মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর মার্কিন রাষ্ট্রদূত জুলিয়ানে স্মিথ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, ন্যাটো প্লাসের ষষ্ঠতম সদস্য হওয়ার জন্য ভারতের সামনে দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। ন্যাটো প্লাসের আর পাঁচটি দেশ হল অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, সাউথ কোরিয়া ও ইজরায়েল।
প্রশ্ন হল, যখন অন্যান্য দেশ আবেদন করেও সুযোগ পাচ্ছে না, তখন ন্যাটো ভারতকে সদস্য করতে চাইছে কেন? ভারতের সঙ্গে ন্যাটোর এই সখ্যতার ফলে কি দেশের মানুষের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে, নাকি গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী হবে? বা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা অর্জনে কি দেশের নাগরিকরা আরও সুযোগ পাবে? সেগুলি নিয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করার জন্যই কি ন্যাটোর এই উদ্যোগ?
উত্তর– না। তা হলে ন্যাটোর কাছে কোন মানদণ্ডে ভারতবর্ষ যোগ্য হয়ে উঠল? অহিংসার মন্ত্র জপা ভারত যখন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের হানাহানিতে শিরোনামে, দেশের শাসকরা চুরি-দুর্নীতিতে এভারেস্টের চূড়ায় বসে, বিরুদ্ধ মতের প্রতি সহিষুiরতা শূন্যের কোঠায়, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্ব-তালিকায় ক্রমাগত নিচের দিকের স্থান অধিকার করে দ্যুতি বিচ্ছুরিত করছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের স্বর্গোদ্যানে পরিণত হয়েছে, যা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাগুলি আসর গরম করছে, সেই সময় ভারতকে ন্যাটো প্লাসের সদস্য করার জন্য দরজা খোলা হচ্ছে।
সমাজতন্ত্রের প্রসার রোখার ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে আমেরিকার নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পারের বারোটি দেশ নিয়ে গড়ে তোলা হয় ন্যাটোকে। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ৩১। ১৯৯০ সালে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পতনের পর, বাণিজ্যে চিনের আধিপত্যকে আটকানোর জন্য এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যাটো প্লাস নাম দিয়ে সদস্য পদ বাড়ানোর জন্য নতুন উদ্যোগ নেয় সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি আমেরিকা।
চিনের রপ্তানিমুখী বাণিজ্যকে শুধু আটকানো নয়, ন্যাটোর শিরোমণি আমেরিকার প্রধান লক্ষ্য, ইলেকট্রনিক নির্ভর সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় প্রধান জ্বালানি বলে খ্যাত ন্যানো সেমিকন্ডাক্টারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। ন্যানো সেমিকন্ডাক্টার আমদানিতে বিশ্বে ভারতের স্থান দ্বিতীয়, যার বর্তমান বাজারদর ১৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৬ সালে ৫২ বিলিয়ন ডলার হয়ে ২০৩০ সালে ৮৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। ন্যানো চিপের ভারতের বিরাট বাজার আমেরিকা কোনও ভাবেই হাতছাড়া করতে চাইছে না। সেমিকন্ডাক্টর বা ন্যানো চিপ শুধু ফোন বা কম্পিউটারে ব্যবহার হয় না, এর চেয়েও আরও কয়েক গুণ চাহিদা রয়েছে চালকবিহীন ফাইটার উড়োজাহাজ, ড্রোন, দূরনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মিসাইল এবং ইলেকট্রনিক নির্ভর নানা যুদ্ধাস্ত্রের। করোনাকালে যখন গোটা পৃথিবী মৃত্যুর সম্মুখীন সেই সময় ২০২২-এর ২ আগস্ট আমেরিকার হাউস অফ কমন্সের স্পিকার নানসি পেলসি-র তাইওয়ান সফরকে ঘিরে চিন ও আমেরিকার প্রবল উত্তেজনা। এই উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ন্যানো সেমিকন্ডাক্টারের বাজারের দখল থাকবে কার হাতে– আমেরিকা নাকি চিন– এই দ্বন্দ্ব।
ভারতবর্ষের ন্যানো চিপের লোভনীয় বাজার থেকে আমেরিকার একচেটিয়া পুঁজিপতিরা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারছে না। তাই মাইক্রোচিপ কোম্পানিগুলির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে প্রেসিডেন্ট বা সেনেটররা ভারতবর্ষের পুঁজির চৌকিদারদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে মন জয় করছে। এ জন্য ভারতের সাথে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসাকে আইনি বৈধতা দিতে আমেরিকা দি ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজেশন অ্যাক্ট পাস করিয়ে রেখেছে ২০২২ সালে। দেশের অসচেতন নাগরিকদের আবেগকে প্রতারণা করার জন্য সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমেরিকা ও ভারতবর্ষের একযোগে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।
ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতকে সহযোগী পেলে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ভারতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চিনকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাতে পারবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার কাঁধে ভর দিয়ে ভারতবর্ষের লগ্নিপুঁজির নখ-দাঁতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া দেশের শ্রমিক-কৃষকদের সাথে আরও বেশি ক্ষতবিক্ষত হবে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান সহ এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলির শ্রমজীবী মানুষও। তাই সময় এসেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তোলার। সময় এসেছে আওয়াজ তোলার– ন্যাটো নয়, যুদ্ধও নয়।