ন্যানো আর নাই তাহার ইন্তেকালের অমোঘ ঘোষণাটি হইয়া গিয়াছে৷
বিগত জুন মাসে গুজরাটের সানন্দ কারখানায় ‘শিল্পায়নের মডেল’ বলিয়া বিজ্ঞাপিত সে গাড়ির মাত্র একটি প্রতিনিধি দুনিয়ার আলো দেখিতে পাইয়াছিল৷ আগামী দিনগুলিতে আর একটিরও অদৃষ্টে তেমন সম্ভাবনা নাই৷ রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনীর এক নবরূপ ধারণ করিয়া সে আসিয়াছিল এবং মরিয়া একটি সত্যকে প্রমাণ করিয়া গেল যে, তাহার বাঁচিবার কথাই ছিল না৷ অন্তিম যাত্রায় বার্তা রাখিয়া গেল, তাহাকে দেখাইয়া শিল্পায়নের যে ফানুসটি ওড়ানো হইয়াছিল তাহা ছিল শুধুই মিথ্যার হাওয়ায় ভরা, অর্থনীতির নিয়মের সামান্য টোকাতেই যা হওয়ার হইয়াছে, ফানুস ফাটিয়াছে৷
এখনও নামজাদা সংবাদমাধ্যমের কুশী–লব ও বিগত সিপিএম সরকারের নেতা–মন্ত্রীগণ দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া জনগণকে শোনান, সিঙ্গুরের উর্বর মাটিতে ন্যানো ফলাইতে পারিলে দেখিতে কী রূপ উন্নয়নের বান ডাকিত পশ্চিমবঙ্গের আনাচে–কানাচে কিন্তু হায় এ পোড়া–বাংলার মূর্খ কৃষকে তাহার মহিমা বুঝিল না!
কী হইলে কী হইত? অনুমানের প্রয়োজন নাই, নরেন্দ্র মোদি সাহেবের ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট মডেলে’র কুলতিলক সানন্দ–এর অভিজ্ঞতা অনুসরণ করিলেই বিষয়টি প্রাঞ্জল হইয়া যাইবে৷
সিঙ্গুরের কৃষকদের মূর্খতায় ‘অভিমানী’ হইয়া পড়া টাটা সাহেবকে সযতনে ডাকিয়া আহমেদাবাদের নিকট সানন্দ এলাকায় ন্যানোকে পুনর্বাসন দিয়াছিলেন নরেন্দ্র মেদি৷ তাহার জন্য আশেপাশের সাত–সাতটি গ্রামের বাসিন্দাদের উৎখাত করিতে তাঁহার বিন্দুমাত্র আটকায় নাই৷ কখনও চোখ রাঙাইয়া, কখনও বা ‘জনস্বার্থের’ দোহাই পাড়িয়া কাজ হাসিল হইয়াছিল৷ মাত্র ০.০১ শতাংশ সুদে জনগণের টাকায় গড়া সরকারি তহবিল হইতে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ টাটাদের হস্তগত হইয়াছিল৷ ‘উদার মনস্ক’ টাটারা প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন, ২২ বছর পর তাঁহারা ঋণ শোধ করিতে শুরু করিয়া দেশবাসীকে ধন্য করিবেন৷ ২২ বছর দূর অস্ত্ মাত্র নয় বছরেই নিজ উৎপাদনের পাততাড়ি গুটাইয়া নানা বিদেশি গাড়ির যন্ত্রাংশ জুড়িয়াই সানন্দের দিন কাটে৷
টাটাদের সম্পদ স্ফীত হইতে স্ফীততর হইয়াছে৷ কিন্তু জমিদাতা গ্রামবাসী তাঁহাদের কর্মসংস্থান, জীবিকা, জীবনের নিরাপত্তার কী হইল টাটা কারখানার নিকটবর্তী উত্তর কোটপুরা, ছারোরি সহ গ্রামগুলির বাসিন্দাদের জমি গিয়াছে, পুকুর, খাল–বিল গিয়াছে, বিনিময়ে তাঁহারা নিজ জমির স্বাধীন কৃষক পরিচয় হারাইয়া সামান্য বেতনে টাটাদের বাগানের মালি হইয়াছিলেন৷ কিছুদিন বাদে সে কাজও গিয়াছে৷ গ্রামে আজ পানীয় জলটুকুও নাই, তাহার খোঁজে কমপক্ষে ৩/৪ কিলোমিটার রাস্তা উজাইতে হয়৷ নর্মদা নদী এবং তথা হইতে নির্গত খালের জল টাটার টাউনশিপে সুলভ হইলেও গ্রামে তাহা একেবারেই অধরা৷ জলের অভাবে ফসল মাঠেই শুকায়, তৃষ্ণার্ত ‘গো–মাতা’ ছটফটাইয়া মরেন৷ মানুষ এলাকা ছাড়িয়া পলাইতে ব্যস্ত৷ হাসপাতাল নাই, স্কুল নাই, কোটপুরার ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র প্রাথমিক স্কুলটিও বন্ধের অপেক্ষায় দিন গুনিতেছে৷
কারখানা হইয়াছে মাত্র সাড়ে তিনশো একর জমিতে, কিন্তু টাটারা পাইয়াছিলেন ১১০০ একর৷ বাড়তি জমিতে জমিয়াছে আবাসনের ব্যবসা৷ রমরমা হইয়াছে জমি দালালদের, বিজেপির বেড়ার অফিস ঘর সাততলা ইমারতে পরিণত৷ নেতারা চকচকে হইয়াছেন, গাড়ির কনভয় চড়িয়া আসিয়া তাঁহারা টাটা সাহেবদের সহিত হাত মিলাইয়া তৃপ্তির হাসি হাসেন৷ জল বাঁধ মানে না জমিহারা কৃষক রমণীর চোখে৷ সামনে নিকষ অন্ধকার দেখা যুবকের সম্বল শুধু দীর্ঘশ্বাস আর ব্যর্থ অভিসম্পাতের অস্ফূট উচ্চারণ!
আজ পরিষ্কার, সিঙ্গুরের ভবিষ্যৎও এমনটাই হইবার ছিল৷ যদি না এসইউসিআই(সি) দলের সাবধানবাণী শুনিয়া একেবারে শুরুতেই সিঙ্গুর রুখিয়া দাঁড়াইত৷ আন্দোলনরত কৃষক–মায়ের চুলের মুঠি ধরিয়া পুলিশ মারিতেছে দেখিয়া সেদিন মন্ত্রীমশাই বলিয়াছিলেন, ‘টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করিতে দিব না’৷ সিঙ্গুর বলিয়াছিল, পুঁজিপতি আর কৃষকের উন্নয়নকে এক দাঁড়িপাল্লায় মাপা চলিবে না৷ সিঙ্গুরের লড়াই ছিল– জনগণের পেটে লাথি মারিয়া টাটাদের উন্নয়নকে সকলের উন্নয়ন বলিয়া দেখাইবার বিরুদ্ধে৷
জয় পাইয়াছে সিঙ্গুর৷ কিন্তু নতুন খেলা শুরু হইয়াছে, তাপসীর দগ্ধ লাশ, অত্যাচারিতা কৃষক রমণীর আর্তনাদকে পুঁজি করিয়া ভোটের বাজারে রাজা উজির বনিবার প্রতিযোগিতা চলিয়াছে৷ সিঙ্গুরের লড়াইয়ের শিক্ষা হইতেই সে অপচেষ্টাকেও প্রতিরোধের পথ খুঁজিতে হইবে৷ ন্যানোর স্বল্পস্থায়ী জীবন আলেখ্য এই শিক্ষাই রাখিয়া গেল৷
(৭০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৩ জুলাই, ২০১৮)