গুজরাটের নির্দলীয় বিধায়ক জিগ্নেশ মেওয়ানিকে সরকারবিরোধী একটি টুইট করার ‘অপরাধে’ অসম পুলিশ মাঝরাতে গুজরাট গিয়ে গ্রেপ্তার করে। শুধু তাই নয়, ওই অভিযোগ থেকে জামিন পেয়ে যাওয়ার পরেও হেফাজতে থাকাকালীন এক মহিলা পুলিশকর্মীকে অশ্লীল মন্তব্য, হেনস্থা ইত্যাদির অভিযোগে আবার গ্রেপ্তার করা হয়।
কী ছিল সেই টুইটের বিষয়বস্তু? কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমালোচনা করা হয়েছিল তাতে। কথা প্রসঙ্গে এসেছিল নাথুরাম গডসে, গুজরাটের হিংসা এবং নরেন্দ্র মোদীর কথা।
সেই অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হল বিজেপি শাসিত রাজ্য অসমে। অসম পুলিশ মধ্যরাত্রে গুজরাট গিয়ে ট্রানজিট রিমান্ডে তাকে গ্রেপ্তার করে অসম নিয়ে আসে। কোকরাঝাড় আদালত এই মামলায় জামিন মঞ্জুর করলেও বরপেটা পুলিশ দ্বিতীয় অভিযোগে তাকে আবার গ্রেপ্তার করে। সংবাদে প্রকাশ গোয়ালপাড়ায় তার বিরুদ্ধে তৃতীয় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
এই অভিযোগ ও গ্রেপ্তারের চক্রান্ত এতটাই নগ্ন ভাবে সাজানো যে আদালত পর্যন্ত মামলাগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলতে বাধ্য হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন বা চমকে উঠবার মতো নয়, বিশেষ করে আমাদের দেশে তো নয়ই। অভিযুক্ত জিগ্নেশ মিডিয়ায় পরিচিত মুখ, সর্বোপরি তিনি একজন নির্বাচিত বিধায়ক বলে এই গ্রেপ্তার এতখানি আলোচ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু আজ বিরোধী স্বরের কণ্ঠরোধ ক্ষমতার রাজনীতির ‘আইডেন্টিটি’ হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস জমানাতে নানা কালাকানুন এনে অথবা বিরোধীদের গুম খুন বা মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে থামিয়ে দেওয়ার যে সর্বনাশা ট্র্যাডিশন শুরু হয়েছিল বিজেপি শাসনামলে আরও ব্যাপ্তি ও তীব্রতা নিয়ে সেই দমন পীড়ন আজ তার দাঁত নখ বের করেছে।
নাগরিক জীবনের অধিকার, গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিদিন চরমভাবে পদদলিত হচ্ছে যার বেশিরভাগের খবর সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। ডাঃ বিনায়ক সেন, সমাজসেবী স্ট্যান স্বামী, ছাত্র নেতা উমর খালিদ বা জিগ্নেশদের সাথে হওয়া চরম অগণতান্ত্রিক ঘটনাগুলো কখনও কখনও আমাদের চেতনার ঝুঁটি ধরে নাড়া দিয়ে যায়। আমরা চমকে উঠি অথবা আতঙ্কিত হই। কিন্তু এই চমকে ওঠা বা আতঙ্ক গণতন্ত্রের নামে এই রাষ্ট্রীয় দমনকে রুখতে পারবে না। কেন এই কণ্ঠরোধ? কেন এই আক্রমণ? এর সমাধান কোথায়? এর উত্তর আজ খুঁজতে হবে।
একথা অনস্বীকার্য যে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশই আজ ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য নিয়েই অবস্থান করছে। চূড়ান্ত কেন্দ্রীভূত পুঁজি, শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র এবং অবৈজ্ঞানিক যুক্তিহীন মননের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ তার বিষাক্ত ডালপালা প্রসারিত করে। সমাজের কোনও ক্ষেত্রেই ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ আজ সে দিতে পারে না। তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তির অধিকার, আধুনিক জীবনবোধের ধারণা নিয়ে আসা বুর্জোয়া গণতন্ত্র আজ কালের অমোঘ নিয়মে তার সকল প্রগতিশীলতা হারিয়েছে। অথচ এই বুর্জোয়া গণতন্ত্র তার Øষাকালে যে চিন্তা এনেছিল, তা ভলতেয়ারের ভাষায়– ‘‘আমি তোমার মতের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকার রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করতে রাজি আছি।” গণতন্ত্রের Øষালগ্ন মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে এমন ধারণাই দিয়েছিল। একদা সাম্য, মৈত্রী স্বাধীনতার মহান স্বপ্ন দেখানো গণতন্ত্র আজ ইতিহাসের অনিবার্যতায় মরণাপন্ন। যে গণতন্ত্র একদিন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য মরণপণ লড়াই করেছিল আজ সেই গণতন্ত্র নাগরিক জীবনের সমস্ত অধিকার বেপরোয়াভাবে হরণ করছে। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও আজ সে দিতে রাজি নয়।
তাই একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধী একটি টুইটও আজকের ভারতে গ্রেপ্তারযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়। এই সমাজব্যবস্থা আমাদের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, সীমাহীন দারিদ্র, বেকারি আর কর্মসংকোচন, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতা, পতিতাবৃত্তি, ক্ষুধা, দমনপীড়ন আর তার বিপরীতে কর্পোরেট হাঙরদের মুনাফা আর পুঁজির এভারেস্ট নির্মাণ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না।
তাই, এই পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সেবক দলগুলোকে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক ভাবেই তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে হবে। পুঁজিবাদের লুন্ঠন-শোষণের স্টিমরোলার বিনা বাধায় যাতে চলতে পারে তার জন্যে চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী আক্রমণ নামিয়ে আনতে হবে সর্বক্ষেত্রে। এ ছাড়া তার বেঁচে থাকার উপায় নেই। এই সেবা যে যত নিষ্ঠার সাথে করবে পুঁজিপতি শ্রেণি সেই দলের ওপর নির্ভর করবে তত বেশি। যেমন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে কর্পোরেট পুঁজির সেবায়।
মানবমুক্তির সংগ্রামের মহান শিক্ষক কমরেড স্ট্যালিন আজকের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চরিত্র প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘পূর্বে, বুর্জোয়ারা নিজেদেরকে উদারনীতিক রূপে উপস্থাপন করতো, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার কথা বলতো তারা এবং এই ভাবেই তারা সমগ্র জনগণের মাঝে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এখন এই উদারপন্থার শেষ অবশিষ্টাংশটুকুও পাওয়া যায় না। ‘ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতা’ বলে আজ আর কিছু নেই, ব্যক্তিগত অধিকার এখন শুধু পুঁজির মালিকদের জন্যই সংরক্ষিত ও স্বীকৃত। বাকি সমস্ত জনতাকেই শোষণের জন্য উপলব্ধ কাঁচা মাল হিসেবে গণ্য করা হয়। সকল দেশের সকল মানুষের অধিকারের, অর্থাৎ সাম্যের নীতিকে ধূলায় পদদলিত করে দিয়ে, আজ তার জায়গায় বিরাজ করছে সংখ্যালঘুদের শোষণ করার সম্পূর্ণ অধিকার প্রদান করার নীতি। শোষিত জনগণকে অধিকারচূ্যত করার নীতি। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার ধ্বজা আজ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত।”
এই কারণেই সত্যিকারের গণতন্ত্র আজ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রকৃত গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, জীবনের অধিকার সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের যুগে বুর্জোয়া রাষ্ট্র দিতে পারে না। সরকারের সমালোচনা করার জন্যই বিধায়ক জিগ্নেশ মেওয়ানিকে এভাবে হেনস্থা তা স্পষ্ট দেখিয়ে দিচ্ছে।