আবার দু হাজার টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ তবে এ বার আর তা রাতারাতি নিষিদ্ধ করা হয়নি৷ সাধারণ মানুষ ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় পাবেন ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা দিতে বা বদলে নিতে৷ যদিও সাধারণ মানুষ নোট বদলাতে গিয়ে ব্যাঙ্কে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতারই সম্মুখীন হচ্ছেন৷ কারণ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এ ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা দিতে পারেনি৷
কিন্তু নতুন করে দু’হাজার টাকার নোট ছাপানোর মাত্র সাত বছরের মাথায় তা বাতিল করতে হল কেন? কেন আবার মানুষকে লাইন দিয়ে নোট বদলাতে হচ্ছে? এ সব কোনও প্রশ্নেরই উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দেশের মানুষের কাছে রাখা হয়নি? কেন হয়নি? ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী রাতারাতি নোট বাতিল ঘোষণা করায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছিল, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তো সাধারণ মানুষই৷ লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু হয়েছিল কয়েক শো সাধারণ মানুষেরই৷
পাঁচশো এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিলের কারণ হিসাবে সে দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, দেশে কালো টাকার যে সমান্তরাল অর্থনীতি চালু রয়েছে তার বেশির ভাগটাই রয়েছে পাঁচশো এবং এক হাজার টাকার নোটে৷ তিনি এই দু’রকমের নোট বাতিল করে কালো টাকার অর্থনীতিকে ভেঙে দিতে চান৷ এর সাথে তিনি যোগ করেছিলেন, কালো টাকার জোগান বন্ধ করে দেশের অভ্যন্তরের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যের কথা৷ আজ নোট বাতিলের সাত বছর পরে দেশে কারও মনে আর কোনও সন্দেহ নেই যে, দেশের সাধারণ মানুষকে অশেষ দুর্ভোগে ফেলা ছাড়া নোট বাতিলের ঘোষিত কোনও উদ্দেশ্যই সফল হয়নি৷ অবশ্য বৃহৎ পুঁজি মালিকদের স্বার্থে ছোট ব্যবসাকে লাটে তোলার কাজটি তারা এর দ্বারা করতে পেরেছেন৷ আর বৃহৎ পুঁজি মালিকদের ঋণ খেলাপির চোটে তহবিলশূন্য ব্যাঙ্কের সিন্দুক ভরাতে মানুষের ঘাড় ভেঙে নগদ জোগানোর কাজটিও তারা করতে পেরেছেন৷
নোট বাতিলের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যায়, বাজারে যত টাকা ছিল, প্রায় তার পুরোটাই ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে ফিরে এসেছে৷ উপরন্তু পুরনো নোট ফিরিয়ে নিতে এবং নতুন নোট ছাপতে সরকারের একটা বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়ে গেছে৷ নোট বাতিলের ফলে ছোট–মাঝারি শিল্প, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোমর ভেঙে গিয়েছে৷ এই ক্ষেত্রগুলিতে মূলধন খুইয়ে বহু জন সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে, এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়েছে৷ আর তার জায়গা দখল করেছে বৃহৎ পুঁজির মালিকরা৷ তাই তো তাদের আশীর্বাদ আজও মোদি সরকারের উপর ঝরে পড়ছে৷
প্রশ্ণ হল, পাঁচশো এবং এক হাজার টাকার যে বড় নোটকে কালো টাকার ভিত্তি হিসাবে দেখিয়ে বাতিল করা হয়েছিল, তার পরিবর্তে আরও বড় দুহাজার টাকার নোট সরকার ছাপল কেন? এই দুই ধরনের নোটে কালো টাকা জমিয়ে রাখার যে সুবিধা, দুহাজার টাকার নোটে তো তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা৷ তা হলে কেন সেদিন দুহাজার টাকার নোট ছাপা হল? এর দ্বারা কী ভাবে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব? দেশের সাধারণ মানুষ অন্তত তা সেদিন উপলব্ধি করতে পারেননি৷ এবং এ ভাবে যে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না, তা দেশজোড়া কালো টাকার রমরমা থেকেই স্পষ্ট৷ এ রাজ্যে তো বটেই, অন্য রাজ্যগুলিতেও কালো টাকা যতটুকু ধরা পড়ছে তার একটা বড় অংশ দুহাজার টাকার নোট হিসাবে৷ অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দুহাজার টাকার নোট চালুর দ্বারা আসলে কালো টাকার কারবারিদেরই সুবিধা হয়েছে৷ মোদি সরকারের আস্থাভাজন এক অর্থনীতিবিদ, প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কে ভি সুব্রহ্মণ্যনের মতে, বাজারে এখন যে ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের দুহাজার টাকার নোট রয়েছে তার ৮০ শতাংশই কালো টাকা মজুত রাখতে কাজে লাগানো হচ্ছে৷ যার মূল্য প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকা৷ তা হলে পাঁচশো এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল এবং দুহাজার টাকার নোট নতুন করে ছাপানোয় কোন উদ্দেশ্যটা সফল হল?
এ–সব কোনও প্রশ্ণের উত্তরই প্রধানমন্ত্রী সে দিন যেমন দেশের মানুষকে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি আজও তেমন মনে করেন না৷ কেন মনে করেন না? একটি গণতান্ত্রিক দেশে এত বড় একটি পদক্ষেপ কি জনসাধারণকে অন্ধকারে রেখে নেওয়া যায়? নিলে তা কি গণতান্ত্রিক আচরণ হয়? কেন্দ্রে বিজেপি শাসনের আট বছর পর আজ সচেতন মানুষের বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই যে, নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আচার–আচরণের ছিটেফোঁটা সম্পর্কও নেই৷ একটি সিদ্ধান্তও এই সরকার জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নেয়নি৷ একের পর এক সিদ্ধান্ত এই সরকার ওপর থেকে জনগণের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে৷
যে দিন রাতারাতি লকডাউন ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী, সে দিনও তিনি দেশের কোটি কোটি জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনার মধ্যেই আনেননি৷ সেই অন্তহীন দুর্ভোগ থেকে দেশের বিরাট অংশের মানুষ আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি৷ প্রধানমন্ত্রীর জিএসটি ঘোষণার দ্বারা কারা লাভবান হয়েছে? সাধারণ মানুষ, নাকি বৃহৎ পুঁজির মালিকরা? এর ফলে যেমন ছোট ব্যবসা তীব্র ধাক্কা খেয়ে বাজার থেকে হটে গেছে, তেমনই এক ধাক্কায় যে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এর ফলে ঘটেছে তার বোঝা সাধারণ মানুষই বয়ে বেড়াচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রী যে তিনটি কৃষি আইন চালু করতে চেয়েছিলেন, তা জনগণের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়েই৷ অর্থাৎ নোট বাতিল, জিএসটি কিংবা রাতারাতি লকডাউন বা কৃষি আইন, এনআরসি চালু– কোনও সিদ্ধান্তেই এই সরকার জনমতের তোয়াক্কা করেনি, সবই নিয়েছে স্বৈরাচারী কায়দাতে৷ একই ভাবে দুহাজার টাকার নোট বাতিলে জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই৷