‘‘পড়া দেওয়া আর পড়া নেওয়া, এই দুয়ে মিলে পড়ানো৷ পরীক্ষা যেমন ছাত্রের তেমনি শিক্ষকেরও পরীক্ষা৷ তিনি ছাত্রকে ঠিক মতো শেখাতে পেরেছেন কি না তার পরীক্ষা৷ শিক্ষা থেকে যাঁরা নীতির বালাই তুলে দিতে চান তারাই পাশ–ফেল প্রথা তোলার প্রবক্তা৷’’ প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি ও পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এ কথা বলেছিলেন ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন৷
পাশ–ফেল ব্যবস্থা ফিরে আসছে এই খবরে রাজ্যের মানুষ প্রবল আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত৷ আনন্দের এই মুহূর্তেও সরকারের প্রতি তাঁদের হুঁশিয়ারি, পাশ–ফেল চাই প্রথম শ্রেণি থেকেই৷ এর অন্যথা হলে আবারও মানুষ রাস্তায় নামবে৷ সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারি টালবাহানা তাঁরা কোনওমতেই মেনে নেবেন না৷
বিগত সিপিএম আমল থেকে প্রায় চার দশক ধরে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)–এর উদ্যোগে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে স্কুলশিক্ষায় পাশ–ফেল প্রথা ফেরাবার দাবিতে অবিরাম আন্দোলন চলছে৷ সেই আন্দোলনের চাপেই এ–রাজ্যে তৃণমূল সরকার বাধ্য হয়েছে পাশ–ফেল ফেরাবার কথা ঘোষণা করতে৷ এই বিশাল জয়ে একদিকে যেমন সঠিক নেতৃত্বে গণআন্দোলনের অনিবার্যতা আবারও প্রমাণ হল, আরেক দিকে, গোড়াতেই ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন৷
পাশ–ফেল ফেরানোটা শিক্ষা আন্দোলনের একটা দিক মাত্র৷ মূল যে আন্দোলন এখনও চলছে এবং যাকে দিনে দিনে তীব্র করছে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দল, সেটা হল, এ–দেশে বৈজ্ঞানিক–গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন৷ যার আকাঙক্ষা ছিল দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী মনীষীদের, আপসহীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের৷ দেশের বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে শিক্ষার সেই আন্দোলন সমাজের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে শিক্ষা–সংস্কৃতি–মনুষ্যত্ব রক্ষায় আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে৷
ভারতের মতো একটা দেশে, যেখানে ধনতন্ত্রের তীব্র শোষণ–অত্যাচার দেশের আশি–পঁচাশি ভাগ মানুষকে কার্যত মৃতপ্রায় করে রেখেছে সেখানে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছায় এমনিতেই খুব সামান্য অংশের মানুষের কাছে৷ যেটুকু শিক্ষা পৌঁছায় তাতেও সরকারি নীতির ফলে দিনে দিনে সৃষ্টি হয়েছে ধনী–দরিদ্রের স্পষ্ট ভেদরেখা৷ সাইনবোর্ড নির্বিশেষে যে দলই সরকারে এসেছে তাদের শিক্ষানীতিতেই বলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার গুণমান নির্ভর করবে কে কত টাকা খরচ করতে পারবে তার উপর৷ এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়ে বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষও বলে থাকেন গরিবের ছেলেমেয়েদের কিছুটা কাজ–চালানোর মতো শিক্ষা হলেই যথেষ্ট৷ ফলে তারা স্কুলে এসে একটু মিড ডে মিল খেয়ে, কিছুটা লিখতে পড়তে আর একটু হিসাব শিখে পাততাড়ি গোটালেই মোক্ষ লাভ ধরে নিতে হবে৷ কিন্তু গরিব মানুষ চায় শিক্ষা– বলা উচিত সঠিক গুণমান সম্পন্ন সঠিক শিক্ষা৷ তাই পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার ফলে স্কুলশিক্ষার যে সর্বনাশ হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আলোড়ন তুলেছে৷ এই প্রথা ফেরানোর দাবিতে আন্দোলনে বহু রাজ্যেই তাঁরা সামিল হয়েছেন৷ যা দেখে প্রায় সমস্ত রাজ্য সরকারই পাশ–ফেল ফেরাবার পক্ষে মত দিতে বাধ্য হয়েছে৷ এ সত্ত্বেও আজও কিছু বুদ্ধিজীবী এবং পেশাদার কলমচি বলে চলেছেন, ফেল করার ভয় থাকার ফলেই, ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসে না, স্কুলছুট বাড়ে৷ নিছক পুঁথিসর্বস্ব জগৎ থেকে বেরিয়ে বাস্তবের মাটিতে পা রাখলে তাঁরা দেখতে পেতেন আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থাটাকে৷ এই নির্মম সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, স্কুলছুটের পিছনে মূল কারণ হল দেশের অধিকাংশ মানুষের সীমাহীন দারিদ্র, মারাত্মক আর্থিক বৈষম্য৷ নানা সময়ে গঠিত সরকারি নানা কমিশন এমনকী প্রতীচী ট্রাস্টের সমীক্ষাও বারবার দেখিয়েছে পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার পর থেকে সাধারণ স্কুলে শিক্ষার মানের যে শোচনীয় হাল হয়েছে তার ফলেই ছাত্ররা শিক্ষার প্রতি আরও বেশি করে আকর্ষণ হারিয়েছে৷ ড্রপ–আউট কমেনি বরং দিনে দিনে বেড়েছে৷ দেশের কোটি কোটি নিপীড়িত জনসাধারণকে শিক্ষার নামে ধাপ্পা দেওয়ার জন্যই স্বাধীনতার বাষট্টি বছর পর ‘শিক্ষার অধিকার আইন–২০০৯’ আনা হয়েছে৷ অর্থাৎ, সকলের শিক্ষার জন্য নূন্যতম কোনও পরিকাঠামো তৈরির দরকার নেই, একটা গালভরা আইন বানিয়ে সবাইকে শিক্ষিতের একটা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দাও৷ আর এই শয়তানিকে আড়াল করতে দরিদ্র ঘরের ছাত্রছাত্রীদেরই হাতিয়ার কর৷ স্কুলে খিচুড়ি দিলে একবেলা খিদে মেটে৷ জুতো–জামা–ব্যাগ–সাইকেল দিলেও শিক্ষাটা বাকিই থেকে যায়৷ ওটা দেওয়ার ব্যবস্থা কী? কোনও ব্যবস্থা নেই৷ কারণ, আদতে শিক্ষাটা তো উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য সাধারণ গরিব মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্রছাত্রীদের কার্যত শৈশবেই পঙ্গু করে দেওয়া, যাতে তারা শিক্ষার প্রহসনের পর কার্যত অশিক্ষিতই থাকে৷
পার্লামেন্টে ওই প্রস্তাব আসার সময় এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের সাংসদ তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন৷ কিন্তু, শিক্ষক–অভিভাবক–শিক্ষাবিদ-ছাত্রছাত্রী কারও কোনও মতামতের তোয়াক্কা করেনি সরকার৷ এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দল শিক্ষক–অভিভাবক–ছাত্রছাত্রী সহ সব অংশের মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা-পরামর্শকে পাথেয় করে, সরকার এবং তাদের ভাড়াটে তাত্ত্বিকদের ছড়ানো সমস্ত ভ্রান্ত প্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশজুড়ে আন্দোলন চালিয়েছে, সরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছে৷
যে শিক্ষা পেলে ছেলেমেয়েরা স্বাধীনচেতা–নির্ভীক– মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেই শিক্ষাব্যবস্থা খুব সচেতনভাবেই এ–দেশে প্রবর্তন করা হয়নি৷ তার বদলে ক্রমাগত চেষ্টা করা হয়েছে শিক্ষাকে ধীরে ধীরে বাজারের পণ্য করার, আর মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য মাঝে মাঝেই ‘স্বাক্ষরতা অভিযান’ সুলভ লোকঠকানো নানা প্রকল্প ঘোষণার৷ পরিকল্পনা করেই শিক্ষা খাতে ক্রমাগত বাজেট কমানো হচ্ছে যাতে দেশের জনসাধারণ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকে এবং তাদের ওপর অবাধে শাসন–শোষণ চালিয়ে যাওয়া যায়৷ তাই গদি দখলের যুদ্ধে জিততে সরকারি দল যখন ভণ্ডামো করেই শিক্ষার অধিকারের কথা বলে তখন ধরেই নেয় যে, গরিব–মধ্যবিত্ত হাড়–হাভাতে ঘরের ছেলেমেয়েরা যা হোক তা হোক করে পাশ করে গেলেই খুশি হবে৷ ভাববে সরকার ওদের শিক্ষিত করেছে৷ সরকারি দলের বশংবদ হয়ে তারা ভোটে খাটবে, নেতাদের খোশামুদি করবে৷
পাশ–ফেল মানে নিছক পাশ বা নিছক ফেল বোঝায় না৷ বোঝায় এক বিশেষ মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে, যেখানে ছাত্রের নির্ধারিত মান অর্জন করার সাথে ছাত্র–শিক্ষক উভয়ের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন যুক্ত৷ বাস্তবে প্রথম থেকেই পাশ–ফেলের ব্যবস্থা না থাকলে আজকের দিনে আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে শিক্ষা হয় না৷