নোগ্রাফি দেখে বোনকে ধর্ষণ ও খুন কিশোরের’ শীর্ষক সংবাদটি হয়তো অধিকাংশ পাঠকের চোখ এড়িয়ে গেছে। কিন্তু যাঁরা এটা পড়েছেন তাঁরা শিউরে উঠেছেন, স্তম্ভিত হয়েছেন। সমাজ কতটা নিচে নামলে, মূল্যবোধ ও পারিবারিক সম্পর্কগুলি কতটা নিঃশেষিত হলে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে! ২৯ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৪ এপ্রিল মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলার জাভা থানা এলাকার একটি গ্র্রামে।

আরেকটি ঘটনা ঘটেছে কলকাতার ঠাকুরপুকুরে। ‘প্রেমিকের সঙ্গে মিলে মাকে খুন মেয়ের’ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে ৩০ জুলাই বিভিন্ন সংবাদপত্রে। ১৪ বছর বয়সের নাবালিকা মেয়েটি তার নাবালক সঙ্গীর সাথে নিজের বাড়িতে একসঙ্গে রাত্রিবাস করতে চেয়েছে। এ ব্যাপারে মা তাঁর তীব্র আপত্তির কথা জানান। তারা জোর করে রাত্রিবাস করে এবং ওই রাতে ঘুমন্ত মাকে গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে।

তৃতীয় ঘটনাটি বিহারের সুপোল জেলায়। নার্সারির ছাত্র স্কুলে পিস্তল নিয়ে গিয়ে বন্ধুকে গুলি করেছে। এই ধরনের শিহরণ উদ্রেককারী ঘটনা ঘটেই চলেছে।

নৈতিক অবক্ষয়ে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা

আজকের ইন্টারনেটের যুগে প্রচারমাধ্যম অত্যন্ত শক্তিশালী। সংবাদপত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সর্বোপরি সোসাল মিডিয়া আজ অত্যন্ত সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই মাধ্যমগুলির মধ্য দিয়ে বহু প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় তথ্য হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের বর্তমান চরম সংকটের যুগে মানুষের সামনে, বিশেষত ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের সামনে না আছে উন্নত জ্ঞান ও যথার্থ মানুষ গড়ার শিক্ষা, না আছে কর্মসংস্থানের কিংবা সুস্থভাবে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার সুযোগ। অন্য প্রতিটি দেশের মতো আমাদের দেশেও ছাত্র যুব সম্প্রদায় শিক্ষা, চাকরি সহ অন্যান্য জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানের দাবিতে বারবার বিক্ষোভে সামিল হচ্ছে, কখনও কখনও মারমুখী আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে। দিল্লিতে প্যারামেডিকেল ছাত্রী নির্ভয়ার ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘অগ্নিপথ স্কিম’-এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপক আন্দোলন তার প্রমাণ। বাংলাদেশের চলমান সাম্প্রতিক বীরত্বপূর্ণ ছাত্র সংগ্রাম শাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়েছে। তাই পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা এটা ভাল করে বুঝে নিয়েছে, যদি কিশোর ছাত্র-যুব সম্প্রদায়কে বিপথগামী না করা যায়, তা হলে আগামী দিনে তারা পুঁজিবাদবিরোধী ব্যাপক সংগ্রামে ঢেউয়ের মতো এগিয়ে আসবে, আছড়ে পড়বে। তাই স্বাধীনতার পর থেকে সময় যত এগিয়েছে ভারতবর্ষের পুঁজিবাদী শাসকরা বই, পত্রপত্রিকা, চলচ্চিত্র ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে অশ্লীলতা ও যৌনতা এবং হিংস্রতার প্রচার ও প্রসারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদত দিয়ে চলেছে। পরবর্তীকালে টেলিভিশন ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ঢালাও অশ্লীলতা ও যৌনতার প্রচার প্রসার ঘটেছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকে এল ইন্টারনেট এবং তার পরবর্তীকালে একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের হাতে এল মোবাইল এবং তারপরে স্মার্টফোন যা বহুবিধ কাজের উপযোগী ও ক্ষমতাসম্পন্ন। অতিমারি করোনার সময় ‘লকডাউন’ চলাকালীন ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনার প্রয়োজনে কার্যত স্মার্টফোন ব্যবহারে বাধ্য করা হয়। সাধ্য না থাকলেও নিম্নবিত্ত ও সাধারণ মানুষেরাও অতি কষ্টে বাধ্য হন ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্ট মোবাইল ফোন তুলে দিতে। যার পরিণতি হয়েছে মারাত্মক। ‘লকডাউনে’র সময় স্মার্টফোনের মাধ্যমে পড়াশোনা করার কিছুটা আবশ্যকতা থাকলেও করোনা অতিমারির পরে যখন স্বাভাবিক কাজকর্ম ও স্কুল-কলেজে পড়াশোনা শুরু হয়েছে, তখন কিন্তু সেই অর্থে স্মার্টফোনের প্রয়োজনীয়তা কম হওয়ার কথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্মার্টফোনের আসক্তি এতটুকুও কমেনি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ও কিশোর কিশোরীদের মধ্যে তা প্রবল আকার ধারণ করেছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমেই কিছু প্রয়োজনীয় ও শিক্ষণীয় তথ্যের সাথে সাথেই খুলে যাচ্ছে হাজার হাজার পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট। কিশোর, যুবক-যুবতীরা অতি দ্রুত তার শিকার বনে যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও মোবাইলের মাধ্যমে নৃশংস ভায়োলেন্স ও বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ ঘটনা তারা দেখছে। শিশু-কিশোর মনে তার প্রভাব হচ্ছে মারাত্মক যা আমাদের পারিবারিক জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে।

নৈতিকতার অবক্ষয়ে পুঁজিবাদের স্বার্থ কোথায়

বাজার সংকটে জর্জরিত পুঁজিবাদের আজ নতুন করে শিল্পায়নের কোনও সামর্থ্য নেই। সে আজ কলকারখানায় মানুষকে কাজ দিতে পারে না। সে পুঁজি বিনিয়োগের জায়গা খুঁজে নিয়েছে প্রধানত ‘সার্ভিস সেক্টর’-এ। আজ অনলাইন সার্ভিসের ব্যবসা অতি লাভজনক। করোনার সময় যখন সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য সঙ্কটে পড়েছিল তখন এই অনলাইন সার্ভিস, মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবসা হাজার হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য করেছে গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট সহ বিভিন্ন মোবাইল ও নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন দেশীয় ও বহুজাতিক সংস্থা। সারা পৃথিবীতেই অনলাইনকে ভিত্তি করে পর্নোগ্রাফির হাজার হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা চলছে। পাশাপাশি সরকারি মদতে সারা দেশ জুড়ে মদের ও মাদকদ্রব্যের ব্যাপক প্রসার, অশ্লীলতা, হিংসা ও পর্নোগ্রাফির ঢালাও প্রচার চলছে, যা শিশু, কিশোর ও যুব সমাজকে বিপথগামী ও চূড়ান্ত অবক্ষয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বিকৃত যৌনতার শিকার হচ্ছে এরা। এর ফলে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষর্ণ, গণধর্ষণ এবং তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এ এক ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। চোখ বুজে থেকে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

পর্নোগ্রাফি বন্ধে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি উদাসীন

এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলির ভূমিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। বৃহত্তম গণতান্তে্রর এই দেশে সরকারবিরোধী যে কোনও বক্তব্য ইলেকট্রনিক চ্যানেল বা প্রিন্ট মিডিয়া অথবা ওয়েবসাইটে প্রচারিত হলে তাকে রাষ্ট্র্রবিরোধী তকমা দিয়ে ও নানা অজুহাতে বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার, সাংবাদিকদের রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন কালাকানুন দিয়ে কারাবন্দি করছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইচ্ছেমতো তাদের স্বার্থ অনুসারে ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু পর্নোগ্রাফি বন্ধ করার ক্ষেত্রে তাদের কোনও উদ্যোগ নেই। সরকার একদিকে পর্নোগ্রাফি ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষার জন্য এগুলি চলতে দিচ্ছে, অন্য দিকে কিশোর-কিশোরী ও ছাত্র যুবকদের এর মধ্য দিয়ে বিকৃত যৌনদাসে পরিণত করছে। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে যথার্থই বলেছেন, ‘শাসকশ্রেণি আজ অত্যন্ত ভাল করিয়া বুঝিয়া লইয়াছে যে, মানুষকে যদি পশুতে পরিণত করা না যায়, তা হলে ইহাদের দ্বারা পশুর কাজ আদায় করা সম্ভব নয় তাই সর্বাগ্রে ইহাদের পশুতে পরিণত করিয়াছে’।

এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের কথা স্মরণীয়। তিনি এই বিপদ সম্পর্কে দেশের জনসাধারণকে সচেতন করে বলেছিলেন, দেশের এই পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণি কিশোর, ছাত্র, যুবক ও সাধারণ মানুষের নীতি-নৈতিকতা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখাতে গিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় তিনি বলেছেন, পুরনো ধর্মীয় আদর্শ তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। নতুন মার্ক্সবাদী আদর্শ আজও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এর ফলে আদর্শবাদের ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে– সেটাই নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী। তাঁর মূল্যবান শিক্ষাকে সামনে রেখেই এসইউসিআই(সি)-র বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ গভীর উদ্বেগে বলেছেন, আজকের শিশু-কিশোররা আগামী দিনে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ, এরা যদি নষ্ট হয়ে যায়, শৈশবেই তারা নোংরা পর্নোগ্রাফি ও বিকৃত যৌনতার শিকার হয়ে যায়, মদ ও ড্রাগের নেশায় আসক্ত হয়ে যায় তা হলে গোটা দেশের সমস্ত পরিবারগুলো ও সমাজ বিপন্ন হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মই যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সমাজ বিপ্লব হবে কী ভাবে? তাই তিনি দলের সমস্ত স্তরের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষত অভিভাবকদের কাছে আবেদন করছেন, আপনারাও এগিয়ে আসুন, শিশু-কিশোরদের মধ্যে মনুষ্যত্ব, নৈতিকতা রক্ষা করার জন্য ব্যাপকভাবে মনীষী চর্চা ও দেহমনে বিকশিত করার জন্য খেলাধূলা ও শরীর চর্চার উদ্যোগ গ্র্রহণ করুন। ছাত্রযুবদের সামনে উন্নততর আদর্শের সন্ধান দিন। না হলে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণ রোখা যাবে না।