পরজীবী ধনিক শ্রেণি জনগণের সম্পদ লুঠ করবে, ইহাই তো ধনতন্ত্র

ভবানীপুর, কলকাতা

দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন চাপা আশঙ্কা, ব্যাঙ্কে তাদের কষ্টার্জিত আমানতের সুরক্ষা থাকবে তো আশঙ্কার কারণ একাধিক৷ পরের পর প্রভাবশালী ধনকুবেররা ব্যাঙ্ক থেকে কেউ শত শত কোটি, কেউ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে গা ঢাকা দিচ্ছেন৷

পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ক’দিন আগেই বিদেশে পালিয়েছেন মুম্বইয়ের প্রভাবশালী হিরে ব্যবসায়ী নীরব মোদি৷ ২০১৭ সালে ফোর্বসের সমীক্ষা অনুযায়ী, তিনি ভারতের ৫৭তম বিলিয়নেয়র৷ পিএনবি সহ অন্যান্য ব্যাঙ্ক মিলিয়ে তাঁর ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা৷ এই ব্যাঙ্ক লুঠের খবর ফাঁস হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই রোটোম্যাক কোম্পানির মালিক বিক্রম কোঠারির ৩,৬৯৫ কোটি টাকার জালিয়াতি প্রকাশ্যে এল৷ তার দিন কয়েক বাদে দিল্লির স্বর্ণ ব্যবসায়ী দ্বারকাদাস শেঠের ৪০০ কোটি টাকার জালিয়াতির খবর প্রকাশ্যে এল ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্সে৷ আগেই একাধিক ব্যাঙ্কের ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ না করে বিদেশে পালিয়েছেন সাংসদ বিজয় মালিয়া৷ ৪,৬৮০ কোটি টাকা জালিয়াতি করে পলাতক হয়েছেন ললিত মোদি৷ তাঁকে বিদেশে পালাতে সাহায্য করেন রাজস্থানের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া৷ আর বিজয় মালিয়া তো বিজেপির রাজ্য সভার সদস্যই ছিলেন৷ যতীন মেহতা নামে আর এক হিরে ব্যবসায়ীর লোপাট করা ঋণের পরিমাণ ৫,৫০০ কোটি টাকা৷ মাত্র ১১টি কোম্পানির ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির যে তালিকা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে তার পরিমাণ ১ লাখ দশ হাজার কোটি টাকা৷ ১২ লক্ষ কোটি টাকা ধনকুবেররা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ হিসাবে নিয়ে শোধ করেনি এবং তা আর কোনও দিনই শোধ করবে না৷

এইসব লুঠেরাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনও ব্যবস্থা না নিচ্ছে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ, না নিচ্ছে সরকার৷ উপরন্তু ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের ঘাটতির এই টাকা রাজকোষ থেকে পূরণ করে দিচ্ছে৷ কেন সরকার এই জালিয়াতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না? কারণ, এই জালিয়াতরাই আসলে সরকারের নিয়ামক৷ সরকার আর তার মন্ত্রীরা এই জালিয়াত ধনকুবেরদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার মাত্র৷ নীরব মোদির জালিয়াতির শুরু ২০১১ সালে মনমোহন সিং শাসনে৷ নরেন্দ্র মোদি শাসনে তা বিশাল কলেবর নিয়েছে৷ জাল নথি তৈরি করে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে একের পর এক ব্যাঙ্ক থেকে তিনি অনায়াসে ঋণ নিয়েছেন৷ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তা চলতে দিয়েছে৷ প্রাক্তন ব্যাঙ্ক কর্তারাই বলছেন সরকারের অতি উচ্চ মহলের নির্দেশ ছাড়া এমন অসম্ভব কাণ্ড ঘটতে পারে না৷ সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা– ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে তাঁদের জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে যায়৷ কখনও কখনও ঋণের চেয়ে বেশি টাকার সম্পদ বন্ধক রাখতে হয়৷ অথচ এই ধনকুবেরদের বিপুল অঙ্কের ঋণ সহজেই মঞ্জুর হয় কীভাবে৷

নীরব মোদির ব্যাঙ্ক জালিয়াতি নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে গেলেও সব বিষয়ে বাকপটু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেন৷ কোন গভীর রহস্যের কারণে তাঁর চৌকিদারি বিবেক এমন স্তব্ধ হয়ে থাকল! এক সপ্তাহ মৌনব্রত পালন করার পর তিনি বিবৃতি দিলেন নীরব মোদির সুরেই৷ বললেন, ব্যাঙ্ক কর্তারাই দায়ী৷ তিনি জালিয়াতদের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না, সরকারের দায়িত্ব অস্বীকার করলেন৷ ব্যাঙ্ক কর্তাদের যোগসাজশ তো বোঝাই যায়, কিন্তু কান টানলে যে মাথারা এসে জোটে তাদের খোঁজ করলেন না কেন? নাকি তা আত্মঘাতী হয়ে উঠত তাই? দুই মোদির গভীর সম্পর্ক তো এখন প্রকাশ্যে এসে গেছে৷ সেই চিত্র আগেই প্রকাশ পেয়েছে গত ২৩ জানুয়ারি দাভোসে, ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে৷ সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদির পাশে বিলিয়নেয়র মোদির আসন৷ সরকারি এক অনুষ্ঠানে নীরবের জালিয়াত সঙ্গী মেহুল চোক্সিকে ‘মেহুল ভাই’ বলে ডেকে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁদের হূদ্যতা কত গভীর!

নীরব জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ব্যাঙ্ককে টাকা ফেরত দিতে পারবেন না৷ কারণ পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক তাঁর সম্পর্কে এইসব খবর ফাঁস করে দেওয়ায় তাঁর সংস্থার নাকি বদনাম হয়েছে, ফলে ব্যবসা মার খাচ্ছে৷ তাই তিনি টাকা ফেরত দিতে পারবেন না৷ কী অদ্ভুত! এতবড় জালিয়াতির পরও তিনি এই মনোভাব দেখাচ্ছেন কোন শক্তির জোরে? মাথায় শাসক দলের অদৃশ্য মঙ্গল–হস্ত ছাড়া এই শক্তি কেউ দেখাতে পারে কি? সরকারের সাথেই যদি জালিয়াতদের এমন সুসম্পর্ক হয় তা হলে মানুষ তদন্ত করে শাস্তির আশা করবে কার কাছে? সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাই বা কী আর অবশিষ্ট থাকে!

আমানত নিয়ে মানুষের আশঙ্কার আর একটি বড় কারণ এফআরডিআই বিল৷ এই বিল মোদি সরকার এনেছে ব্যাঙ্ককে আর্থিক দেউলিয়া অবস্থা থেকে বাঁচানোর নাম করে৷ বিলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, ঋণ আদায় না হওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক ক্ষতির সামনে পড়লে গ্রাহকদের টাকা আটকে রাখতে পারবে৷ গ্রাহকের অনুমতি না নিয়েই শেয়ার বাজারে তা খাটাতে পারবে৷ ব্যাঙ্ক ডুবলে সবই ডুবল৷ এ তো প্রকাশ্যে জনগণের টাকা লুঠের আইনি ব্যবস্থা৷

এই বিলের মধ্য দিয়ে পুঁজিপতিদের নেওয়া ঋণের দায় সরকার সরাসরি চাপাতে চাইছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে৷ ঘুরপথে অবশ্য সাধারণ মানুষের উপর এই দায় সরকার চাপিয়ে চলেছে অনেকদিন ধরেই৷ কংগ্রেস রাজত্ব থেকেই সরকারি কোষাগার থেকে ব্যাঙ্কগুলির এই ঘাটতি মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু রয়েছে৷ বিজেপি আমলে লুঠের পরিমাণও বেড়েছে, আর কোষাগার থেকে মিটিয়ে দেওয়া টাকার পরিমাণও বেড়েছে৷ গত বছরই মোদি সরকার ২ লক্ষ ১২ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত মূলধন বরাদ্দ করেছে ব্যাঙ্কগুলির জন্য৷ এই টাকা বর্তমান বাজেটে ভারতের গ্রামোন্নয়ন খাতে বরাদ্দ টাকার দ্বিগুণের বেশি৷ এই টাকা জনগণের ট্যাক্সের টাকা৷ এই টাকায় বহু স্কুল–কলেজ–হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নত হতে পারত, মিড ডে মিলে খাদ্যের পরিমাণ বাড়তে পারত, বহু রাস্তা হতে পারত, সার–বীজে ভরতুকি দিয়ে চাষের খরচ কমানো যেত৷ এই টাকা জনকল্যাণে বরাদ্দ না করে জালিয়াতদের দায় মিটিয়ে চলেছে সরকার৷ এটাই ধনতন্ত্র৷ ধনীর স্বার্থ রক্ষাই এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য৷ যতই গণতন্ত্রের কথা বলা হোক, ধনতন্ত্র আসলে পুঁজিপতিদের লুঠের গণতন্ত্র৷ বুর্জোয়ারা এই লুঠকে আড়াল করতেই গণতন্ত্রকে এতদিন ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে এসেছে৷ কিন্তু একের পর এক ঘটনায় সবই আজ বেআব্রু হয়ে যাচ্ছে৷ গোটা বুর্জোয়া ব্যবস্থা দুর্নীতি জালিয়াতির উপরে দাঁড়িয়ে আছে৷ গোটা ব্যবস্থাটাই আজ দুর্নীতিগ্রস্ত৷

দেশের মানুষ চায় কোন কোন ব্যাঙ্ক অফিসার, সরকারি আমলা এই ঘটনায় যুক্ত সরকার তাদের চিহ্নত করুক৷ চিহ্নত করুক সরকারের প্রভাবশালী কোন কোন মন্ত্রী জড়িত আছে৷ ব্যাঙ্কের যে ছিদ্রপথে জনগণের টাকা হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে সরকার তা বন্ধ করার কী ব্যবস্থা করছে৷ করদাতা জনগণের ঘাড় ভেঙে ব্যাঙ্কের টাকা তছরুপের দায় মেটানো চলতে পারে না৷

এই ব্যাঙ্ক জালিয়াতি সাধারণ মানুষের কাছে কী শিক্ষা রেখে যাচ্ছে? শক্তিশালী জালিয়াত চক্র এবং সরকারের ভূমিকা দেখাচ্ছে ব্যাঙ্কে জনগণের টাকার সুরক্ষা কত দুর্বল৷এই অবস্থায় আমানত রক্ষার দাবিতে জনগণকে সক্রিয় ভূমিকায় আসতে হবে, সংগঠিত হতে হবে৷ গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী দেশের নির্বাচিত সরকার জনস্বার্থ রক্ষার প্রতি দায়বদ্ধ৷ কিন্তু মানুষের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে সরকার তা অস্বীকার করে চলেছে৷ জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে৷ আজ আমজনতার আমানতটুকু রক্ষা করতে হলেও এই দুর্নীতিগ্রস্ত লুঠেরা ব্যবস্থাকে বদলে দেওয়ার আন্দোলনে সামিল হতে হবে, না হলে আমানত তো বটেই, জীবনের কোনও অধিকারই সুরক্ষিত থাকবে না৷