… শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনো মতে কষ্টক্লিষ্ট
প্রাণ রেখে দেয় বাঁচাইয়া…
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে–
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে মরে সে নীরবে।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীরবেই মরছেন ওঁরা। এই লকডাউনে স্তব্ধ ভারতের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক আর তাদের পরিবার পরিজন। প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করে বলেছিলেন, বেঁচে থাকলে আবার সব হবে। কিন্তু এত মানুষ বাঁচবেন কী খেয়ে, কীসের ভরসায় তারা সুদূর গ্রামে থাকা পরিজনদের রেখে দেবেন? তার হদিশ দেওয়ার দায় প্রধানমন্ত্রীর নেই। কারণ আপাতত ভোট নেই। ঘরে ফেরার মরিয়া চেষ্টায় তাঁরা শত শত মাইল হাঁটা শুরু করতে বাধ্য হলেন। তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে ট্রাকের ধাক্কায় মরলেন,পথশ্রমে রাস্তায় পড়ে মরলেন। রাষ্টে্রর ভূমিকা? মানুষের কল্যাণ? কে ভাববে এসব কথা? সরকার এদের কী চোখে দেখে, তা বুঝিয়ে দিয়েছে যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য সরকার। ঘরমুখী পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্তুর মতো রাস্তায় বসিয়ে কীটনাশক স্প্রে করেছে তারা। হেঁটে ফেরার মতো কথা ভাবার মতো উপায়ও যাদেরনেই, তাঁরাই গাদাগাদি করে মাথা গুঁজেছেন আশ্রয় শিবিরে। কেমন সে শিবির? দিল্লির কাশ্মীরি গেটের কাছে ভবঘুরেদের জন্য তৈরি কিছু সাময়িক অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। দুপুর রোদে যেটা জ্বলন্ত উনুনের মতো। তাতেও সকলের থাকার জায়গা হয়নি বলে তাদের অনেককেই থাকতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। পেটভরা খাবার নেই, শিশুদের জন্য কোনও দুধ নেই, অভাব পানীয় জলেরও। ১১ এপ্রিল সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। যে দেশের সরকার তাদের একটু আশ্রয় দিতে পারে না, তার পুলিশ কিন্তু প্রবল বিক্রমে লাঠি চালিয়েছে। আতঙ্কে চারজন শ্রমিক যমুনা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। মারা গেছে একজন। সুরাটের শ্রমিকরা ১০ এপ্রিল এমন করেই রাস্তায় নেমে তুলে ধরেছিলেন শিবির আর খাদ্যাভাবের ভয়াবহ অবস্থার কথা। রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন তাঁরা। রাষ্ট্রসংঘ পর্যন্ত ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের এই দুর্দশায় উদ্বেগ প্রকাশ করছে বারবার (আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩.০৪.২০২০)।
কার কাছে যাবেন এরা বিচারের আশায়? তাঁদের হয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মান্দার, অঞ্জলি ভরদ্বাজ ও আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। আর্জি ছিল, লকডাউনে কাজ হারানো শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার ব্যবস্থা করুক সরকার। কারণ, মালিকরা তা দেবে না। চেয়েছিলেন, সংবিধানের ২১ নং ধারা অনুযায়ী এই শ্রমিকদের বেঁচে থাকার অধিকারের সুরক্ষা দিক রাষ্ট্র। আবেদন করেছিলেন, শিবিরগুলিতে মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত খাদ্য অন্তত দিক সরকার। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৩ বিচারপতির বেঞ্চে এই মামলার শুনানি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘শ্রমিকরা শিবিরে খাবার পাচ্ছেন, তাদের আবার মজুরির কী প্রয়োজন?’ তিনি আরও বলেন, শিবিরে নিম্নমানের খাবার দেওয়া হচ্ছে কি না, এসব খোঁজ আদালত নিতে পারবে না। আইনজীবী প্রশান্তভূষণ আবেদন জানিয়ে বলেন যেরকম অপরিকল্পিতভাবে সরকার এগোচ্ছে তাতে আদালত হস্তক্ষেপ না করলে বহু মানুষ চরম দুর্দশায় পড়বেন। আদালত জানিয়ে দিয়েছে সরকারের থেকে ভাল কিছু করতে কোর্ট পারবে না (দ্য কুইন্ট, ৭ এপ্রিল ২০২০)। বিচারপতিরা ১০-১৫ দিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থাৎ ত্রাণ শিবিরে গাদাগাদি করে থেকে দুটি অন্ন খুঁটে কোনওমতে প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রাখার যে ব্যবস্থা হয়েছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের দলকে।
সেই কবে সাঁইথিয়ার রেল লাইন পাতার কুলি লাইনে শ্রমিকদেরদেখে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপলব্ধি করেছিল, উদয়াস্ত গতর খাটার জন্য যে মানুষগুলিকে সমাজ সংসার সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক জায়গায় গাদা করেছে ক্ষমতাবান শ্রেণি, তাদের মানুষ হিসাবে গণ্য করার দায় মালিকদের নেই। সেদিকথেকে প্রধান বিচারপতি নতুন কিছু বলেননি। যে মালিকি রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ এই বিচারালয়, তার কাছে মানুষের জীবনের আলাদা কোনও দাম আছে নাকি? গতর খাটিয়ে মালিকের সিন্দুক ভরানোর জন্যই তো শ্রমিকের দাম! তাই শ্রমিকের প্রাণটুকু রক্ষার মতো খোরাকি রাষ্ট্রের কর্ণধাররা দিতে পারে। তার বেশি চাওয়াই তো শ্রমিকের অপরাধ! আর যাকে পূর্ণ মানুষের চোখেই দেখে না রাষ্ট্রে নায়করা, তার যে পরিবার পরিজনের প্রতি কর্তব্য, দায়িত্ববোধ, মায়া-মমতা থাকতে পারে একথাই বা কর্তারা ভাববেন কেন? এরই অন্যতম স্তম্ভ যখন বিচার ব্যবস্থা, তারই বা ভাববার দায় কী? মন্ত্রী-নেতা-আমলা-বিচারপতিরা জানেন, কিছু লোক বেঘোরে ধুঁকতে ধুঁকতে মরলেও তাদের সেবকের অভাব এই বেকারের দেশে হবে না। ইতিহাস বলে জুরিসপ্রুডেন্সের নামে মোটা মোটা বইতে যত দামি দামি কথাই লেখা থাক না কেন, আসলে শোষণমূলক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সেবাদাস বিচারালয় সর্বদাই বিপদের দিনে খড়গটা নামিয়েছে সমাজের নিচের তলার মানুষের উপরেই। কখনও দোহাই পেড়েছে জাতীয় সুরক্ষার কখনও বা অন্য কিছুর। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, হওয়ারও ছিল না।
সরকারি মতে ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমপক্ষে ৬ কোটি। কাজের আশায় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ায়। এছাড়াও ৪ থেকে ৫ কোটি কৃষি শ্রমিক ফসল কাটা বা বোনার সময় অন্য জেলা বা রাজ্যে চলে যান। প্রথম স্তরের ৬ কোটি শ্রমিকের পরিবারের গড়ে পাঁচজন ধরলে কমপক্ষে তিরিশ কোটি মানুষ এই সামান্য রোজগারটুকুর আশায় পথ চেয়ে থাকে। তাদের কী হবে? সারা দিন-রাত এক করে যারা দিনের পর দিন ইমারত গড়েছে, ঘাম ঝরিয়েদেশের সম্পদ সৃষ্টি করেছে, নিজের বাড়িঘর পরিবার পরিজনের থেকে বহু দূরে পড়ে থেকে যারা শুধু নিজের অন্ন জোগাড় করেনি, তাদের পরিশ্রমের জোরে ভারতের বহু ঘরে আলো জ্বলেছে। দেশের ধনকুবের কোম্পানির মালিকরা পর্যন্ত তার জোরেই কিছু বাজার পেয়ে কারখানা চালুরেখেছে। আজ বিচারপতিরা জানিয়ে দিলেন, পেটের দায় খাটতে এসে, দুটো পোড়া রুটি পেলে চিবিয়ে ধন্য হও। মানুষের মতো জীবনের আশা কোরো না।
করোনা বিপর্যয়ে সারা পৃথিবী জুড়েই কত কোটি মানুষের কাজ চলে যাবে সেই আশঙ্কায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ভারতে ৪০ কোটি পরিবারের নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাবার কথা বুর্জোয়া পরিকল্পনাবিদরাই বলছেন। মন্ত্রী বা তাঁদের আমলাকুল থেকে শুরু করে বিচারপতিরা ঘরে সুরক্ষার নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে দেশের মানুষকে নানা নির্দেশ দিচ্ছেন। আর রোজগার হারানো ৪ কোটিরবেশি শ্রমিক গাদাগাদি করে আশ্রয় শিবিরে। সংক্রমণ নয়, তাঁরা অনেক বেশি চিন্তা করছেন, বাবা মা স্ত্রী সন্তানদের খাবার জোগানো নিয়ে। লক ডাউনের সময় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন– শ্রমিকদের ছাঁটাই করা যাবে না,বেতন দিতে হবে, ভাড়া দিতে না পারলেও শ্রমিকরা ভাড়া বাড়িতে থাকতে পারবেন। কিন্তুসে নির্দেশ রক্ষা করতে গেলে যে প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে হবে তার দায়িত্ব কে নেবে? দেশের মানুষ একটা নতুন কথা ৬ বছরে জেনেছেন–জুমলা। অর্থাৎ নেতা-মন্ত্রীরা অনেক কথা বলেন, কিন্তু তা নিছকই কথার কথা। বিশ্বাস করলে দায় তোমার, নেতাদের নয়।
কিন্তু লকডাউন যদি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরি হয়ে থাকে তাহলে এত শ্রমিকের জীবনের দাম সরকারের কাছে অগ্রাধিকার পাবে না কেন? স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও বুভুক্ষু শ্রমিকের জন্য আদালতে সওয়াল করে বলতে হবে কেন, যতটুকু সাংবিধানিক অধিকার শ্রমিকদের আছে, সেই অনুযায়ী তাদের মজুরি, ভরনপোষণের ব্যবস্থা করাহোক! সরকার তো হয় কথায় নয় কথায় পুঁজিপতিদের ত্রাণে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঢেলে দেয়। অথচ যারা সভ্যতার সম্পদের স্রষ্টা সেই শ্রমিকদের বিপদে সরকার কেন মজুরি দেওয়ার ব্যবস্থা করবে না? মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হয় তো তখনই যখন মানুষের আর্তনাদে সরকার কান দেয় না। শ্রমিকের শ্বাসরোধকারী বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যেও এই সুরাহার পথটাতো কিছুটা হলেও খোলা রাখা ছিল। অথচ আজ আদালত বলছে, সরকারের এই হৃদয়হীন আচরণের বিরুদ্ধে তারা কিছুই করবে না। তাহলে প্রশাসন আর আদালত কি আজ এক হয়ে গেছে?
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে অবসরের পরেই রাজ্যসভায় মনোনীত করার পর সরকার বলেছিল, সংসদ আর আদালতের সমন্বয় রক্ষা করতেই এই মনোনয়ন। অর্থাৎ বিচারব্যবস্থাকে সরকার তথা প্রশাসনের থেকে আলাদা রাখার যে রীতি একদিন বুর্জোয়া গণতন্ত্রই স্বীকার করেছিল, আজ সে রীতি তারা মানবে না, তা জানিয়ে দিল সরকার। স্পষ্ট করেই ইঙ্গিত দিল এই পথেই বিচারালয়কে সরকারি নির্দেশে চালানোর পথে নিয়ে যাওয়া হবে। ঠিক এই কথাটাই স্পষ্ট বলেছেন দিল্লি হাইকর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এপি শাহ– আজ ভারতে বিচারবিভাগ প্রশাসনের লেজুড়ে পরিণত হয়েছে (আনন্দবাজার পত্রিকা ১১.০২.২০২০)। দেশেরকোটিকোটি শ্রমিকের চোখের জল মোছানোর দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে যখন শুনতে হয়, সরকারের কাজের উপর আদালত কথা বলবে না, বিচারপতি শাহের কথাটা স্মরণ করা ছাড়া পথ থাকে না।
সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিচারপতি প্রয়াত কৃষ্ণ আয়ার তুলে ধরেছিলেন এক রূঢ় সত্যকে, বিচারালয়ের তথাকথিত পবিত্র শ্রেণি-ঊর্ধ্ব ভাবকে খানখান করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আইনসভার সদস্যদের কেনার সমস্ত সুযোগ যেমন ধনিক শ্রেণির হাতে আছে, তেমনই বিচারক বেছে নেওয়ার ব্যাপারেও তাদের শ্রেণি স্বার্থই কাজ করে। তাই বিচারব্যবস্থা এবং তার পরিচালিত আইনের শাসন, উভয়েরই শ্রেণিগত পরিচয় আছে (পভার্টি অ্যান্ড জুডিসিয়ারি, ভি আর কৃষ্ণ আয়ার, দ্য হিন্দু ২৯.১২.২০১৩)
বুর্জোয়া শ্রেণি-রাষ্ট্রের রক্ষক সরকার কিংবা আদালতের থেকে পরিযায়ী শ্রমিকের এর থেকে বেশি পাওনা কিছু ছিল নাকি? অধিকার পেতে হলে সংগঠিত লড়াইটাই যে রাস্তা, এই কঠিন সময় অবার তা দেখিয়ে দিচ্ছে।