সারা দেশেই সর্বনাশের গভীর খাদের মধ্যে শিক্ষার মান৷ কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সর্বশেষ প্রকাশিত ‘অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট–২০১৮’ সেটাই স্পষ্ট করল৷
সারা দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাধারণ মানুষ, অভিভাবকরা ২০০৯ সালে পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার সময় ঠিক এই আশঙ্কাই করেছিলেন৷ সেদিন তাঁরা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন এই বিপদকেই রোখবার জন্য৷ তা আজ দগদগে ঘায়ের মতো সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ফুটে বেরোচ্ছে৷
১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই রিপোর্ট অনুযায়ী সরকারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির প্রায় ৫৬ শতাংশ ছাত্র–ছাত্রী দ্বিতীয় শ্রেণির উপযুক্ত মাতৃভাষায় লেখা গদ্য পর্যন্ত পড়তে পারে না৷ যত উপরে উঠেছে হাল তত খারাপ হয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া ৭৩ শতাংশ ছাত্র–ছাত্রী কোনও রকমে দ্বিতীয় শ্রেণির বই পড়তে পারলেও তার উপরের কোনও শ্রেণির বই পড়তে পারছে না৷ এমনকী তাদের অর্ধেক জন অক্ষর, যুক্তাক্ষর চেনে না, অনেকে সংখ্যা চিনতে না পারলেও অষ্টম শ্রেণিতে উঠে গেছে৷ অষ্টম শ্রেণির অর্ধেকের বেশি ছাত্র শিশু–পাঠ্য গল্পও পড়তে পারছে না৷ অষ্টম শ্রেণির ৫৬ শতাংশ এবং পঞ্চম শ্রেণির ৭২ শতাংশ ছাত্র–ছাত্রী সাধারণ ভাগ বা গুণ করতে পারে না৷
যদিও সর্বভারতীয় গড় দেখে সারা দেশের আরও গভীর সংকট–চিত্র পুরো বোঝা যাবে না৷ ঝাড়খণ্ডের মাত্র ৭০.৬ শতাংশ, আসামের ৬৬.৫ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৬৫.৬ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র–ছাত্রী দ্বিতীয় শ্রেণির পড়া বুঝতে পারে না৷ উত্তর–পূর্ব ভারতের অবস্থা আরও শোচনীয়৷ দেখা যাচ্ছে, যে রাজ্যের অর্থিক পরিস্থিতি যত খারাপ তাদের শিক্ষার মানও তত নেমেছে৷ বেসরকারি স্কুলগুলির ক্ষেত্রে এই মান সরকারি স্কুলের তুলনায় কিছুটা ভাল হলেও খুব আশানুরূপ নয়৷ এক্ষেত্রে একেবারে উচ্চস্তরের বেসরকারি স্কুলগুলির সাথে নিতান্ত সাধারণ মানের বেসরকারি স্কুলের তফাত আকাশ–পাতাল৷ এর ফলে গড়ে বেসরকারি স্কুলগুলির ৬১ শতাংশ ছাত্র–ছাত্রীর মান কিছুটা ভাল দেখালেও বাস্তবে সাধারণ বেসরকারি স্কুলের অবস্থা মোটেই ভাল নয়৷
শুধু মান কমেছে তাই নয়, ৬ থেকে ১৪ বছরের যে শিশুদের স্কুলে ভর্তি সুনিশ্চিত করার কথা সরকার বলেছিল, তাদের ভর্তির হারও কমছে৷ ২০০৯–এ পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার পর রিপোর্ট বলছে ২০১২–১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারি স্কুলে ভর্তির হার ক্রমাগত কমে চলেছে৷ শিক্ষার অধিকার আইন, মিড–ডে মিল, সব স্কুলে শৌচাগার–এমন সব নানা প্রচারের পরেও এই হাল কেন? উত্তরটা কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই পেয়েছেন৷ অথচ মুষ্টিমেয় একদল তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, খবরের কাগজের কলমচি এখনও তা ধরতে পারছেন না এমনিতেই সরকারি স্কুলগুলি শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে৷ সরকারি হিসাবেই দেশের প্রায় ১ লক্ষ প্রাথমিক স্কুলে মাত্র ১ জন করে শিক্ষক৷ এর উপর স্কুলের ক্লার্কের কাজ, মিড–ডে মিল থেকে শুরু করে স্কুলের বাইরে সেন্সাস কিংবা ভোটার তালিকা তৈরি পর্যন্ত সব দায়িত্ব থাকে তাঁদেরই কাঁধে৷ প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে লক্ষাধিক শিক্ষকপদ শূন্য সারা দেশেই৷ ফলে পড়ানো ব্যাপারটাই পিছনে চলে গেছে৷ নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন কিংবা পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের বাড়তি পড়ানো তো অনেক দূরের কথা৷ এদিকে পাশ–ফেল প্রথা না থাকায় সরকারি স্কুলের ছাত্ররা কিছু শিখুক না শিখুক উঠে যাচ্ছে ধাপের পর ধাপ৷ দরিদ্র পরিবারগুলির পুরুষ–মহিলা উভয়কেই আজ কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হয়৷ কেউ ছোটে কাছের বড় শহরে, কেউ পাড়ি জমায় ভিনরাজ্যে৷ পরিবারেও ছেলেমেয়েদের পড়ার খোঁজ রাখবে কে? পাশ–ফেল প্রথা থাকলে তবু অভিভাবকরা কিছুটা খোঁজ খবর নিতেন৷ এখন ছেলে–মেয়ে তরতর করে ক্লাসের পর ক্লাস উঠে যাওয়ায় সে খোঁজের দরকারও তাঁরা বোধ করেন না৷ ছাত্র–ছাত্রীরাও আগের ক্লাসের পড়া কিছু না শিখেই পরের ক্লাসে উঠে যাওয়ায় নতুন পড়া কিছুই বুঝতে পারছে না৷ কিছুদিন স্কুলে বসে থেকে পড়াশোনায় আগ্রহই হারিয়ে ফেলছে৷ পরিবারের আর্থিক দুর্দশার কারণে কাজের খোঁজেই কোথাও মাথা গুঁজে দিচ্ছে৷ বাড়ছে ড্রপআউট৷ সব নামীদামি শিক্ষা পরিকল্পনার ওখানেই ইতি
সরকারি স্কুলের যখন এই হাল সেই সুযোগে গ্রাম–মফস্বল থেকে শহরে বেড়েছে বেসরকারি স্কুলের রমরমা৷ একবারে গ্রামাঞ্চলেও নার্সারি থেকেই তার শুরু৷ একটু সংগতি থাকলেই এইসব বেসরকারি স্কুল আর কোচিং সেন্টারে সন্তানকে নিয়ে ছুটছেন বাবা–মায়েরা৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইসব স্কুলের বাইরের চাকচিক্য যত, ভিতরটা ততই ফাঁপা৷ পশ্চিমবঙ্গে এই বেসকারি স্কুলের রমরমা শুরু হয়েছিল সিপিএম সরকার প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ও পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার পর৷ ২০০৯ থেকে কেন্দ্রে কংগ্রেস, রাজ্যে তৃণমূল, আবার তারপরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার জেদ ধরে থাকার ফলে শিক্ষার ভিতটাই পুরো ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে৷ বিশেষত তথাকথিত শিক্ষার অধিকার আইনের পর তার ক্ষয় আরও দ্রুত বেড়েছে৷ মুষ্টিমেয় কিছু ব্যয়বহুল ভাল ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছাড়া বাকি বেশিরভাগ স্কুলের পড়ার পরিবেশটাই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সুপরিকল্পিত এই চক্রান্তে৷
এইরকম এক সর্বনাশা পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়েও কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি নানা অজুহাতে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে৷ প্রয়োজনীয় সংখ্যায় শিক্ষক নিয়োগ করার কাজে টালবাহানা করে চলেছে৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একই কাজ করছে৷ সব জেনেও তারা এমন টালবাহানা করে দেশের কয়েক কোটি ছাত্রছাত্রীর এমন সর্বনাশ চলতে দিচ্ছে৷ তা হলে কি বেসরকারি মালিকদের মদত দেওয়াই এর উদ্দেশ্য? এর স্পষ্ট জবাব কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে দিতে হবে৷ এস ইউ সি আই (সি) দলের ধারাবাহিক আন্দোলন এবং জাগ্রত জনমতের চাপে তারা পাশ–ফেল চালুর কথা বলতে বাধ্য হয়েছে৷ কিন্তু মানুষ আর কালক্ষেপ করতে দিতে রাজি নয়৷ হয় সরকার এখনই ঘোষণা করুক প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল ফিরবে৷ না হলে মানুষ তা আদায় করবে আন্দোলনের মাধ্যমেই৷