অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষায় ‘ব্লেন্ডেড মোড’ আনা হয়েছে। ১৭ জুলাই অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটি আয়োজিত এক অনলাইন সেমিনারে এ কথা বলেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর। তিনি আরও বলেন, ইতিহাসের গেরুয়াকরণকে বাস্তবায়ন করার জন্য ইউজিসিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই বিষয়ে তাঁদের চালিকা শক্তি হল ইণ্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম। আসলে হিন্দু মহাসভা, আর এস এস তাদের হিন্দুত্ববাদী স্বপ্নকে এই শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত করার জন্য পরিকল্পনা করছে। ভারতের বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’ আজ বিপন্ন হতে চলেছে। হিন্দুত্ববাদী চিন্তাকে শিক্ষার মধ্যে এনে আমাদের দেশের নবজাগরণ, সমাজ সংস্কারক ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সার্বজনীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে উৎপাটন করতে চাইছে।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সীমা বৈদ্য বলেন, ব্লেন্ডেড মোডের মধ্য দিয়ে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক অনলাইন করণ করা হবে। তিনি ইউজিসি প্রকাশিত ব্লেন্ডেড মোডের নথি বিশ্লেষণ করে দেখান, কীভাবে প্রতিটি পয়েন্টে অনলাইন শিক্ষার উপরে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই পদ্ধতির দ্বারা রাষ্ট্র শিক্ষায় সামগ্রিক বেসরকারিকরণ ঘটাবে এবং পড়াশোনার সমস্ত দায় ছাত্রদের উপরে চাপিয়ে দেবে। এর ফলে ছাত্ররা পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারাবে, ড্রপ আউট বাড়বে, শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হবে। শিক্ষার মধ্য দিয়ে যে সামাজিকবোধ, দায়িত্ববোধ গড়ে ওঠে সেটা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাটাই ভিতর থেকে ধ্বংস হয়ে যাবে।
কলকাতার আই আই এস আর-এর ভাটনগর পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৌমিত্র ব্যানার্জী ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে পুরানো ধ্যানধারণা, অবৈজ্ঞানিক কাল্পনিক চিন্তাকে শিক্ষায় আনার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি দেখান কীভাবে সভ্যতার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জ্ঞান জগতের ধারণা বিকশিত হয়ে আজকের বিজ্ঞানসম্মত ধারণাগুলি এসেছে। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে সেই ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে নানা অবৈজ্ঞানিক ধারণাকে বিজ্ঞান বলে চালানো হচ্ছে। তারা গণেশের ঘাড়ে হাতির মাথাকে দেখিয়ে প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির অগ্রগতি, সাত হাজার বছরের আগে বিমানের অস্তিত্ব, গোরু শ্বাসপ্রশ্বাসে অি’জেন ছাড়ে ইত্যাদি ধারনা সিলেবাসে আমদানি করছে। অথচ উক্ত সময়ে ভারতে জ্ঞানচর্চায় যারা বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেছেন সেই বরাহমিহির, আর্যভট্ট, পাণিনি, চরক, শ্রুশুতদের নাম মুখে পর্যন্ত আনছেন না।
অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির সর্বভারতীয় সম্পাদক অধ্যাপক অনীশ রায় ইতিহাসের গেরুয়াকরণের উপরে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি ইউজিসি উচ্চ শিক্ষার জন্য ইতিহাসের নতুন একটি সিলেবাস ঘোষণা করেছে, যেখানে ইতিহাস পড়ানো হবে অথচ ইতিহাস কীভাবে নির্মাণ হয়, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথেসেই চিন্তাকে সামনেরেখে কীভাবে ইতিহাসের আহরিত তথ্যগুলিকে বিশ্লেষণ করতে হয় এবং ইতিহাসের পুনর্নিমাণ করতে হয় সেই পদ্ধতি ছাত্রদের শেখানো হবে না। প্রাচীন ভারতের সাহিত্যের গৌরবের নামে বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি পড়ানোর কথা বলা হয়েছে কিন্তু সেই সময়ের চরক, কৌটিল্য, কালিদাস প্রমুখ রচনাকে সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েছেন। ইতিহাসের নামে বিকৃতি, পক্ষপাত দুষ্ট, কাল্পনিক ভাবনা, অনৈতিহাসিক বিদ্যাগুলিকে ইতিহাসের নামে চালাতে চাইছে। এর ফলে ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক, সামগ্রিক, বাস্তব তথ্যনির্ভর বিষয়গুলি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হবে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন কমিটির রাজ্য সভাপতি প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী। তিনি এই ধ্বংসাত্মক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই শিক্ষানীতির দ্বারা সমাজে দুটি শ্রেণি তৈরি হবে। শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবসায়ীকরণ ও কর্পোরেট করণের জন্য এই ধরনের সিলেবাস আমদানি করা হচ্ছে। জাতি সংস্কৃতি সমস্ত কিছুকেই ধ্বংস করার এই পরিকল্পনাকে আমাদের রুখতেই হবে।
কমিটি ২৯ জুলাই বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবসকে সেভ এডুকেশন দিবস হিসাবে পালন করার আহ্বান জানায় এবং কলকাতা সহ জেলায় জেলায় রাস্তায় নেমে এই কর্মসূচি পালিত হয়।