পঞ্চ ভয়ঙ্করী

অর্থনীতিবিদেরা লিখছেন, ‘পুঁজিবাদের স্বাস্থ্যই এখন মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।’ আজ বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো সভ্যতাকে পরের শতাব্দীতে পৌঁছে দেওয়ার খোয়াব দেখাচ্ছে। তারা নাগরিক সমাজকে আশ্বস্ত করতে চাইছে যে সম্পদের প্রাচুর্য সৃষ্টি করে আক্ষরিক অর্থেই তারা ‘স্বর্গে পৌঁছাতে পারে’।

বাস্তবে, কেবলমাত্র এলন মাস্ক (টেসলা মোটরস এর কর্তা), জেফ বেজস (অ্যামাজনের কর্তা) এবং রিচার্ড ব্র্যানসনের (ব্রিটিশ ধনকুবের) আকাঙক্ষাই তাদের ব্যক্তিগত রকেটে চড়ে মহাশূন্যে আছড়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। আর আমরা হতভাগারা তাদের রকেটের পরিত্যক্ত ধোঁয়ায় মাথা ঘুরিয়ে, চোখ ধাঁধিয়ে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করি।

চিনও মহাকাশে একটা প্রাসাদ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে বেজিং-এ স্বর্গের মন্দির তৈরি হয়েছিল, যেটা সে দেশের দর্শনীয় স্থান হিসাবে অন্যতম। সত্যি বলতে কি, তাদের এই উচ্চাকাঙক্ষা পরিচালিত হচ্ছে পৌরাণিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। তারা অভিযাত্রী সহ মহাকাশ অভিযানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটা মহাকাশযান বানিয়ে নাম দিয়েছে সেনঝৌ (ঐশ্বরিক ভূমি) এবং পৃথিবীর নিকট কক্ষপথ বরাবর একটি মহাকাশ স্টেশন তৈরি করে তার নামকরণ করেছে তিয়াংগং (স্বর্গীয় প্রাসাদ)। স্পষ্টতই, চিন মহাকাশে তার স্বপ্ন ছড়ানোর সাথে একযোগে পুরাণকথাও ছড়িয়ে দিতে উদগ্রীব। ডিজিটাল যুগ বলে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে শেষে এই তার পরিণতি! আসলে বড় বড় বুলির আড়ালে অসমঞ্জস ভাবনার প্রসারটাই এ যুগের নিয়ম।

অ্যামাজন, গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট এবং ফেসবুক– এদের ‘পঞ্চ ভয়ঙ্করী’ (দ্য ফ্রাইটফুল ফাইভ) অভিহিত করে নিউইয়র্ক টাইমসের লেখক ফরহাদ মঞ্জু বলছেন, আমরা কী ভাবে যোগাযোগ করি, কী ভাবে লেনদেন করি, কী ভাবে বিনোদন করি, কোথায় কী খাই এবং কার সাথে বন্ধুত্ব করি সমস্ত ব্যাপারে নাক গলিয়ে এরা জীবনকে কল্পনাতীত ভাবে বদলে দিয়েছে। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, স্মার্টফোন, নজরদারি ক্যামেরা ইত্যাদি সবকিছু থেকে সহজেই ডিজিটাল তথ্য পাওয়া যায়। বেশি তথ্য মানেই কিন্তু সবসময় সেটা নির্ভরযোগ্য নয়। ডিজিটাল প্রযুক্তি তথাকথিত প্রকাশ্য এবং নিষিদ্ধ সমাজের ফারাকটা অস্পষ্ট করে দিয়েছে।

জ্ঞানজগতে অন্ধত্বও কম উদ্বেগজনক নয়। প্রযুক্তির একনায়কত্ব আর একটি সমস্যা। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিক– আমাদের বক্তব্য, আমাদের অভিব্যক্তি, আমাদের রাজনৈতিক ভাবনা-ধারণা এবং ভাবগত অভিরুচি– সবকিছু খুঁড়ে বের করছে এবং পণ্যায়িত করা হচ্ছে। এমন অতন্দ্র প্রহরাবেষ্টিত সমাজে এবং প্রযুক্তির একনায়কত্বের যুগে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে? ইজরায়েলি ইতিহাসবিদ য়ুভাল নোহ হারারি একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা শুনিয়েছেন। তাঁর মতে তিনি একটা পূর্বাভাস পাচ্ছেন, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি এবং জৈবপ্রযুক্তি এমন মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে যে, শুকিয়ে যাবে ‘সকল মানব সংস্থা এবং এমনকি, মানুষের আকাঙক্ষাগুলো পর্যন্ত। প্রযুক্তি একটা শাঁখের করাত। একদিকে উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগায়, আবার সঙ্গে বিপর্যয়কে গাঁটছড়া বেঁধে টেনে আনে। একই প্রযুক্তি যা কোটি কোটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়, আবার তাদের নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের আওতায় রাখে। …

অ্যামাজন, গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট এবং ফেসবুক অনেক সরকারের চাইতেও বেশি শক্তিশালী। অবয়বের সাথে সাথেই শক্তি বাড়ে। গুগল এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক রাজনৈতিক অনুদান দেয়। এখন এরা সমস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে। এদের শেয়ারের দাম এবং মুনাফা বাড়ছে উল্কাবেগে। অধিকাংশই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে। এদের কর মেটানোর অস্বচ্ছতা দেখেও সরকার দেখছে না। গত বছর, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল গাড়িগুলির অন্যতম রোলস-রয়েস রেকর্ড সংখ্যায় বিক্রি হয়়েছে। কোভিড অতিমারি চলাকালীন যেখানে অর্থনীতির অচলাবস্থাটাই নিয়ম, সেখানে এই ‘পঞ্চ ভয়ঙ্করী’ সহ কিছু অতিকায় প্রযুক্তি সংস্থা রেকর্ড অঙ্কের ব্যবসা করেছে। এইসব অতিকায় প্রযুক্তি সংস্থাকে ‘প্যান্ডেমিক ক্যাপিটালিস্ট’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এরা বোধ হয় মনেপ্রাণে কামনা করে অতিমারি চিরতরে স্থায়ী হোক। বড় বড় এইসব টেকনোলজি কোম্পানি উপভোক্তাদের কাছ থেকে তাদের সম্ভাব্য পছন্দ, অপছন্দ এবং আকাঙক্ষা ইত্যাদির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে।

ইন্টারনেট একবিংশ শতাব্দীর প্রাণভোমরাতে পরিণত হওয়ার মাশুল হিসাবে, প্রযুক্তি নির্ভর গুণ্ডাগিরি (সাইবার বুলিং), মিথ্যাশ্রয়ী পর্যালোচনা (ম্যানিপুলেটিভ অ্যানালিটিক্স), ভুয়ো খবর এবং কর্তৃত্ববাদী নজরদারির (অথরেটেরিয়ান সার্ভিলেন্স) জন্ম হয়েছে। এটাকে ব্রুক ম্যানভিল ‘ডিজিটাল ডেমোক্রেটিক ইউটোপিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন। কোরিয়ান বংশোদ্ভূত সুইস-জার্মান দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক সংস্কৃতিবিদ ব্যুং-সুল হান বলেছেন, এই হচ্ছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি এবংসোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব যাকে আমরা আমাদের ‘আকাঙিক্ষত নিজস্ব আধিপত্য’ বলে ভাবতে শুরু করেছি। আমাদের ব্যক্তিগত সব তথ্যই এখন পণ্যায়িত এবং বাণিজ্যিকৃত। আরও একধাপ এগিয়ে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘হেগেলীয় পরিভাষায় যাকে দাসপ্রভু-ক্রীতদাস দ্বন্দ্ব বলে তার থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা একই সাথে দাসপ্রভু এবং ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছি।’ জনগণ এখন গড্ডলিকা প্রবাহ তৈরির সম্মোহনের খপ্পরে (‘মাস ফর্মেশন হিপনোসিস’)–জনগণকে এমন একটা স্তরে নিয়ে আসা হচ্ছে যাদের সহজেই মিথ্যাচারে প্রভাবিত করা যায় এবং যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়াই হুজুগের পিছনে ছোটানো যায়।… অচিরেই এরকম সম্ভাবনা তৈরি হবে যে, নির্বাচনের আগে প্রতিটি ভোটার আলাদা আলাদা ভাবে একই প্রার্থীর থেকে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা এবং একটি ভিন্ন প্রচারপত্র পাবে। ফলে রাজনীতি একটি তথ্যনির্ভর বিজ্ঞানে পরিণত হবে। এভাবে বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো অতিকায় পুঁজিপতিদের মতো সমৃদ্ধ হয়েছে।

বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো এখন মহামতি সরকারের ক্ষমতা নিয়ে আবির্ভূত। তারা কারও পরোয়া করে না এবং কাউকে মেনেও চলে না। তাদের কোনও নির্বাচন লড়তে হয় না। বৈধ ঘুষের কারবার চালিয়ে বড় বড় কর্পোরেটগুলো গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। নর্থওয়েস্টার্ন এবং প্রিন্সটন গবেষকরা ২০১৪ সালে একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছিলেন, আইন প্রণেতারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের মতামতের তোয়াক্কা করে না। তারা বেশিরভাগই বড় বড় দাতাদের সেবাদাস। ভারতেও এটাই চলছে। ক্ষমতাধর কর্পোরেটদের লাগাম কষতে ব্যর্থ হলে পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আরও বাড়বে এবং তার পরিণতিতে গণতান্ত্রিক রাজনীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ কল্পনা করতে পারছে না। ইতিহাসের শিক্ষা বলে, এই সব প্রবণতাই সস্তা জনপ্রিয়তার রাজনীতি, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং চরমপন্থার দিকে নিয়ে যায়। সকলে প্রথম দর্শনেই ইন্টারনেটের চমকপ্রদ প্রযুক্তির প্রেমে পড়ে। এমআইটি-র সমাজবিজ্ঞানী শেরি টার্কেল চমৎকার বর্ণনা করেছেন, ‘‘আমরা ছিলাম তরুণ প্রেমিকদের মতো, যারা আলাপ-আলোচনা চাইতাম না। ভেবেছিলাম তাতে রোমান্সটাই মাটি হবে।” এখন এই রোমান্সটা অপরিণামদর্শী প্রেমে উপনীত। ‘‘এই তো আলাপ-আলোচনার আসল সময়।”

(দিল্লির ইন্সটিটিউট অফ সোস্যাল সায়েন্স-এর অধিকর্তা আশ নারাইন রাও রচিত এই নিবন্ধটি ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকাতে ২১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ‘আগলি লাভ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তার অংশ বিশেষ প্রকাশ করা হল।)

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২২ এপ্রিল ২০২২